গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।
মিনার্ভা থিয়েটারের ‘সিরাজদৌলা’ নাটকের আশাতীত অভিনয় সাফল্যের পর গিরিশচন্দ্র ঘোষ পুনরায় ‘মীর কাসিম’ ঐতিহাসিক নাটক লেখায় প্রবৃত্ত হলেন এবং তিনি সিরাজউদ্দৌলা, মির কাসিম, ছত্রপতি শিবাজি প্রভৃতি ঐতিহাসিক নাটক লিখে সত্যিকারের ঐতিহাসিক নাটককেই সমৃদ্ধ করে দিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসকে সত্যিকারের অক্ষুণ্ণ রেখে এই তিনটি নাটক রচনা তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা আজকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেই হয়। সিরাজউদ্দৌলা রচনা পর থেকেই স্বদেশি যুগের প্রবর্তন। সেই যুগে মীর কাসিম লিখিত হওয়ায় বহুল পরিমাণে স্বদেশি ভাব এ নাটকে প্রতিফলিত।
নাটকের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৯০৬ সালের ১৬ জুন মিনার্ভা থিয়েটারে। প্রথম রাত্রিতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (মীরজাফর), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (মিকা সিং), তারকনাথ পালিত (ইব্রাহিম)। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্র দুটি হল ওয়েল এবং মেজর অ্যাডামস। এ ছাড়া ছিলেন সুধীরা বালা (মণি বেগম), সুশীলা বালা (বেগম) হরিদাসী (তারা)। শিল্পীদের নাট্য প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে জুনিয়র শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিতেন অর্ধন্দুশেখর মুস্তাফি এবং বর্ষীয়ান শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিতেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। সংগীত শিক্ষক ছিলেন তারাপদ রায়।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৫: দুর্গেশনন্দিনী’তে গিরিশচন্দ্রের অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
সিরাজউদ্দৌলার মতো মীর কাসিম নাটকের অভিনয়ও সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছিল। এই দুটি নাটকই গিরিশচন্দ্রের শেষ জীবনের বিজয় বৈজয়ন্তী বলে আমরা অবশ্যই উল্লেখ করতে পারি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর নবাব মীর কাসিমের পতন এবং বঙ্গে ইংরেজরাজের প্রবল অভ্যুদয়ের ইতিহাস এই নাটক দুটিতে যেভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে, তা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। নাটকটি টানা সাত মাস ধরে প্রত্যেক শনিবার মিনার্ভা থিয়েটারের অভিনীত হয়েছিল এবং কারো কাছে এই নাটক পুরনো বলে মনে হয়নি। দর্শক সমাগমে সিরাজউদ্দৌলাকে অতিক্রম করেছিল মীরকাসিম নাটকটি। সে বছরে মিনার্ভা থিয়েটারের আয় লক্ষাধিক টাকা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা
অভিনেত্রীরা মঞ্চে অভিনয় করছেন বলে যে সমস্ত লোকেরা নাক সিঁটকোতেন এবং নাটক দেখতে যেতেন না, তাঁরাও কিন্তু আস্তে আস্তে (বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) এই দুটি নাটকের অভিনয় দেখার জন্য নিয়মিত মিনার্ভা থিয়েটারে পদার্পণ করতেন। ১৯১১ সালের ১৮ জানুয়ারি গভারমেন্ট কর্তৃক ‘মির কাসিম’ নাটকের অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ সরকারের মধ্যে মনে হয়েছিল যে এই নাটকের মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেম জেগে উঠছে এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে এই নাটকে।
দুটি বিখ্যাত দৈনিকে এই নাটকের প্রশংসা করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল বেঙ্গলি। “Babu Girish Chandra Ghosh’s new historical drama Mir Kasim which was put on the boards of the Minerva theatre for the first time on Saturday last, has been a phenomenal success both from the history and literary points of view.”
দুটি বিখ্যাত দৈনিকে এই নাটকের প্রশংসা করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল বেঙ্গলি। “Babu Girish Chandra Ghosh’s new historical drama Mir Kasim which was put on the boards of the Minerva theatre for the first time on Saturday last, has been a phenomenal success both from the history and literary points of view.”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ
বসুমতী পত্রিকার সাংবাদিক যা মন্তব্য করেছেন উল্লেখ করা যাক, “গিরিশবাবু তাঁহার পরিণত বয়সের সকল শক্তি ও আগ্রহ, তাঁহার অদম্য উৎসাহ ও অনন্য সাধারণ লিপিকুশলতার সহায়তায় এই নাটক খানিকে তাঁহার সক্রিয় কীর্তি স্তম্ভে পরিণত করিয়াছেন। গিরিশ বাবুর রচনা কৌশলে মুগ্ধ হইয়াছি, অভিনয়ের পারিপাট্যে পরিতৃপ্ত হইয়াছি।”—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।