সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির মায়ের কাছে একান্তে জানতে চাইলেন, ভীম স্বেচ্ছায়, না মায়ের অনুমতিক্রমে কাজটি করতে ইচ্ছুক হয়েছেন? দেবী কুন্তীর বক্তব্য—মায়ের আদেশে ব্রাহ্মণ ও নগরকে বিপদমুক্ত করতে এই কাজে উদ্যোগী হয়েছে ভীম। ধার্মিক যুধিষ্ঠিরের এ বিষয়ে প্রবল আপত্তি, প্রতিবাদে বলে উঠলেন, এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কেন? নিজপুত্রত্যাগ সজ্জনসম্মত নয়। মা কুন্তী পরপুত্রের স্বার্থরক্ষার কারণে নিজপুত্রত্যাগ করতে ইচ্ছুক হয়ে, লোকবিরুদ্ধ, এমন কি বেদবিরুদ্ধ আচরণ করেছেন।

যে ভীমসেনের বাহুর আশ্রয়ে সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন হন তাঁরা, যাঁর ভরসায় নীচমনা দুর্যোধনের দ্বারা অধিকৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখেন তিনি, যাঁর শৌর্য, শকুনিসহ, দুর্যোধনদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, যাঁর শক্তিমত্তাই, জতুগৃহ এবং অন্যান্য দুরাত্মাসহ পুরোচনের হাত থেকে নিজেদের মুক্তির কারণ, যাঁর ভরসায়, যুধিষ্ঠির, ধৃতরাষ্ট্রের অধীন এই ধনপূর্ণ বসুন্ধরা হাতের মুঠোয় পেয়েছেন বলে মনে করেন, কোন বুদ্ধিতে মা তাঁকে পরিত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছেন? অতিকষ্টে কী বুদ্ধি ও চেতনা লোপ পেয়েছে তাঁর?

প্রবল আত্মবিশ্বাসী দেবী কুন্তী। তাঁর মহাবলশালী পুত্র ভীম কখনও ব্যর্থ হবে না। বকরাক্ষসের কাছে ভোজ্য পৌঁছে দেবে সে এবং নিজেও বিপদমুক্ত হবে। দ্বিতীয় পাণ্ডব রাক্ষসের মোকাবিলায় প্রস্তুত।

অভয় দিলেন জননী কুন্তী। বৃকোদর ভীমের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা নিয়ে অতিরিক্ত অনুশোচনার কোনও কারণ নেই। রাক্ষসের কাছে ভীমকে প্রেরণ, কোনও বুদ্ধিভ্রম নয়। গৃহকর্তা ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের অজ্ঞাতসারে নিশ্চিন্ত দিনযাপন করছেন তাঁরা। সেই উপকারের প্রত্যুপকার করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। সৎপুরুষেরা উপকারের বহু প্রত্যুপকার করে থাকেন। তাই ভীমের, ব্রাহ্মণের প্রতি প্রত্যুপকারের দরুণ এই কাজে, বহু ধর্মকার্যের ফললাভ হবে। এটি দেবী কুন্তী নিশ্চিতভাবে জানেন।। ব্রাহ্মণার্থে মহান্ ধর্ম্মো জানামীত্থং বৃকোদরে। কুন্তীর এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ, ভীমের অপরিসীম শৌর্যবলে জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা পাওয়া এবং ভীমের দ্বারা রাক্ষস হিড়িম্ববধ।
মা কুন্তীর দৃঢ় বিশ্বাস, ভীমসেনের সমকক্ষ বীর কেউ নেই। এমনকি ভীম, যুদ্ধে শৌর্যপ্রকাশে, দেবরাজ ইন্দ্রকেও অতিক্রম করতে সমর্থ। জননী কুন্তী জানালেন, জন্মমাত্র ভীমসেন পার্বত্যভূমিতে পড়ে যায়, তখন তার শরীরের ভারে পাথর চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল। ভীমের বলের প্রতি জননী আস্থাশীল। ভীম আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকারে সক্ষম। মা কুন্তী, সজ্ঞানে ধর্মসঙ্গত কার্যোদ্ধারের উদ্যম নিয়েছেন, অজ্ঞতা, লোভ বা মোহবশত নয়। দুটি বিষয় সম্পন্ন হবে। প্রথমত ব্রাহ্মণগৃহে নির্বিঘ্ন বসবাসের ঋণ পরিশোধ হবে, দ্বিতীয়ত ধর্মকার্যের সিদ্ধি সম্ভব হবে। দেবী কুন্তী ক্ষাত্রধর্ম উল্লেখ করে বললেন, ব্রাহ্মণকে সাহায্য করলে ক্ষত্রিয় শুভলোক প্রাপ্ত হন। ক্ষত্রিয় যদি ক্ষত্রিয়ের রক্ষক হন তাহলে মৃত্যুর পরে ইহলোকে ও পরলোকে অশেষ যশ লাভ করেন। বৈশ্যের সাহায্যকারী ক্ষত্রিয় প্রজাদের আনন্দ দিয়ে থাকেন। শরণাগত শূদ্রের প্রাণরক্ষক ক্ষত্রিয় ইহলোকে ধনাঢ্য রাজার দ্বারা সম্মানিত বংশে জন্মগ্রহণ করেন।

