রাতের বেলা সন্ধ্যে।
ঘননীল সরোবর আর ঘিরে থাকা সবুজ পাহাড়। যে চিত্র ইউরোপ মহাদেশে বেশ সুপরিচিত সেই দেশটির ক্ষেত্রে। সহজেই অনুমেয় দেশের নামটি। সুইৎজারল্যান্ড। দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেন্ট্রাল সুইৎজারল্যান্ডের বিভাগীয় শহর জুগ-এর জমিতে। হোটেলে রাতের ডিনার সম্পূর্ণ হল। পাহাড়ি বাতাসের টানে বেরিয়ে পড়া হোটেলের বাইরে। তবে রাত অর্থে খুব স্বাভাবিকভাবেই মনের মাঝারে ভাসে এক ঘন আঁধার ছবি। যদিও প্রায় রাত ন’টা বাজতে চলেছে, কিন্তু এদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত। দিনের আলোয় রাঙিয়ে আছে চারপাশের প্রকৃতি। আবার গনগনে রোদের দাপটও নেই।
পোরশে গাড়ির শোরুম ।
আমার ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে কোনও কোনও পরিবার গেলেন লেকের দিকে অর্থাৎ লেক জুগ। জার্মানদের কাছে যা ‘Zugersee’। জুগের বেশ খানিক অংশ জুড়ে আছে এই লেক। লেকের কিছুটা অংশ প্রবেশ করেছে লুজার্ন কান্টন বা প্রদেশে। আর কিছুটা জুরিখ সীমানার মধ্যে। আমরাও হোটেল সংলগ্ন সুন্দর চওড়া রাস্তা বরাবর বাঁদিক ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার নামটাও পরিষ্কার সুন্দর করে বড়হরফে সাদারং দিয়ে লেখা। ‘Chamerstrasse’, জার্মান উচ্চারণ স্যমারসট্রাসে।
আরও পড়ুন:
চলো যাই ঘুরে আসি: অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৬: রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে বাবু
চারপাশের সবুজের মাঝে থেকে থেকেই চোখে পড়ছে ঝকঝকে তকতকে নামিদামি কোম্পানির গাড়ির শোরুম। আর্কিটেকচার ফার্ম। সুপার মার্কেট, যার গায়ে লেখা মাইক্রোলিনো। এক কথায় সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো বিজনেস পার্ক। তবে নজর টেনে নিল তাক লাগিয়ে দেওয়া হোটেলের পাশের পড়শি ‘পোর্শে’।
এক স্টেশনে একা যাত্রী।
আর রাস্তার অপর দিশায়? সে ছবি অন্য ধারার। বিস্তীর্ণ কচি সবুজ ঘাসে ঢাকা দিগন্তছোঁয়া মাঠ — যা দেখে সাধু বাংলায় বলতে হয় তৃণাচ্ছাদিত চারণভূমি। খোলা আবহাওয়ায় গবাদিপশুর বিশ্রামের জায়গা। ছায়াযুক্ত কাঠামোর ভিতরে। সেখানে রাখা আছে তাদের খড় ইত্যাদি সব উপযুক্ত খাবারদাবার। দিব্যি সুন্দরভাবে নিজেরা একমনে খেয়ে চলেছে তাদের জন্য বিভক্ত করা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে। এ তো তাক লাগিয়ে দেওয়া দৃশ্য। পোর্শের আধুনিকতা যেন হার মেনে গেল। সে জমিতে রয়েছে বিশাল বিশাল কাঠের ঘর। যেখানে মজুত আছে সুনিপুণ ভঙ্গিমায় বেঁধে রাখা থরেথরে ঘাসের গুঁড়ি। শহুরে জীবনযাপনের সঙ্গে গ্রামভিত্তিক কার্যকলাপকে গুরুত্ব দিয়ে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা। এ যেন পাশ্চাত্য দেশে শহর-গ্রামের একত্রীকরণের এক প্রতীক।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ
দিনের আলো প্রায় নিভুনিভু। দূরে সবুজ সমভূমির সমান্তরালে চলে গিয়েছে টানা রেলপথ। সঙ্গে গজিয়ে ওঠা ছোটছোট বুনো ফুল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম বেশ খানিকটা। পাহাড়ি গড়ানে বাড়িগুলিতে ক্রমশ জ্বলে উঠছে আলো। আলোয় সেজে উঠছে রাস্তার বাতিস্তম্ভ। পথঘেঁষা পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি স্টেশন। কৌতূহলবশত রাস্তা থেকে ধীরকদমে প্ল্যাটফর্মের ভিতর। সেখানে যাত্রী মোটে দু’জন। নেই কোনও টিকিট ঘর, না কোনও স্টেশনমাস্টার। সবকিছু স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা।
সোল্লেরমিউলিতে আমি।
ঝকঝকে দুটি প্লাটফর্ম। সেখানে কেবল লম্বা দুখানা চেয়ার বসানো। দুটি প্লাটফর্মে পরপর দুটি ট্রেন থামার পর হুশ করে বেরিয়ে গেল। একটিতে লেখা লুজার্ন। অন্যটিতে লেখা বার। স্টেশনের ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। রাত ৯টা ৪৭ মিনিটে আবার লুজার্ন থেকে বার অভিমুখে ট্রেন আসবে। প্রকৃতির আলো পুরোপুরি অস্তমিত হয়নি তখনও। পাহাড়-ঘেরা সদ্য বাতিজ্বলা সেই স্টেশনের নাম সোল্লেরমিউলি। সত্যিই রাত হল বেশ। স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে আমাদের হোটেল। জুরিখ-লুজার্ন হাইওয়ের কাছেই। রাস্তাটুকু পেরিয়ে ফিরে যাচ্ছি হোটেলে। স্টেশন থেকে বার-এর দিকে আবার হুশহুশিয়ে ছুটে গেল ট্রেন। তবু সে স্মৃতি আজও শাশ্বত অমলিন।
চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি
চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি
* চন্দ্রাণী সরকার। লেখিকার ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।