বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


মানকুমারী বসু।

উনিশ শতকের দারুণ সময়। একটি মেয়ে অন্দরমহলে বসে লিখে চলেছেন বিরহের কবিতা। বয়স উনিশ হবে। সদ্য স্বামীহারা মেয়েটির কাছে বৈধব্য পালনের থেকেও বেশি হয়ে উঠেছে বিরহ। কবিতাকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছিল যে দাম্পত্য, তাকে ভোলা অত সহজ নয়। একটি প্রিয় মানুষ চলে গেল আজীবনের মতো। কত মধুর প্রহর কেটেছে একসঙ্গে, কবিতার হাত ধরে কৈশোরের সেতু পার হয়ে দুটি ছেলে মেয়ে সদ্য এসে দাঁড়িয়েছিলেন যৌবনের কিনারায়। ঠিক তখনই কিশোর ছেলেটি আকাশের তারা হয়ে গেলেন।

মেয়েটি মনে মনে খুঁজতে শুরু করলেন তাঁকে। গদ্যের ভূমি পেরিয়ে তাঁর শোক থেকেও জেগে উঠল শ্লোক। মানকুমারী বসুর কবি সত্তার আড়ালে থাকা গল্পের বাক্স খুললে এক্ষুণি গড়িয়ে পড়বে চোখের জল। সেই করুণ গল্পগুলিই পিছনে রেখে চলুন মানকুমারী বসুর জীবনের গল্প বলি। মনকেমনের একটুকরো মেঘ বুকের মধ্যে রাখি। ওই হোক গল্প বলার আসন।
উনিশ শতকে মেয়েদের জন্য আঁধার সময়। মেয়েদের আলোর খোঁজ তাদের নিজেদেরই করতে হয়। সেই সময় চিকের আড়াল থেকে সরস্বতীর লীলাকমল হাতে যে মেয়েরা সহজিয়া ভঙ্গিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাহিত্যের দরবারে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানকুমারী বসু। যশোর জেলার শ্রীধরপুর গ্রামের মেয়ে মানকুমারী বসু। ছোট থেকে মেয়ের বড় অভিমান। বাবা আদরের মেয়ের নাম রাখলেন মানকুমারী। বাবার কাছে প্রথম অক্ষর জ্ঞান হয় তাঁর। বামাবোধিনী পত্রিকা দেখে লেখা প্রকাশ করার বড় সাধ জাগে মানকুমারীর। সকলের চোখের আড়ালে লিখে ফেললেন—‘লাইবাইটের উপাখ্যান।’ প্রকাশযোগ্য লেখা এই প্রথম।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

মানকুমারী শৈশবের স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন বোনকে দিয়ে বাঁধানো এক খাতার কথা। তাঁর বোন খাতাটি চেয়েছিলেন গান লিখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মানকুমারী নিভৃত অবসরে বসলেন লেখার জন্য। পরে মানকুমারীর কবিতাই পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর নিজের মতে প্রথম লেখা গদ্য। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও তো গদ্যময়। কিন্তু এক কঠিন ছন্দে জীবনের কষ্ট, না পাওয়ার বেদনাগুলিকে একসূত্রে গেঁথেছেন মানকুমারী বসু। সেই আমলে একটি মেয়ের পক্ষে কবির তকমা পাওয়া খুব সহজ কথা ছিল না। অন্দরমহল আর পাকশালা ছেড়ে সাহিত্যের দরবারে পা ফেলা তখন রীতিমতো সাহসের বিষয়। বিশেষত সে যুগে তখন নারীদের ঘর হতে আঙিনা বিদেশ।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

বিবাহ পরবর্তী জীবনে স্বামীর উৎসাহে সাহিত্যরচনা করতে থাকেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখে ফেলেন ‘পুরন্দরের প্রতি ইন্দুবালা’!কবিতাটি বীর রসাত্মক। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল লেখাটি। সম্পাদক বিভাগ কবিতার প্রশংসা করেন এবং মানকুমারীর কণ্ঠে প্রশংসার শতনরী পরিয়ে দেন। মানকুমারী যথার্থ এনলাইটেন্ট পার্টনার ছিলেন তাঁর স্বামীর। কিন্তু স্বামী মারা যেতে লেখা থামাননি। লিখেছেন ‘প্রিয় প্রসঙ্গ’, বনবাসিনী নামে একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। মানকুমারী বসু সমাজ সচেতন ছিলেন। কৌলিন্য প্রথা ও বৈধব্য বাঙালি মেয়েদের মানসিকভাবে যে ভাঙন তৈরি করে তার প্রতিবাদে দাঁড় করিয়েছিলেন নিজের শব্দ সেনাদের। —

‘জীবন্তে পুড়িবে বাছা মা বাপ সম্মুখে!
বোঝে না যে বিয়ে হায়!
তার আজি এ কি দায়!
‘বিধবা’ কহিতে বুক ফেটে যায় দুখে,
বিধি হে! এ পোড়া বিধি কে আনিল মুখে?’
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: হে নূতন…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

পতিতাদের প্রতিও তাঁর এমপ্যাথি কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। কেবল বেদনা নয় , স্বদেশ প্রেমের দৃপ্ত কবিতাও লিখেছেন তিনি। দার্শনিক অনুভূতিও রয়েছে কবিতায়। ‘ ভাঙিও না ভুল ’ কবিতাটি উল্লেখযোগ্য। —

‘ভাঙ্গিও না ভুল প্রভো । ভাঙ্গিও না ভুল,
এ ব্রহ্মাণ্ড রঙ্গভূমি,
এক অভিনেতা তুমি,
তবুও আমারি তুমি, শিখিয়াছ স্থূল,
ক্ষুদ্র বিশ্ব যায় যাক
এ প্রাণ তোমাতে থাক
ও চরণ বুকে থাক হয়ে বদ্ধ মূল,
জীবলীলা অবসানে
ওই প্রেম সিন্ধু পানে,
ছুটিবে জীবন গঙ্গা করি কূল কূল
ভুলে যদি থাকি প্রভো! ভাঙ্গিও না ভুল।’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

তাঁর কবিতায় এক অধরা মাধুরী আছে। পদ্ম আর সূর্যের ভালোবাসার কথা রয়েছে। যারা কেউ কাউকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না। আসলে নিজের জীবনে মৃত্যু দ্বারা খণ্ডিত প্রেমের কথা কবিতায় এ ভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।

মধুসূদন দত্তের বাড়ির মেয়ে ছিলেন মানকুমারী, মধুসূদনের ভাইঝি। নিজের কবিপ্রতিভার জোরে তিনি ব্রিটিশদের থেকে ভারত সরকারের বৃত্তি, ভুবনমোহিনী পদক, জগত্তারিণী পদক পেয়েছিলেন। মানকুমারী ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন কর্মী। পরিশ্রমী একজন লেখকও। ভৈরব নদীর তীরে তাঁর অন্তিম সংস্কার হয়।মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন ‘ অন্তিম’ নামে একটি সনেট। —

‘প্রিয় বঙ্গবাসী যদি ভালোবাসো মোরে,
ক্ষণেক দাঁড়ায়ে দেখো তটিনীর তীরে ।
স্নেহমতি মা জননী বসুমতী কোলে
বঙ্গের মহিলা কবি রয়েছে ঘুমায়ে।’


মানকুমারীর কবিতা ঘুমন্ত মনকে জাগিয়ে তোলে, আজও! বাঙালি লেখকদের মধ্যে মানকুমারী এক উল্লেখযোগ্য নাম।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content