কুন্তী, যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করলেন, বিশিষ্ট জ্ঞানী মহর্ষি বেদব্যাস এমনটাই নির্দেশ দিয়েছিলেন বধূমাতা কুন্তীকে। সেটিই কার্যে পরিণত করতে চলেছেন কুন্তী।

মায়ের ধর্মসঙ্গত যুক্তির কাছে হার মানলেন যুধিষ্ঠির। দয়ার প্রতিমূর্তি কুন্তীর এই উদ্যোগ যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য। ভীমসেন নিশ্চিতভাবে রাক্ষসকে বধ করবেই। ব্রাহ্মণের প্রতি মায়ের এই মমত্ব ব্যর্থ হবার নয়। যুধিষ্ঠর দেবী কুন্তীকে অবহিত করলেন, ভীমের পরিচয় যেন নগরবাসীদের কাছে প্রকাশ্যে না আসে—এ বিষয়েও ব্রাহ্মণকে সতর্ক করে দিতে হবে।

রজনী অতিক্রান্ত হলে ভীম রাক্ষসের ভোজ্য নিয়ে, রাক্ষস যেখানে অবস্থান করছে সেখানে উপস্থিত হলেন। বনের নিকটবর্তী হয়ে, রাক্ষসের খাদ্য ভক্ষণ করতে করতে, তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন ভীম। রাক্ষস তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে, সক্রোধে হাজির হল সেখানে। বিশালাকৃতি, মহাবেগবান, রক্তিমনয়ন, চুলদাড়ি সবকিছু তার লোহিতবরণ, বিকট চেহারা তার, আকর্ণবিস্তৃত মুখবিবর, শঙ্কুতুল্য কান ক্রমশ সূক্ষ্ম হয়েছে, তিনটি রেখায় কুঞ্চিতভ্রু ভয়ঙ্করাকৃতি রাক্ষস, ওষ্ঠভাগ দংশন করে, পায়ের ভারে ভূতল কাঁপিয়ে তুলে হাজির হল। তার খাদ্যষ্টভোজনরত ভীমকে দেখতে পেয়ে চোখ দুটি আরও বিস্তৃত করে সক্রোধে বলে উঠলেন, কোঽয়মন্নমিদং ভুঙ্ক্তে মদর্থমুপকল্পিতম্। পশ্যতো মম দুর্বুদ্ধির্যিযাসুর্যমসাদনম্।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

