রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

জীবন নাচের মতো কখনও ছন্দময়, কখনও বা মনের আনন্দে কেবল হাত-পা নাড়া, যা ছন্দহীন। নৃত্যু একটি শিল্প-মাধ্যম, একটি শিল্পকলা। হাঁটাচলা করতে, হাত-পা নাড়তে আমরা সবাই পারি, কিন্তু নাচ আসলে এর চেয়েও বেশি। এটি আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করে, তার অন্ধকার জীবনে আলো নিয়ে আসে, জীবনকে নতুন ভাবে ফিরে পেতে শেখায়, আবিষ্কার করতে শেখায়। নাচ যেহেতু অনুভূতি প্রকাশে সাহায্য করে, তাই নাচের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যায় শারীরিক ও মানসিক চাপ। নাচ আমাদের নিজেদের বুঝতে শেখায়। তাই আমরা নাচের মাধ্যমে পক্ষান্তরে নিজেদেরকে প্রকাশও করতে পারি।

আমরা জানি, শরীর এবং মন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নৃত্যু আমাদের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়। ফলে আমাদের মনও নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়মিত নৃত্যু অভ্যাসে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নাচের বিভিন্ন ভঙ্গিমা ও অনুভূতি শরীরের বিভিন্ন মুদ্রার মাধ্যমে প্রকাশ করি। তাই এটি আমাদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তিকে বাড়াতেও সাহায্য করে। নাচ যেহেতু এক প্রকার শারীরিক ব্যায়াম। তাই এর নিয়মিত অভ্যাসের ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন সঠিক মাত্রায় নির্গত হয়। যেমন: আমাদের শরীরে মেলাটোনিন, এনডরফিন নামের হরমোনগুলি বিভিন্ন রকমের চাপ, হতাশা ও ব্যথা-বেদনা দূর করতে সাহায্য করে। তাই নাচের পর আমাদের মন ফুরফুরে হয়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে আমাদের শরীরের উপর। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে এই শিল্পকলা।
এতসব গুণাবলীর জন্য বিদেশে নৃত্যকে কেবল একটি শিল্প বা পারফরম্যান্সের মধ্যে আটকে না রেখে, তাকে সাইকোথেরাপিউটিক্যালি ব্যবহার করে। শুরু হয়েছে ‘ডান্স থেরাপি’ বা ‘ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি’ বা সংক্ষেপে ডিএমটি। তবে, কলকাতাও পিছিয়ে নেই। এর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ডিএমটি এর পাঠশালা। ‘কলকাতা সংবেদ’, ‘পাঠশালা ইনস্টিটিউট অফ পারফর্মিং আর্টস অ্যান্ড ফিটনেস’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই সকল সংস্থার ছাত্র-ছাত্রীরা বলছেন, তাদের মনের এনার্জি ও পজিটিভিটি বৃদ্ধি করতে নৃত্য থেরাপি ভীষণ সাহায্য করেছে। ছোট নিউক্লিয়ার পরিবারে এবং ফ্ল্যাটের ছোট্ট চার দেয়ালে বড় হতে হতে, আজকের দিনের অধিকাংশ মানুষ মনোরোগীতে পরিণত হয়েছে। তার ওপর সমাজে মেয়েদের উপর বৃদ্ধি পেয়েছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। করোনা অতিমারির কারণে বর্তমানে মানুষ ঘরবন্দি।

মনোবিদরা আশঙ্কা করছেন লকডাউন কেটে যাওয়ার পরও মানুষ একে অপরের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করতে পারবে না। অনেকের মধ্যে মনোরোগ, নিঃসঙ্গতা এবং হতাশা বৃদ্ধি পাবে। এইসব থেকে সঠিকভাবে বেরিয়ে আসতে গেলে প্রয়োজন একসঙ্গে সকলে মিলে ডান্স থেরাপির। নৃত্য বিশারদদের মতে, বিভিন্ন ধরনের নাচ যেমন—কথক, ওড়িশি ইত্যাদি নাচে পায়ের যেসব মুভমেন্ট হয় তা রাগ মোচনের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। হাতের বিভিন্ন মুদ্রা, চোখের তারার মুভমেন্ট- আমাদের মোটরস্কিলকে ধারালো করে। ফলে আমাদের মানসিক জোর, আবেগের সূক্ষ্মতা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে এই থেরাপির কোনও জুড়ি নেই। যেকোনও বয়সের মানুষ এই ডিএমটি এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। ধর্ষণ এবং গার্হস্থ্য হিংসার পরে মেয়েদের মধ্যে যে পোস্ট ট্রমাটিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটা থেকে বের হতে সাহায্য করে এই নৃত্য থেরাপি।
আরও পড়ুন:

