বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) কেয়া গাছের ঝোপ। কেয়ার পুরুষ ফুল (মাঝখানে)। (ডান দিকে) ফল-সহ কেয়া গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ২০০টি দ্বীপ নিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদীগঠিত দ্বীপাঞ্চল সুন্দরবন। তিনটি প্রধান নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা আর তাদের প্রায় চারশো শাখানদী ও উপনদী মিলে হাজার হাজার বছর ধরে পলি সঞ্চয় করে গড়ে তুলেছে বিশ্বের বিস্ময় সুন্দরবন এলাকা। একটা সময় ছিল যখন এই বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল জঙ্গলে ঢাকা, শ্বাপদ সঙ্কুল।

১৮৭৪ সালে বাংলার বড়লাট স্যার রিচার্ড টেম্পল নিষ্কর সুন্দরবন এলাকা সরেজমিনে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে গড়ে তোলা হবে বসতি। এতে সরকারের লাভ হবে দু’দিক থেকে। সুন্দরবনের মহা মূল্যবান বৃক্ষরাজি হয়ে উঠবে যেমন সরকারের সম্পদ তেমনই জঙ্গল হাসিল করা জমি থেকে কর আসবে। সেই মতো বিস্তীর্ণ জঙ্গলপূর্ণ এলাকাকে ১১০ টি লটে ভাগ করে সেগুলি বিত্তবান ব্যক্তি ও জমিদারদের ইজারা দেওয়া শুরু হল। সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলে জঙ্গল হাসিল ও চাষবাসের জন্য পার্শ্ববর্তী মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলা এবং উড়িশা ও ঝাড়খণ্ড অঞ্চল থেকে অনেক গরিব মানুষকে আনা হল। কালক্রমে তারাই হয়ে উঠল বর্তমান সুন্দরবন অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা।
কিন্তু বাসিন্দা হলেই হলেই তো আর বেঁচে থাকা যায় না। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ আর বিষধর সাপের সঙ্গে মানুষের নিত্য ওঠাবসা। নদীপথ ছাড়া যোগাযোগের কোনও উপায় নেই। নেই কোনও স্কুল বা হাসপাতাল। তার উপর প্রতি বছর প্রবল সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের বিপদ। সব মিলিয়ে ঊনিশ ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে সুন্দরবনবাসীর জীবনযাত্রা ছিল দুঃসহ, অকল্পনীয়। কোনও মানুষ অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল ছিল স্থানীয় কবিরাজ। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই তাঁরা স্থানীয় নানা গাছগাছালির ভেষজ গুণ নির্ধারণ করেছিলেন। আর সেই জ্ঞান বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে মান্যতা পেয়েছে।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বা বাদাবন বিশ্বে এক অনন্য বাদাবন। ম্যানগ্রোভ ও তাদের সহযোগী উদ্ভিদ মিলিয়ে ভারতে মোট ৭৬টি প্রজাতি পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবন অংশে খাঁটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ৩৩ টি প্রজাতি রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু সহযোগী উদ্ভিদ। সেই সব উদ্ভিদের ভেষজ গুণ কালের স্রোতে মানুষ ভুলতে বসেছে। কারণ বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।

প্রতিটি দ্বীপাঞ্চলে গড়ে উঠেছে চিকিৎসাকেন্দ্র ও স্কুল। ফলে সুন্দরবনের মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য আর ভেষজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল নয়। বংশানুক্রমিক লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতিও তাই প্রায় অবলুপ্ত। অথচ আমরা জানি, চিন সহ বেশ কিছু উন্নত দেশ এখন ভেষজ চিকিৎসার গবেষণায় বিপুল বিনিয়োগ করছে। আমাদের দেশে সেই উদ্যোগ এখনও সেভাবে গৃহীত হয়নি। অথচ আমাদের দেশ হল বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভেষজ উদ্ভিদে সমৃদ্ধ দেশ। তাই সুন্দরবনের কয়েকটি ভেষজ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ও তার লৌকিক চিকিৎসা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করবো।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

