রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) কৃপাল গাছের ফুল। (মাঝখানে) চাক কেওড়া ফুলের কুঁড়ি। (ডানদিকে) চাক কেওড়া গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

ওড়া (Sonneratia alba)

মাঝারি উচ্চতার বৃক্ষ হল ওড়া। ১০-৩০ ফুট উঁচু হয়। গাছের চারপাশে নরম কাদা মাটি ফুঁড়ে ৪০-৫০ সেমি লম্বা নলাকার শ্বাসমূল জন্মায়। বাকলের রং কালচে-বাদামি। বাকলে ছোট ছোট ফাটল দেখা যায়। পাতা গাঢ় সবুজ বা কালচে-সবুজ রঙের, রসালো এবং অবডিম্বাকার (Obovate)। ফুলের পাপড়ির রং সাদা। বৃতির বাইরের রং সবুজ হলেও ভেতরের রং গোলাপি বা লাল। পাপড়ির রং সাদা। ফুল দেখতে জামরুল ফুলের মতো। এদের ফলের রং সবুজ এবং টম্যাটোর মতো উপর-নিচে সামান্য চ্যাপ্টা ও গোলাকার। ফলের সঙ্গে ফুলের বৃতি ও গর্ভদণ্ড জুড়ে থাকে। ওড়া ফলের স্বাদ টক। এই ফল অনেকে খায়। জোয়ারের জলের মধ্যবর্তী সীমানা বরাবর নদী ও খাঁড়ির দু’ধারে ওড়া গাছ বেশি জন্মায়। ফলে জোয়ারের জলে বেশিরভাগ সময় এই গাছের অনেকটা অংশ ডুবে যায়। মহারাষ্ট্র সরকার ২০২০ সালে ওড়া গাছকে ‘রাজ্য ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ’-এর মর্যাদা দিয়েছে। জ্বালানী হিসেবে বা খুঁটি হিসেবে এই গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।

 

লৌকিক চিকিৎসা

পায়ের হাজা রোগের চিকিৎসায় ওড়া গাছের বাকলের ক্বাথ ব্যবহার করা হয়। কৃমি ও কফনাশক হিসেবে ফলের রসের ব্যবহার আছে। কাটা ছেঁড়ার চিকিৎসায় ও ত্বকে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে বাকলের ক্বাথ ব্যবহার করা হয়। বাছুরের বদহজম হলে ফলের ক্বাথ খাওয়ানো হয়।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

 

কেওড়া (Sonneratia apetala)

কেওড়া হল মাঝারি উচ্চতার বৃক্ষ। এর উচ্চতা হয় ৪০-৬০ ফুট। মাঝারি থেকে তীব্র লবণাক্ত জায়গায় এরা জন্মায়। কোনও চড়া নতুন তৈরি হলে সেখানে প্রথম দিকে যেসব প্রজাতি এসে প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের মধ্যে কেওড়া অন্যতম। এদের ৪০-৬০ সেমি লম্বা ও নলাকার প্রচুর শ্বাসমূল তৈরি হয়। বাকলের রং কালচে হলেও নরম কান্ডে বাকলের রং লালচে-বাদামি। বাকলে অনিয়মিতভাবে ফাটল দেখা যায়। কচি শাখাগুলো মোটা ডাল থেকে নিচের দিকে ঝুলে থাকে। পাতাগুলো ডিম্বাকার ও লম্বাটে এবং মোটা ও রসালো। ফুলে কোনও পাপড়ি হয় না, তবে চারটি সবুজ রঙের বৃত্যংশ আর এক গোছা পুংকেশর থাকে। পুংকেশরের রঙ সাদা বা হালকা গোলাপি। পাপড়ি না থাকায় পুংকেশরের রঙই ফুলের রং। কেওড়া ফুলে গর্ভদন্ডের আকার হয় ভারি অদ্ভুত। গর্ভদণ্ডের আগায় ছাতার মতো গর্ভমুন্নড থাকে, দেখে মনে হবে ঠিক যেন ব্যাঙের ছাতা। ফল সবুজ, গোলাকার ও টক স্বাদযুক্ত, অনেকটা ওড়া ফলের মতো। তেষ্টা মেটাতে নাকি অতীতে পথিক এই ফল খেত। সুন্দরবনের বহু মানুষ সুদূর অতীতকাল থেকে এই ফল সবজি হিসেবে বা আচার তৈরি করে খায়। এই গাছের পাতা হরিণের প্রিয় খাদ্য। আবার পচা পাতা চিংড়ির প্রিয় খাদ্য। ফুলে ভালো পরিমাণে মকরন্দ থাকায় কেওড়া ফুলের উপর মৌমাছিদের আনাগোনা বেশি। কেওড়া কাঠ খুব একটা শক্তপোক্ত না হওয়ায় সুন্দরবনবাসী এর কাঠ প্রধাণত জ্বালানী হিসেবেই ব্যবহার করে।

(বাঁদিকে) ওড়া গাছ। (ডানদিকে) কেওড়া ফুল। ছবি: সংগ্রহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

বিষাক্ত ঘাস খেয়ে গবাদি পশু যদি জাবর না কাটে বা খাওয়া বন্ধ করে দেয় তবে এর ফলের ক্বাথের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। জন্ডিস, কফ, আমাশয় ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ফলের ক্বাথ ব্যবহৃত হয়। বাকল ও ফলের ক্বাথ জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ফোলা ও ক্ষতের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়। পেট খারাপ হলেও এর কাঁচা ফল খাওয়া হয়।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

 

চাক কেওড়া (Sonneratia caseolaris)