নাচ যখন থেরাপি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

ভারতের শিক্ষা পদ্ধতিতে শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত আমরা সকলে মিলেমিশে হয় বিদ্যালয়, না হয় মহাবিদ্যালয়, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করি। এখানে আমাদের মনের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার অনেক বন্ধু পাওয়া যায়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার ছত্রছায়া ছেড়ে আসতে হয়, তখন আমরা যদি নতুন ভাবে এই ধরনের সংস্থাগুলির সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে পারি, তাহলে মনের অবসাদ এবং হতাশা অনেকটাই দূর হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

বিভিন্ন শিশুর জন্মগত সমস্যা, যেমন: অটিজম, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলতে এই ধরনের থেরাপির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও ডিমেনশিয়া, সিজোফ্রেনিয়া, নিদ্রাহীনতা, ডায়াবিটিস, ওবেসিটি ও ক্যানসারের মতো মারণ রোগের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলক ভাবে নৃত্যু থেরাপির প্রয়োগ চালু হয়েছে। ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত কিছু মহিলার উপর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে—একদল মহিলা যারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, আর একদল মহিলা যারা নৃত্য থেরাপির মতো এক আনন্দময় প্রাকটিসের মধ্যে রয়েছে তাদের টিউমার বৃদ্ধির হার, প্রথম দলের থেকে কম হচ্ছে। ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলার মতো দল ভিত্তিক খেলাতে যেমন একে অপরের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ এবং টিম ওয়ার্ক গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনই এই থেরাপিতে প্রকৃত টিম ওয়ার্ক গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

কলকাতা-সহ সমগ্র ভারতে ডান্স থেরাপি নিয়ে চিন্তাভাবনা অনেক দেরিতে শুরু হলেও আমেরিকা এবং ইউরোপে নৃত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি করে আধুনিক নৃত্য আন্দোলন জোরদার আকার ধারণ করে। ডান্স থেরাপির অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন মারিয়ান চেস, মেরি হোয়াইট হাউস ইত্যাদির মতো মহান মহিলার দ্বারা। ১৯৪০ সালে ডান্স থেরাপি, সাইকোডিনামিক থিয়োরি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। পরে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকান ডান্স থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন। যেখান থেকে ট্রেনিং দেওয়া হয়, প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। বর্তমানে এই রকম আরও অনেক সংস্থা থেকেও রেজিস্টার্ড ডান্স মুভমেন্ট থেরাপিস্ট ক্রেডেনশিয়াল অথবা বোর্ড সার্টিফায়েড ডান্স মুভমেন্ট থেরাপিস্ট ক্রেডেনশিয়াল প্রদান করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

কেবলমাত্র মুখের কথা বা প্রচার নয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং গবেষণাপত্রগুলিতে ডান্স থেরাপির ওপর নানান প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। ‘দি আর্টস ইন সাইকোথেরাপি’ তে (২০০৭) প্রকাশিত হয় যে সকল ব্যক্তি এই নৃত্য থেরাপি অভ্যাস করে, তাদের ওপর এর একটা ধনাত্মক প্রভাব আছে। ডিপ্রেশন কাটাতে এই থেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমেরিকান জার্নাল অব ডান্স থেরাপি’তে (২০০৪) প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানানো হয়, তারা মোট ৫৪ জন শিক্ষার্থীর ওপর পরীক্ষা করে দেখে নৃত্য থেরাপি অভ্যাসের পর, তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক ভাব অনেক কমেছে এবং তারা পূর্বের চেয়ে এখন সমাজের সঙ্গে মেলামেশায় অনেক সাবলীল।

‘অ্যালঝাইমার্স কেয়ার টুডে’ (২০০৯) তাদের পরীক্ষা থেকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বলছে, ডান্স থেরাপি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ‘আমেরিকান জার্নাল অব ডান্স থেরাপি’ আরও এক গবেষণায় জানাচ্ছে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের ডান্স থেরাপি করা যেতে পারে। এছাড়াও নানান গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে, শিশু-সহ সকল বয়সি মানুষদের ওবেসিটি বা স্থুলত্বও দূর করতে ডান্স থেরাপির জুড়ি নেই।

পুরাতন ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আধুনিকতাকে মিশিয়ে ভারতেও নৃত্য আন্দোলনের জোয়ার আনতে হবে। তবেই ওষুধ নির্ভরতা কমে ভারতও আনন্দের সুঙ্গে রোগবালাইকে পরাস্ত করে নীরোগ হয়ে উঠবে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content