আমার বরাদ্দ খাদ্য ভোজন করছে কে? কোন দুষ্টবুদ্ধি আমায় অগ্রাহ্য করে, যমের বাড়ি যেতে চাইছে? ভীম মনে মনে অবজ্ঞাভরে হাসলেন। রাক্ষসকে তাচ্ছিল্য করে মুখ ফিরিয়ে খেয়ে চললেন। রাক্ষসের আর সহ্য হল না। দু’ হাত তুলে ভয়ঙ্কর গর্জন করে ভীমসেনকে হত্যা করতে ছুটে এল সে। ভীমের আচরণের কোনও পরিবর্তন নেই। এক মনে রাক্ষসের দিকে না তাকিয়ে তাঁর সেই ভোজনে কোনও বিরতি নেই। বক রাক্ষস, আরও রেগে, ভীমের পীঠে দু’ হাতে সজোরে আঘাত করল। সেই আঘাতেও ভীমসেন নির্বিকার। তাঁর ভোজনে বিরাম নেই কোনও। এ বার একটি গাছ তুলে নিয়ে ছুটে এল রাক্ষস। আঘাতের লক্ষ্য ভীমসেন। এইবার ভোজন শেষ করে, আচমনান্তে পরিতৃপ্ত ভীম সন্তুষ্টচিত্তে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলেন।

রাক্ষস যে গাছটি ছুঁড়েছিল সেটি ভীম সহাস্যে অক্লেশে ধরে ফেললেন। রাক্ষস, ভীমের উদ্দেশ্যে একের পর এক গাছ উপড়ে ফেলে নিক্ষেপ করতে লাগল। নররাক্ষসের এই ঘোর যুদ্ধে বহু গাছ বিনষ্ট হল। ভীমের মুখে নিজের নাম শুনে রাক্ষস বেগে তাঁর দিকে ধেয়ে এল। নিজের দুই বাহু দিয়ে পাণ্ডুপুত্র ভীমকে জড়িয়ে ধরলো সে। মহাবলশালী ভীমও নরখাদক রাক্ষসকে বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে তীব্রবেগে আকর্ষণ করতে লাগলেন। রাক্ষস দ্রুতবেগে নিজেকে মুক্ত করতে চাইল। পরস্পরের আকর্ষণের টানাপোড়েনের ফলে রাক্ষস ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সেই মহা আকর্ষণের ফলে ভূকম্পন শুরু হল, বিশাল মহীরুহগুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পড়তে লাগল।

ভীম ক্রমশ ক্ষীণবল রাক্ষসকে মাটিতে পিষে ফেলে হাঁটু দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। হাঁটু দিয়ে পিঠ চেপে ধরে, ডানহাতে তার গ্রীবা ধরে, বামহাত দিয়ে কোমড় ধরে, বসন পড়বার জায়গাটি দুই ভাঁজ করতে লাগলেন। ব্যথায় উৎকট চিৎকার করে উঠল রাক্ষস। ভীম তাঁকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগলেন। ভগ্ন রাক্ষসের মুখ থেকে রক্ত নির্গত হল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভগ্ন হল। ভয়ঙ্করশব্দ করে বিশাল পর্বতপ্রমাণ বক রাক্ষস প্রাণ ত্যাগ করল। সেই শব্দে বকরাক্ষসের পরিজনবর্গ পরিচারকসহ সন্ত্রস্ত হয়ে গৃহ হতে বেড়িয়ে এল। ভীমসেন, ভয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন তাদের সান্ত্বনা দিলেন এবং একটি শপথ করালেন। সেই শপথবাক্যটি হল, ন হিংস্যা মানুষা ভূয়ো যুষ্মাভিরিহ কর্হিচিৎ। হিংসতাং হি বধঃ শীঘ্রমেবমেব ভবেদিতি।। তোমরা আর মানুষের প্রতি হিংস্র হবেনা। যদি হিংস্র হও,তবে তোমাদের সত্বর হত্যা নিশ্চিত।সেই প্রতিজ্ঞা স্বীকার করে বিদায় নিল রাক্ষসরা। এর পর থেকে রাক্ষসদের শান্তরূপ দেখতেই অভ্যস্ত হল নগরবাসীরা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

