রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

স্ত্রী চড়ুইটির সঙ্গে সেই কাঠঠোকরা পাখিটি মৌমাছি বীণারবের কাছে গিয়ে বলল, হে ভদ্রে! এই চড়ুইটি আমার অত্যন্ত প্রিয় এক মিত্র। কোনও এক দুষ্ট হাতি কোথা থেকে এসে, এর ডিমগুলো ভেঙে দিয়ে একে অত্যন্ত দুঃখিত করে গিয়েছে। তাই সেই দুষ্ট হাতিটাকে মারবার জন্য যে উপায় করেছি তাতে তোমাকে প্রয়োজন। সেই জন্যই আমরা দু’জনে তোমার কাছে এসেছি।

মক্ষিকা বীণারব বললে, এমন করে আপনি কেন বলছেন বন্ধুবর! আপনি শুধু আদেশ করুন। আপনার মিত্র মানে ইনি আমারও মিত্র। কথায় বলে, মিত্রের প্রতি ঘটে যাওয়া কোনও অপকারের বদলা নেওয়ার জন্য, তার বিহিত কী করে করা যায় সে বিষয়ে একজন মিত্রেরই সবসময়ে চিন্তা করাটা উচিত। এটুকুও যদি একজন মিত্র আরেকজন মিত্রের জন্য না করতে পারে তবে সে আর কী করলো?

আমারও মেঘনাদ নামে একটি ব্যাঙ বন্ধু আছে। তাকেও ডেকে নিই। তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে যেটা করা ঠিক হবে সেইটা করি। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেই। শাস্ত্রে বলে, সবসময় যাঁরা অন্যের হিত চিন্তায় নিমগ্ন, সদাচারী এবং শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সেই সব প্রভাবশালী বিদ্বানরা বিচারবিবেচনা করে যে নীতি প্রয়োগ করে কাজ করেন, তা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না।

তখন তারা তিনজনে একসঙ্গে গিয়ে ব্যাঙ মেঘনাদের কাছে গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। সে তখন বলল, “কিয়ন্মাত্রোঽসৌ বরাকো গজো মহাজনস্য কুপিতস্যাগ্রে?”— আমরা সকলে যদি একত্রিত হই তাহলে আমাদের ক্রোধের সামনে ওই সামান্য একটা হাতি কিছুই করতে পারবে না। তাই আমি যেমন যেমন মন্ত্রণা দিচ্ছি তেমনভাবে কাজ করলে কার্যসিদ্ধি নিশ্চিত। মক্ষিকা বীণারব! তুমি কাল দুপুরে সেই হাতির কানের কাছে গিয়ে ভনভনিয়ে বীণাধ্বনির মতো শব্দ করতে থাকবে, যাতে শ্রবণসুখের লালসায় আত্মমগ্ন হয়ে সে তার নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়। আর ঠিক তখনই কাঠঠোকরা গিয়ে তার কঠিন ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে তার চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেবে। সে যখন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে জলের খোঁজে এদিক ওদিক পাগলের মতো ছুটে বেড়াবে, তখন একটা গভীর গর্তের সামনে আমি সমস্ত ব্যাঙদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর আওয়াজ করতে শুরু করবো।
একসঙ্গে একজায়গা অনেক ব্যাঙের ডাক শুনে সে ভাববে নিশ্চয়ই সেখানে কোনও জলাশয় আছে আর চোখে দেখতে না পাওয়ায় সেই গভীর গর্তের মধ্যে পড়ে সে তখন মারা পড়বে। এ ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যদি আমরা কাজ করতে পারি তাহলে আমাদের সঙ্গে সে যা শত্রুতা করেছে তার উপযুক্ত জবাব পাবে।

ঠিক যেমন যেমন মন্ত্রণা করা হয়েছিল, তারা সকলে মিলে ঠিক সেইটাই করল। ঠিক দুপুর বেলায় মক্ষিকা বীণারব হাতিটির কানের কাছে এসে ভনভনিয়ে বীণার ধ্বনি শুরু করলো। কাব্যপ্রসিদ্ধি আছে, মক্ষিকার ধ্বনি নাকি হাতিদের খুব প্রিয়। ভালো সঙ্গীত বা শ্রুতিমধুর যন্ত্রানুসঙ্গ শুনে আরামে আমাদের চোখ যেমন বুঁজে আসে হাতিরও ঠিক তেমনটাই হল। কাঠঠোকরাটি ঠিক সেই সময়ের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। চোখ বন্ধ না করলে হাতির শুঁড়ের আঘাতের ভয়ে কেউ হাতির ধারে কাছেই যেতে পারে না।