 


হরগোজা / হরকচ (Acanthus ilicifolius Family: Acanthaceae)

হরগোজা গাছ সুন্দরবনের সাধারণ মানুষের কাছে হরকচ নামেই পরিচিত। আমাদের বাড়ির সামনে যে খাল ছিল তার দুই পাড়ে যেখানে-সেখানে এই হরগোজা গাছের ঝোপ দেখা যেত। এই গাছের ধারে-কাছে যাওয়া খুব বিপজ্জনক, কারণ এর পাতার কিনারায় রয়েছে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ কাঁটা। তবে ফুলের সৌন্দর্য অসাধারণ। রজনীগন্ধার মতো লম্বা একটা স্টিক (মঞ্জরীদণ্ড) গাছের আগা থেকে বেরিয়ে আসে। আর তাতে নিচ থেকে ওপরের দিকে চমৎকার হালকা নীল বা বেগুনি রংয়ের ফুল পর পর ফুটতে থাকে। এই ফুল তোলার লোভে অনেকবার হরগোজা গাছের কাঁটার আঘাত সহ্য করেছি।

ইদানিং অনেকেই ভুল করে হরগোজা গাছকে শিয়ালকাঁটা গাছ বলে ভুল করে। শিয়ালকাঁটা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নয়, আর সুন্দরবনে জন্মায়ও না। সাদৃশ্য বলতে শিয়াল কাঁটার পাতার কিনারাতেও তীক্ষ্ণ কাঁটা থাকে হরগোজার মতো। কিন্তু ফুল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাছাড়া ম্যানগ্রোভের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হরগোজার পাতা অনেক বেশি সবুজ এবং মোমযুক্ত। মৌমাছিরা এই ফুলের মধু খেতে খুব ভালোবাসে বলে ফুল ফুটলে মৌমাছিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। নদী খাল বা জলাশয়ের ধারে জন্মায় বলে অনেক সময় এই গাছের ঠেস মূল দেখা যায়। গুল্ম জাতীয় এই গাছ প্রায় তিন চার ফুট লম্বা হয়। ডিসেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে ফুল আসে। ফুল ঝরে গেলে লম্বা মঞ্জরীদণ্ডের ওপর বৃক্কের আকারে ফল জন্মায়। এর শেকড় পলি আটকে রাখতে খুব সাহায্য করে। তাই নদীর কিনারায় থাকা হরগোজা গাছ নদী তীরের ভাঙ্গন রোধে দারুন সাহায্য করে।

হরগোজা গাছের পাতার উপরে কখনও কখনও দেখেছি হালকা সাদা রংয়ের আস্তরণ। এই আস্তরণ ধুলোর মতো ও প্রায় স্বচ্ছ। ছোটবেলায় জানতাম পাতার উপর ধুলো জমেছে। তবে পরে জেনেছি হরগোজা গাছ অতিরিক্ত লবণ পাতার কোশে সঞ্চয় করে। কিছু লবণ পাতার কোশ থেকে বাইরে বার করে দেয। সেই লবণ পাতার উপরে আস্তরন তৈরি করে। বৃষ্টি হলে পাতার উপর থেকে সেই লবণ ধুয়ে যায়। আবার পুরনো পাতা খসে পড়ার মাধ্যমেও এরা পাতা থেকে লবণ ত্যাগ করে। এদের ফল পাকলে ফেটে যায় এবং ফলের ভিতর থেকে বীজ বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে যায়। সাপ কামড়ালেও দংশীতস্থানে পাতা ও নরম কাণ্ডের রস লাগানো হতো।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

 