বকরাক্ষসের জ্ঞাতিরা, ভীমের দ্বারা হত ও নিক্ষিপ্ত বককে দেখে, ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে তৎক্ষণাত স্থানত্যাগ করল। ভীম নিজের বাসস্থান সেই ব্রাহ্মণগৃহে ফিরে গেলেন। জ্যেষ্ঠকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। প্রভাতবেলায় বহুলোক, নগরের বাইরে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত, রক্তাক্তদেহ মৃত বকরাক্ষসকে দেখল। পর্বতশৃঙ্গতুল্য ভয়ঙ্কর রাক্ষসকে পড়ে থাকতে দেখে রোমাঞ্চিত হল নাগরিকবৃন্দ। একচক্রা নগরীতে খবর ছড়িয়ে পরল। সহস্র মানুষ, বালকবৃদ্ধস্ত্রীলোক নির্বিশেষে মৃত বকরাক্ষসকে দেখতে ভিড় করল নগরদ্বারে। মানুষের অসাধ্য এই কাজে বিস্মিত হয়ে, সকলে মিলে দেবতাদের আরাধনা শুরু করলেন। পুরবাসীরা খবর নিলেন,রাক্ষসকে খাদ্য সরবরাহের পালা ছিল কার? খুঁজে পেয়ে সেই ব্রাহ্মণকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

বহুলোকের প্রশ্নের সম্মুখীন ব্রাহ্মণ, এ বিষয়ে পাণ্ডবদের তৎপরতা গোপন করে, জানালেন, এক মন্ত্রসিদ্ধ উদারমনা ব্রাহ্মণ, বিপন্ন ব্রাহ্মণের উদ্ধারকর্তা। গৃহকর্তা সেই ব্রাহ্মণ, আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় যখন বিষণ্ণমনে কাঁদছিলেন সেই সময়ে সেই মহান উদ্ধারকর্তা ব্রাহ্মণ নগরের এই উৎপাতের বিষয়ে জেনে,নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণ করে, হাসতে হাসতে বললেন, আমি রাক্ষসের খাদ্য নিয়ে যাব। আমার জন্যে ভয় পাবেন না। প্রাপয়িষ্যাম্যহং তস্মা অন্নমেতদ্ দুরাত্মনে। মন্নিমিত্তং ভয়ঞ্চাপি ন কার্য্যমিতি চাব্রবীৎ।। তিনি অন্ন নিয়ে গিয়েছিলেন বনে, লোককল্যাণের নিমিত্ত নিশ্চয়ই তিনিই এই কাজটি করেছেন। বিস্মিত ও আনন্দিত চার বর্ণের মানুষ সেই ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠল। পৃথা কুন্তীর পুত্ররা সেই ব্রাহ্মণগৃহে বাস করতে লাগলেন।

বকরাক্ষস রক্ষকবেশে ভক্ষকের ভূমিকায়, আপাতসুরক্ষা দান করে জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল নগরবাসীদের। বৃহত্তর শক্তি যেমন আপাত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে দুর্বলের রক্ত চুষে খায় অনেকটা সেইরকম। ধর্ম যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন তাকে অভয় দেয় মানবতাবোধ। ধর্মবোধ সুরক্ষিত থাকে শক্তির আশ্রয়ে। ভীমের শক্তির ওপরে নির্ভর করে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের সুখস্বপ্নে বিভোর হন যুধিষ্ঠির। সামর্থ্যহীন ধর্ম দুর্বল। ভীমকে কেন্দ্র করে, যুধিষ্ঠিরের মায়ের প্রতি তিরস্কার হয়তো তার বহিঃপ্রকাশ। শক্তির কাছে নতজানু হয় মানবতাও।শক্তিমত্তার সহায়তায় জয়ী হয় মনষ্যত্ববোধ। মা কুন্তী, ভীমের বাহুবলের প্রতি আস্থাশীলা ছিলেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৮: স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১০২: ডিমপোনাই হোক বা ধানীপোনা—পুকুরে ছাড়ার সঠিক সময় কখন?