হাতি বীণার ধ্বনি শুনে আরামে চোখ দুটি বন্ধ করা মাত্র কাঠঠোকরা গিয়ে তার শক্তিশালী ঠোঁট দিয়ে তার চোখদুটি ফাটিয়ে দিল। এরপর জলের খোঁজে সেই অন্ধ হাতিটি যখন পথ খুঁজে বেড়াতে শুরু করল ঠিক তখনই অসংখ্য ব্যাঙের ডাক কানে এল তার। গভীর গর্তের সামনে মেঘনাদ-ব্যাঙটি তার সমস্ত আত্মীয়পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেছে তখন। এতো ব্যাঙের ডাকের শব্দ শুনে অন্ধ হাতিটি ভাবলো নিশ্চয়ই সামনেই কোনও বড় জলাশয় আছে, না হলে এতো ব্যাঙ একসঙ্গে আর কোথায়ই বা থাকবে? তারপরে যা হবার সেইটাই হল—জলাশয় ভেবে বিশাল গর্তের মধ্যে পড়ে তার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হল।
 

১৫তম কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪০: দুর্বল বা অসহায়রা একত্র হলে তাঁরাই অজেয় হয়ে ওঠেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

টিট্টিভী বলল, সেইজন্যেই আমি বলছিলাম একত্রে সবাই মিলে বিরোধ করলে বড় বড় শত্রুকেও পরাভূত করা যায়। টিট্টিভ এও বলল, হে কল্যাণী! তবে তাই হোক। সমস্ত সুহৃদ্বর্গকে ডেকে একসঙ্গে সমুদ্রের জল শুষে ফেলবো আমরা। তারপর সে সমস্ত বক-সারস-ময়ূর প্রভৃতি সকল পক্ষীকূলকে ডেকে বলল, “বন্ধুগণ! এই সমুদ্র আমাদের ডিমগুলোকে অপহরণ করে নিয়ে আমাদের দুঃখিত করেছে। তাই এই সমুদ্রকে কিভাবে আমরা সকলে মিলে শুকিয়ে দিতে পারি তার একটা উপায় ভাববার জন্যেই আপনাদের আজ এখানে আহ্বান করেছি। বন্ধুগণ!

আপনারা আমাদের এই বিপদে সহায়তা করুন। সকলে তখন নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে বললেন, “অশক্তা বযং সমুদ্রশোষণে, তৎ কিং বৃথা প্রযাসেন?” —আমরা সকলে একসঙ্গে চেষ্টা করলেও সমুদ্রকে শোষণ করতে পারবো না। তাই বৃথা প্রচেষ্টা করে কী হবে? কারণ কেউ যদি নির্বল হয়েও শুধু অভিমানের দম্ভে নিজের থেকে অধিক বলবান শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যায় তার অবস্থা দাঁতভাঙা হাতির মতোই হয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪১: কান্না হাসির দোল দোলানো ‘একটি রাত’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

দম্ভের বশে হাতি পাহাড়ের গায়ে দাঁত দিয়ে আঘাত করে তাকে ধ্বংস করতে চাইলেও পাহাড়ের কিছু মাত্র ক্ষতি হয় না, উল্টে সেই হাতিটিরই দাঁত ভেঙে যায়—সে পরাজিত হয়। তাই সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করবার মতো ক্ষমতা আমাদের মতন ক্ষুদ্র প্রাণীদের কারওই নেই। তাই আমাদের অভিমত হল বিনতার পুত্র বৈনতেয় গরুড়ের কাছে যাওয়া যাক। তিনি আমাদের রাজা—আমাদের রক্ষার দ্বায়িত্ব তাঁরই। তোমাদের দুঃখের সমস্ত কারণ তাঁর কাছেই গিয়ে বিশদে নিবেদন করো তোমরা। নিজ জাতির প্রাণীদের এইরকম পরাজয়ের সংবাদে ক্রুদ্ধ হয়ে এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি কোনও না কোন উপায় একটা কিছু নিশ্চয়ই বের করবেন। সবচেয়ে বড় কথাটা যেটা সেটা হলো, আমাদের এই আর্তি শুনে সমুদ্রের বিরুদ্ধে কিছু মাত্র পদক্ষেপও যদি তিনি গ্রহণ না করেন, তাহলেও দুঃখ পাওয়ার মতন কিছু হবে না। কারণ শাস্ত্রে বলে—
সুহৃদি নিরন্তরচিতে গুণবতি ভৃতেঽনুবর্তিনি কলত্রে।
স্বামিনি শক্তিসমেতে নিবেদ্য দুঃখং সুখী ভবতি।। (মিত্রভেদ, ৩৭২)


