পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ রায় ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী।
কর্মচারী আন্দোলন আর বিরোধীদের তৎপরতায় ত্রিপুরার কংগ্রেস সরকার যখন বিব্রত, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও কংগ্রেসের কাছে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে গণ অসন্তোষ তীব্র হতে থাকে। রাজ্যে রাজ্যে গড়ে উঠতে থাকে বিরোধীদের আন্দোলন। একই সঙ্গে বিভিন্ন কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে শাসক দলের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।সামগ্রিক পরিস্থিতিটা দেশের কংগ্রেস বিরোধী শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার সহায়ক ছিল। এই ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শক্তির নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। সম্মিলিত বিরোধী শক্তির মোকাবেলা তথা জয়প্রকাশের নেতৃত্বে অহিংসা আন্দোলনের মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। শুরু হয় ধরপাকড়। দেশের অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতা সহ প্রথম সারির অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হয়!
সুখময়বাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বে ত্রিপুরা যেন দেশব্যাপী জরুরি অবস্থার ছোঁয়া সেদিন কিছুটা আগেই পেয়ে গিয়েছিল। একদিকে সিপিএম দলের সরকার বিরোধী আন্দোলন, অপরদিকে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য স্বদলীয় বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের জোর তৎপরতা চলছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের তৎপরতায় বার কয়েক ত্রিপুরার রাজনীতি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। সিদ্ধার্থবাবু ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সুখময়বাবু সহ বিরোধী বিধায়কদের কলকাতায় ডেকে নিয়ে গিয়ে পারস্পরিক সমঝোতার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ শেষপর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।
এমনকি, কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সঙ্গে যে সিপিএম’র এক গোপন সমঝোতা গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাজ্যসভার নির্বাচনে। বিধানসভায় কংগ্রেস সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও রাজ্যসভার ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ ১২ জন বিধায়ক সেদিন বিরোধীদলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছিলেন। রাজ্যসভার একমাত্র আসনটিতে বিরোধী প্রার্থীর জয় সুখময়বাবুর মন্ত্রিসভাকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও এটা বুঝতে পারে যে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়করা সিপিএম বিধায়কদের সঙ্গে মিলে যে কোনও সময় ত্রিপুরার সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটাতে পারে।
এমনকি, কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সঙ্গে যে সিপিএম’র এক গোপন সমঝোতা গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাজ্যসভার নির্বাচনে। বিধানসভায় কংগ্রেস সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও রাজ্যসভার ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ ১২ জন বিধায়ক সেদিন বিরোধীদলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছিলেন। রাজ্যসভার একমাত্র আসনটিতে বিরোধী প্রার্থীর জয় সুখময়বাবুর মন্ত্রিসভাকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও এটা বুঝতে পারে যে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়করা সিপিএম বিধায়কদের সঙ্গে মিলে যে কোনও সময় ত্রিপুরার সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটাতে পারে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ১০: পূর্ণ রাজ্যে প্রথম কংগ্রেস মন্ত্রিসভা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া
রাজ্যসভার নির্বাচনের একবছরের মধ্যেই কর্মচারীদের লাগাতর ধর্মঘটে সুখময়বাবু আবার সংকটের মুখে পড়েন। কর্মচারী ধর্মঘটকে ব্যর্থ করতে অবশ্য সরকার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। দমনমূলক নানা ব্যবস্হা,প্রলোভন সবই ছিল। কিন্তু তারপরও প্রশাসন সচল রাখা যায়নি। ১২ দিনের লাগাতর কর্মচারী ধর্মঘটে সরকারি অফিস অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কর্মচারী আন্দোলন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সুখময়বাবুর যতটা ভয় ছিল,তার তুলনায় বেশি ভয় ছিল নিজের দলের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের নিয়ে। কর্মচারী ধর্মঘটের এই ডামাডোলে সিপিএম-এর সঙ্গে মিলে বিক্ষুব্ধ বিধায়করা তাঁর সরকারের পতন ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল সুখময়বাবুর। সেজন্য তখন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা নৃপেন চক্রবর্তী সহ আটজন সিপিএম বিধায়ককে নিবর্তনমূলক আটক আইনে গ্রেপ্তার করে আশঙ্কমুক্ত হতে চেয়েছিলেন তিনি।কিন্তু এইসব ঘটনায় তাঁর সরকারের জনপ্রিয়তা প্রায় তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?
ত্রিপুরায় লাগাতর কর্মচারী ধর্মঘটের প্রায় তিন মাসের মধ্যেই সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা ঘটল। সুখময়বাবু এ বার যেন আরও ক্ষমতা পেয়ে গেলেন। এ বার একই সঙ্গে সিপিএম ও তাঁর নিজ দলের বিক্ষুব্ধদের জব্দ করার অস্ত্র যেন তিনি পেয়ে গেলেন হাতে। জরুরি অবস্থা জারির পর দেশের অন্যান্য অংশের মতো ত্রিপুরাতেও ধরপাকড় শুরু হল। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ‘মিসা’ আইনে আটক করা হল। কংগ্রেসের দুই বিক্ষুব্ধ বিধায়ক সমীর রঞ্জন বর্মণ ও তাপস দে’কে মিসায় আটক করে জেলে পুরা হল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ
জরুরি অবস্থা জারির আগে সুখময়বাবু এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ছিলেন। সিপিএম দলের আন্দোলন, কর্মচারী আন্দোলন, স্বদলীয় বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের তৎপরতা, রাজ্যসভার নির্বাচনে পরাজয় ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পূর্ণ রাজ্যোত্তর ত্রিপুরায় উন্নয়নের যে একটা গতি কাঙ্খিত ছিল সর্বস্তরে,কার্যত রাজনৈতিক অশান্তিতে তা মুখ থুবড়ে পড়েছিল তখন। এই সময়কালের মধ্যে সেই তুলনায় তেমন কিছু হয়নি। আর নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যে সব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল তারও সফল সমাপ্তি ঘটেনি। রাজনৈতিক অশান্তি এক অনিশ্চয়তা ডেকে এনেছিল রাজ্যে। যেখানে সুখময়বাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বই প্রশ্ন চিহ্নের মুখে সেখানে তাঁর নেতৃত্বে আর কতটা উন্নয়ন হতে পারে! রাজ্যের উপজাতিদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় খাদ্যাভাব, অনাহার মৃত্যু, রোগ-শোকের প্রাদুর্ভাব, এমনকি অভাবের তাড়নায় সন্তান বিক্রি ইত্যাদি প্রায়ই সংবাদ পত্রের শিরোনাম দখল করেছিল। নানা কারণে রাজ্যের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত। ত্রিপুরা।
সুখময়বাবু অবশ্য জরুরি অবস্থার ব্যবস্থা গুলোকে নিজের অনুকূলে ব্যবহারের সুযোগ হাতছাড়া করেননি। প্রথমেই তিনি নিজের প্রতিপক্ষদের মিসা আইনে জেলে পুরে দেন। এ জন্য তাদের চোরাকারবারী, কালোবাজারি ইত্যাদি অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সুখময়বাবুর সঙ্গে তদানীন্তন কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সম্পর্কও ভাল ছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়। ইন্দিরার ভীষণ আস্থাভাজন সিদ্ধার্থবাবু। আবার সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে সুখময়বাবুর খুব ভালো সম্পর্ক। এরকম অবস্থায় ত্রিপুরার উন্নয়নে দিল্লির মদত পাবার ক্ষেত্রে এক অনুকূল পরিস্থিতি ছিল সুখময়বাবুর সময়ে।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা ঘটনা যে,সেই সুযোগের কোনো সদ্ব্যবহার হয়নি তখন! —চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।