কতজ্ঞতাবোধ মনুষ্যত্ববোধের অন্যতম উজ্জ্বল দিক, লোকহিতের মূলে রয়েছে ধর্মবোধ। সেই ধর্মবোধ ও কৃতজ্ঞতার ঋণপরিশোধের প্রাণনায় দেবী কুন্তী এক মহান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের সন্তানকে, আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধবিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মহাভারতের বিচিত্র চরিত্রের ভিড়ে দেব, দানব, গন্ধর্ব, রাক্ষস, রাক্ষসী এবং সেই সঙ্গে মানুষের সমাবেশে খেই হারিয়ে যায়। প্রশ্ন জাগে কে প্রকৃত মনুষ্যত্বের উত্তরাধিকার বহন করছে? মানবিক গুণে কী একজন রাক্ষস সমৃদ্ধ হতে পারে? একজন তথাকথিত বিখ্যাত মহাভারতীয় ব্যক্তিত্ব কী হাবেভাবে আচরণে রাক্ষসপ্রতিম নন?নরত্বের অভিমান ঠিক কোথায়? চরিত্রগুলির পরস্পর বিরুদ্ধ আচরণগুলি যেন এক গভীর দ্বান্দ্বিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এটিই বোধ হয় একাধারে মহাকাব্যিক আকর্ষণ বিকর্ষণের তীব্র অভিঘাত।

রাক্ষসসমাকীর্ণ মহাভারতে হিড়িম্বরাক্ষস, হিড়িম্বা রাক্ষসী, বকরাক্ষসের সঙ্গে ইতিমধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে পাণ্ডুপুত্রদের। রাক্ষসরা নরমাংসভুক, ভীষণাকৃতি, মানুষের মুখোমুখি হলেই নরমাংসলোলুপ হয়ে ওঠে তারা। রাক্ষসী হিড়িম্বার নরমাংস আস্বাদনের লোভ কিছুমাত্র কম নয়। রাক্ষসী কিন্তু প্রথম দর্শনেই প্রবল বলশালী ভীমের পৌরুষদীপ্ত রূপে মুগ্ধ হন। ভাইকে অগ্রাহ্য করে হিড়িম্বা। রাক্ষসীরূপ ত্যাগ করে সুন্দরী নারীর বেশে প্রণয় নিবেদন করল ভীমকে। নরমাংস ভোজনে অভ্যস্ত হিড়িম্বা আশ্বাস দিলেন নরখাদক রাক্ষসদের হাত থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা করবে সে নিজে। ভাই হিড়িম্ব ভগিনীর মোহিনী রূপ ও কামেচ্ছা অবগত হয়ে তার ভয়ঙ্কর ইচ্ছা প্রকাশ করল, যানিমানাশ্রিতাঽকার্ষীর্বিপ্রিয়ং সুমহন্মম। এষ তানদ্য বৈ সর্ব্বান্ হনিষ্যামি ত্বয়া সহ।

যাদের আশ্রয় নিয়ে আমার সাঙ্ঘাতিক বিরুদ্ধাচরণ করলি,তোকে সমেত তাদেরকে আমি আজই হত্যা করব। ভীমের আচরণ বিপক্ষীয় রাক্ষস ও প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের প্রতি রাক্ষসতুল্যই বটে। মহর্ষি ব্যাসের যুদ্ধবর্ণনায় হিড়িম্ব ও বক রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধে ভীম তাদের সমকক্ষ হিংস্র, রক্তলোলুপ। তাঁর শৌর্যের প্রকাশে আছে নৃশংসতা, বর্বরতার ছায়া। হিড়িম্বার প্রতি ভীমের আচরণে মানবোচিত কোন চারিত্রিক দুর্বলতা দেখা যায়নি। তিনি হিড়িম্বর মোকাবিলায় বলেছেন, ময্যেব প্রহরৈহি ত্বং ন স্ত্রিয়ং হন্তুমর্হসি। আমাকে প্রহার কর, স্ত্রীলোককে হত্যা করতে পারবি না। হিড়িম্বার হয়ে সাফাই গেয়েছেন, চোদিতৈষা হ্যনঙ্গেন শরীরান্তরচারিণা। শরীরের মধ্যস্থিত কামদেবের প্ররোচনায় এই রাক্ষসী (প্রণয়ে) উৎসাহিত হয়েছে। কাময়ত্যদ্য মাং ভীরুস্তব নৈষাপরাধ্যতি। হে ভীরু এই নারী আমাকে কামনা করে, তোর কাছে কোন অপরাধ করেনি।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