চাক কেওড়া দেখতে প্রায় ওড়া বৃক্ষের মতো। উচ্চতাও তেমনই। তবে শাখাগুলো অনেকটা ঘনভাবে বিন্যস্ত। এদের শ্বাসমূল দেখতে আগা-ছেলা পেনসিলের মতো। শ্বাসমূল সাধারণত ১০-৬০ সেমি লম্বা হলেও কাদা মাটিতে ৬ ফুট লম্বা শ্বাসমূল হতেও দেখা গিয়েছে। পাতার রং হালকা সবুজ এবং উপবৃত্তাকার। বৃতির রং বাইরে ও ভিতরে সবুজ আর একটু বেশি লম্বা। বৃতি আর পাপড়ির অংশ ছ’টি করে। আর পাপড়ির রং গোলাপি। বৃতি যখন কুঁড়ি অবস্থায় পাপড়িকে ঢেকে রাখে তখন ফাঁক দিয়ে গোলাপি পাপড়ি দেখা যায়। তবে বাইরে অনেকটা বেরিয়ে থাকে লম্বা ও দন্ডাকার একটা গর্ভদণ্ড। গর্ভদণ্ডের আগা পেরেকের মাথার মতো প্রসারিত। মাত্র এক রাতের জন্য ফুল ফোটে, অর্থাৎ সন্ধ্যায় ফোটে আর সকালে পাপড়ি মুদে যায়, আর ফুলের গন্ধও বিশ্রী। ফলের রং সবুজ এবং কেওড়ার থেকে বড়, কিন্তু বেশি চ্যাপ্টা। ফলের আগায় ফুলের লম্বা গর্ভদণ্ড জুড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকে এই ফল কাঁচা বা রান্না করে খায়। ইংরেজিতে এই গাছকে বলে Apple Mangrove।

চাক কেওড়া গাছ জোয়ার ও ভাটার সীমারেখার মাঝামাঝি অঞ্চলে জন্মায়। স্রোতের বেগ যেখানে কম সেখানে এদের আধিক্য দেখা যায়। এদের লবণ-সহন ক্ষমতা মাঝারি ধরণের। চাক কেওড়া কাঠ মাঝারি দৃঢ়তাসম্পন্ন হওয়ায় এর কাঠ দিয়ে হালকা আসবাব ও খুঁটি তৈরি করা যায়। তবে জ্বালানি হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর বাকল থেকে যথেষ্ট ট্যানিন পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৪: দীনেন গুপ্তের আগে ‘দেবী চৌধুরাণী’ করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়

 

লৌকিক চিকিৎসা

কোথাও মচকা লাগলে চাক কেওড়া ফলের ক্বাথ ব্যবহার করা হয়। অন্ত্রে ঘা হলে ফল সেদ্ধ করে তার জল খাওয়া হয়। আধাপাকা ফলের ক্বাথ কফ ও পাকা ফলের ক্বাথ কৃমিনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রক্তপাত রোধে, কাটা ও ক্ষতের চিকিৎসায় চাক কেওড়া পাতার মণ্ড ব্যবহার করা হয়। গুটি বসন্তের চিকিৎসায় পাতা গুঁড়ো করে ব্যবহার করা হয়।

(বাঁদিকে) চাক কেওড়া গাছ। (মাঝখানে) ওড়া ফল। (ডানদিকে) অধিমূল-সহ কৃপাল গাছ। ছবি: সংগ্রহীত।

 

কৃপাল / কৃপা (Lumnitzera racemosa)

কৃপাল বা কৃপা হল মাঝারি উচ্চতার চিরহরিৎ বৃক্ষ। কেউ কেউ একে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদও বলেন। ১০-১৫ ফুট উঁচু হয়। মাটির উপর অনেক শাখা তৈরি করে ঝোপের আকার নেয়। কাণ্ডের গোড়ায় কখনও কখনও অধিমূল থাকে। এদের শ্বাসমূল থাকে না। তবে কিছু হাঁটু-মূলের মতো বিশেষ মূল তৈরি হয় গোড়ার দিক থেকে। এই মূলে থাকা ছিদ্রের সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। বাকলের রং লালচে-বাদামি। শাখার আগায় অনেক পাতা গুচ্ছাকারে জন্মায়। পাতাগুলোর আকার দই বা আইসক্রিম খাওয়ার কাঠের চামচের মতো। ফুলের আকার ছোটো ও রং সাদা। ফল উপবৃত্তাকার, অনেকটা ফুলদানির মতো, আর মাঝখানে চাপা।

কৃপাল গাছ নদীর তীরে বা সমতল জমিতে জন্মায়। যেখানে জন্মায় সেখানে শাখাপ্রশাখা মেলে অনেকটা জায়গা দখল করে নেয়। বেলে মাটি এদের বেশি পছন্দ। এদের লবণ সহন ক্ষমতা বেশি। ভারতীয় সুন্দরবনের পূর্ব অংশে কৃপাল গাছের সংখ্যা খুব কম। কমেছে পশ্চিম অংশেও। কৃপাল কাঠ খুব শক্ত হওয়ায় কাস্তে, কাটারি, দা, কুড়ুল, কোদাল, টাঙ্গি ইত্যাদি ঘরোয়া যন্ত্রের হাতল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ট্যানিনের পরিমাণ বেশি থাকায় বাকলের রস মাছ ধরার জালে মাখানো হয়। জ্বালানি হিসেবেও কৃপালের কাঠ উৎকৃষ্ট।
 

লৌকিক চিকিৎসা

পোড়া নারাঙ্গা বা হার্পিস রোগে ও ত্বকের চুলকানিতে কৃপাল গাছের বাকলের ক্বাথ ব্যবহৃত হয়। ক্যানসারের চিকিৎসাতেও পাতা ও নরম কান্ডের ক্বাথ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content