বাত লৌকিক চিকিৎসা

কোনও মানুষ বাঘের আক্রমণে আহত হলে তার ক্ষতস্থানে পাতার রস ও মণ্ড লাগানো হয়। মানুষের বিশ্বাস এতে ক্ষতস্থানের বিষক্রিয়া দূরীভূত হয়। ক্যানসারেও পাতার রস ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে সুন্দরবনের মানুষ হাঁপানি ও কফ-কাশির চিকিৎসায় হরগোজা পাতা বা নরম কাণ্ডের রস ব্যবহার করত। অতীতে সুন্দরবনবাসীরা হাঁপানি নিরাময়ে হরগোজা কাণ্ডের গুঁড়োও ব্যবহার করত। শ্বেতপ্রদরে ও পঙ্গুত্ব দূরীকরণে শিকড়ের ক্বাথ ব্যবহার করা হত। অতীতে শ্বেতপ্রদর ও দুর্বলতার চিকিৎসায় দুধে মূল ফুটিয়ে সেই দুধ পান করার রীতি চালু ছিল। বাত ও গ্রন্থির ফোলায় পাতা ঝলসে ব্যবহার করা হত। মাথা ধরা ও ত্বকের রোগেও হরগোজা পাতার রস ব্যবহৃত হত।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

 

কেয়া (Pandanus foetidus Family: Pandanaceae)

কেয়া হল ঠেসমূলযুক্ত গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। সুন্দরবন অঞ্চলে নদী বা সমুদ্রের ধারে কেয়া গাছের ঝোপ দেখা যায়। অনেক সময় নদী বা সমুদ্রের তীর থেকে অনেকটা দূরেও কেয়া গাছের ঝোপ দেখা যায়। বালিয়াড়ির উপরে কেয়া গাছ ভালো জন্মায় তবে যেসব জায়গা জোয়ারের জলে নিয়মিত ডুবে যায় সেখানে কেয়া গাছ জন্মায় না। কেয়া গাছের খুব শক্তপোক্ত ঠেসমূল রয়েছে। ঝড়ে বা স্রোতের আঘাতে যাতে গাছ উপড়ে না যায় সেজন্য এই ব্যবস্থা।

কেয়ার পাতা আনারসের পাতার মতো, কিন্তু বড়ো আকারের পাতা। পাতার কিনারায় তীক্ষ্ণ কাঁটা থাকে। আবার পাতার মধ্যশিরা বরাবর নিচের দিকেও কাঁটা থাকে। এদের স্ত্রী ও পুরুষ ফুল পৃথক গাছে হয়। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে ফুল আসে। এদের পুরুষ ফুল ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। স্ত্রী ফুলগুলি গুচ্ছাকারে থেকে মঞ্জরী গঠন করে। এদের আনারসের মতো দেখতে কমলা রঙের ফল হয়। কেয়া গাছের আর এক প্রজাতি Pandanus tectorious বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে এক সময় দেখা যেত। এর আকার তুলনামূলকভাবে বড়। তবে সম্ভবত এরা এখন বিলুপ্ত।

কেয়া গাছের পাতা প্রাচীনকাল থেকে সুন্দরবনবাসীরা ঘর ছাওয়ার কাজে এবং টুপি ও আসন তৈরির কাজে ব্যবহার করে। কর্পুরের বিকল্প হিসেবে কেয়ার ফুল ব্যবহৃত হয়। ফুলের নির্যাস সুগন্ধী হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। কেয়া ফুলের পরাগরেণু যা কেয়া-কেশর নামে পরিচিত খুব সুগন্ধি হয়। কেয়া-কেশরের সঙ্গে খয়ের গাছ থেকে পাওয়া খয়ের মিশিয়ে সুগন্ধি খয়ের তৈরি করা হয়।

(বাঁদিকে) হরগোজা ঝোপ। ছবি: লেখক। (ডানদিকে) হরগোজা ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

প্রাচীনকালে সুন্দরবনবাসীরা কচি পাতার রস জন্ডিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁপানি, যন্ত্রণাদায়ক মূত্রত্যাগ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করত। গবাদি পশুর চোখে ছানির চিকিৎসায় শিকড়ের রসও ব্যবহার করত।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content