শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ড. কালিপদ বিশ্বাস। সংগৃহীত।

শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন যা বর্তমানে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন’ হিসেবে বিখ্যাত, তার প্রাক্তন অধিকর্তা তথা ইংরেজ আমলে প্রথম ভারতীয় অধিকর্তা ছিলেন ড. কালিপদ বিশ্বাস। তিনি আপন কর্মদক্ষতায়, প্রতিভায় ও ব্যক্তিত্বে ভারতীয় বিজ্ঞানীমহলে আজও সমাদৃত। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর কলকাতার বিখ্যাত বিশ্বাস বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়।

পিতা সারদাপ্রসাদ বিশ্বাস ছিলেন এক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি এবং মাতা ছিলেন ধার্মিক ও কুসংস্কারমুক্ত এক মহিলা। ইংরেজ আমলে কলকাতার বেলতলায় তিনি বেড়ে ওঠেন এবং ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে পড়াশোনা করেন। ধীরে ধীরে তাঁর বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ হতে থাকে। তিনি ১৯২০ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক হন। পরে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে গোল্ড মেডেল লাভ করেন, সাল ১৯২২। তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত সব শিক্ষক এসপি আঘারকর, এসএন বল, এসসি ব্যানার্জি এবং জিসি বোস ইত্যাদির সান্নিধ্য লাভ করেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনি উদ্ভিদবিদ্যায় উৎসাহিত হতে থাকেন।
উচ্চতর গবেষণা এবং পড়াশোনার জন্য ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইউরোপ যাত্রা করেন এবং এডিনবার্গ এবং কেউ-এর রয়্যােল বোটানিক্যাল গার্ডেনে তিনি গবেষণা ও কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি লন্ডনে ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট’-এ যোগদান করেন এবং তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানকার ‘এলিয়ট স্বর্ণপদক ও পুরস্কার’ও লাভ করেছিলেন। এছাড়াও ‘রয়্যা৯ল বোটানিক্যাল গার্ডেন ও হারবেরিয়াম’-এ দুর্দান্ত কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘করোনেশন মেডেল’ লাভ করেন, সালটি ছিল ১৯৩৭। দীর্ঘদিন ধরে সিস্টেমেটিক্স বোটানির উপর কাজ করার ফলে, তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয় ‘পল জোহানেস ব্রিহল মেমোরিয়াল’ পদক। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ এবং বিজ্ঞানের উপর গবেষণার জন্য তিনি ১৯৫২ সালে রবীন্দ্র প্রাইজ লাভ করেন। জীবনের অন্তিমলগ্নে (১৯৬৯ সাল) তিনি পান বার্কলে মেমোরিয়াল মেডেল।
আরও পড়ুন:

গণিতজ্ঞ নিখিলরঞ্জন সেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৭: ওরাল হেলথ

কর্মপাগল এই মানুষটি শৈবাল বা অ্যালগি বিদ্যাতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী পল জোহানেস ব্রিহলের প্রভাব পড়ে বলে অনেকেই অনুমান করেন। তিনি সল্টলেক ও চিলকা হ্রদে বিভিন্ন শৈবাল নিয়ে নিরন্তন গবেষণা করে গিয়েছেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী বিশ্বাস ‘ক্যালকাটা রয়্যাৈল বোটানিক্যাল গার্ডেনের’ হারবেরিয়ামের কিউরেটর পদে নিযুক্ত হন। পরে ইউরোপ গমনের জন্য তিনি ওই কর্ম থেকে অব্যাহতি নেন। ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওই গার্ডেনের সুপারেন্টেন্ড পদে যোগদান করেন। তিনি কলকাতার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের এমিরেটাস সাইন্টিস্ট ছিলেন।

বিভিন্ন বিষয়ে ড. কেপি বিশ্বাস ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যেমন: তিনিই প্রথম ভারতীয় ডায়াটম ও লৌহ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তিনিই প্রথম ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে প্রচুর অপ্রতুল উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন, তিনিই প্রথম রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের ডাইরেক্টর হয়েছিলেন, যা পরাধীন ভারতীদের কাছে এটি ছিল একটি বিরাট সম্মানের বিষয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

সমগ্র ভারতে চষে ফেলে তিনি নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর, ওড়িশা, বিহার ও সিকিম এবং দক্ষিণ বার্মা থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন অসংখ্য বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা, যা বর্তমানে রক্ষিত আছে কলকাতার ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল হারবেরিয়াম’এর সংগ্রহশালায়। তিনি ত্রিপুরার বোটানিক্যাল অন্বেষণে অগ্রগামী ছিলেন। ড. বিশ্বাস ‘বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ‘কমন প্লান্টস অফ নর্দান সিকিম’(১৯৩৬); ‘কমন মেডিসিনাল প্লান্টস অফ দার্জিলিং অ্যান্ড দি সিকিম হিমালয়ান’(১৯৫৬); এবং ‘প্লান্টস অফ দার্জিলিং এন্ড সিকিম হিমালয়াজ’(১৯৬৬) নামে অমূল্য সব বই রচনা করেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

এছাড়াও তিনি অসংখ্য গবেষণাধর্মী পেপার প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের বোটানি বিভাগের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘মেডিকেল প্লান্টস স্কিম’ এর ডাইরেক্টর পদে আসীন হন, ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি ‘মেডিসিনাল প্ল্যাটন্টস কমিটি’র এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার ছিলেন। তিনি ‘সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান মেডিসিনাল প্ল্যালন্টস অর্গানাইজেশন এন্ড ন্যাশনাল বোটানিক গার্ডেন্স’ লখনউ এর ওই একই পদ অলংকার করেছিলেন তিনি। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল তিনি ‘ফিকাশ কৃষ্ণা’’কে বলেন ‘ফিকাশ বেঙ্গলেনসিস’ এর একটি মিউটেন্ট ভ্যারাইটি।

এ ভাবে ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যাকে সুউচ্চ স্তরে উন্নীত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি কেবলমাত্র ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র পৃথিবীতে বিজ্ঞানী মহলে এক সমাদৃত নাম। অথচ আত্মবিস্মৃত বাঙালি এই বিখ্যাত মানুষটিকে ভুলতে বসেছে, যা অত্যন্ত দুঃখের বিষয।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content