অর্থাৎ, অভিন্নহৃদয় বন্ধু, গুণী সেবক, সদানুবর্তিনী প্রেমপূর্ণা স্ত্রী বা শক্তিশালী রাজার কাছে নিজের দুঃখটুকু নিবেদন করেও মানুষ সুখী হয়। কোনও প্রতিকার না করে রাজা যদি প্রজার দুঃখটুকুও শোনেন তাহলেও প্রজা নিশ্চিন্ত হয়। তাই আমাদের এখন গরুড়ের কাছেই যাওয়া উচিত কারণ তিনিই আমাদের স্বামী—আমাদের রাজা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

সবাই মিলে মনস্থির করে পক্ষীকুলের সকলে উদাস মুখে ছল ছল নেত্রে গরুড়ের কাছে গিয়ে করুণ স্বরে ডাকাডাকি করতে শুরু করলো, “অহো অব্রহ্মণ্যমব্রহ্মণ্যম্‌” —হে রাজন্‌! আমাদেরকে রক্ষা করুন, রক্ষা করুন আমাদেরকে। আপনার মতো একজন শক্তিশালী রাজা থাকা সত্ত্বেও এই সদাচারী টিট্টিভের ডিমগুলি সমুদ্র অপহরণ করে নিয়েছে—এতো সমুদ্রের পক্ষীবংশের নাশ করবার অভিপ্রায়। আপনি এর প্রতিকার করুন রাজন্‌! একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে, আমাদেরকে অরক্ষিত ভেবে সমুদ্রের মতোই অন্য যে কোনও দুষ্টই নিজেরদের ইচ্ছে মতো আমাদের হত্যা করতে ভয় পাবে না। আপনি এই বিপদে আমাদের একমাত্র সহায়। এই মুহূর্তে আপনার হস্তক্ষেপ
নিতান্তই আবশ্যিক। কারণ শাস্ত্রেও বলে—
একস্য কর্ম সংবীক্ষ্য করোত্যন্যযোঽপি গর্হিতম্‌।
গতানুগতিকো লোকো ন লোকঃ পারমার্থিকঃ।। (ঐ, ২৭৩)


অর্থাৎ একজন কেউ কিছু অন্যায় করলে, তার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অন্য লোকেও সেই একই অন্যায় কাজ করতে শুরু করে। কারণ মনুষ্যচরিত্রই এমন—গতানুগতিক; কিসে ভালো আর কিসে মন্দ এসব তারা বিচার করে না। অন্ধের মতো পূর্ববর্তী লোকের আচরণকে তারা পুনরাবৃত্তি করতে থাকে মাত্র—পারমার্থিক সত্যের তারা অনুসন্ধান করেন না। সেই কারণে স্বামীর কর্তব্যই হল ধূর্ত চোর, দুরাচারী ডাকাত কিংবা কটুবাক্য প্রয়োগকারী কপটাচারী লোকজনের হাতে পীড়িত প্রজাকে রক্ষা করা। কারণ শাস্ত্রকারেরা বলেছেন—


যে রাজা যথাযথভাবে প্রজাকুলকে রক্ষা করেন, প্রজাবর্গের সুকর্মের ছয়ভাগ তিনি পুণ্যরূপে লাভ করেন। কিন্তু সেই প্রজার অধর্মাচরণের ফলে জাত পাপের ষড্‌ভাগও সেই রাজাকেই গ্রহণ করতে হয়—যদি সেই রাজা যথা নিয়মে প্রজাকুলকে রক্ষা করতে না পারেন। কারণ প্রজাপীড়নের ফলে যে সন্তাপ প্রজাকুলের মধ্যে উত্পন্ন হয়, সেই সন্তাপই অগ্নির মতো সে রাজার সম্পদ থেকে শুরু করে তাঁর আত্মীয়বন্ধু, এমনকি তাঁর নিজের প্রাণ পর্যন্ত নাশ করে তবেই শান্ত হয়।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content