এ সবই ভীমের মানবিক অভিব্যক্তি। হিড়িম্ববধের মহান উদ্দেশ্য ছিল অরণ্যভূমিকে রাক্ষসের কবলমুক্ত করা। নিরাবাধাস্ত্বয়ি হতে ময়া রাক্ষসপাংসন!। বনমেতচ্চরিষ্যন্তি পুরুষা বনচারিণঃ।। আমি তোকে হত্যা করলে এই বনভূমি নিরাপদ হবে, নির্বিঘ্নে চলাফেরা করবে বনচারী মানুষজন। রাক্ষসী হিড়িম্বা দেবী কুন্তীর কাছে অকপটে তার প্রণয়বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছে। রাক্ষসীর প্রেমনিবেদনে মানবী প্রেমিকার প্রণয়োদ্ভাসের উজ্জ্বলতা শুধু। নেই কোনও হিংস্রতা, নেই প্রতিহিংসার আবিলতা, নেই ছলাকলার বিন্যাস, শুধু আছে অমলপ্রেমের দীপ্তি, হোক না তা কামোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া কোন অপ্রাকৃত মুহূর্ত। রাক্ষসী স্বজন, নিজধর্ম, বন্ধুবর্গকে পরিত্যাগ করেছেন ভীমকে অবৈধভাবে নয়, বৈধ স্বামীরূপে লাভ করবার তাগিদে। রাক্ষসী হিড়িম্বা একজন ধার্মিকের মতোই ধর্মের লক্ষণ বর্ণনা করেছেন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে। আপৎসু যো ধারয়তি ধর্ম্মং ধর্ম্মবিদুত্তমাঃ। বিপদকালে যিনি ধর্মবোধ ধারণ করে রাখেন তিনিই শ্রেষ্ঠধর্মবিদ। এ কোন রাক্ষসী? যে নরমাংসভোজনে অভ্যস্ত হয়েও মানুষের বোধে ধর্মের তত্ত্বকথা শোনান?

দুর্বৃত্ত রাক্ষস বক, নরখাদক, মানুষের মাংস ভোজন করে পুষ্ট। সেই উত্তম দেববিরোধী রাক্ষস একচক্রা দেশ রক্ষা করে। তাঁর রক্ষাকার্যের রাজনির্দিষ্ট বেতন, অন্যান্য অপরিমিত খাদ্য এবং সঙ্গে একজন মানুষের জীবন। পালাক্রমে একেকজন নগরবাসী তাঁর জীবন বিসর্জন দিয়ে রাক্ষসের করালগ্রাসে পরিণত হয়। ভীম, রাক্ষসকে বধ করলেন জনস্বার্থ রক্ষার কারণে। এমনকি রাক্ষসের পরিজনবর্গকেও হিংসা থেকে মুক্তির অঙ্গীকারবদ্ধ করলেন। মহর্ষি বেদব্যাস ভীমসেনের সঙ্গে দুই রাক্ষসের লড়াইয়ের যে বিভৎস চিত্র এঁকেছেন সে যুদ্ধে ভীমসেনকেও রাক্ষসের যোগ্য নৃশংস প্রতিদ্বন্দ্বী বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। তবে তাঁর যুদ্ধ বহুজনহিতায় বহুজনের কল্যাণে, সামগ্রিক সুখে নিবেদিত, তাঁর নিজের স্বার্থরক্ষা বা যশোলিপ্সা ছিল না মোটেই।

রাক্ষসরা আজ আর নেই কিংবা মানুষের মধ্যেই তাদের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি হয়তো সুপ্ত আছে। মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে আজও সেই রাক্ষসবৃত্তি প্রতিফলিত হয়।ভীমসেনরা আছেন। আধুনিক যুক্তিনিষ্ঠতায়, সামর্থ্যে তাঁরা অনন্য। হিড়িম্ব, বকরাক্ষসরা আছে মানবমনের অন্তর্নিহিত মানসলোকে, সুপ্ত নির্মমতায়। ভীমসেনেদের সহায়তায় হয়তো জীবন, অনায়াসে বহমান এখনও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content