শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

সময়ের সঙ্গে কতই না পরিবর্তন দেখেছে আমাদের দেশ। ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে কত লড়াই, কত অগ্নিপরীক্ষার গল্প। সময় থেমে থাকে না। সময় ঠিক নদীর মতো বয়ে চলে। আর তারই হাত ধরে ধীরে ধীরে আসে পরিবর্তনও। দীর্ঘ দিন পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ থাকার পর ভারতও এক সময় স্বাধীন হল। কিন্তু সেই স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল বড়ই কঠিন। অসমের বরাক-ব্রহ্মপুত্রপাড়ের মানুষ দেখেছেন সেই লড়াই। ছোট-বড় সব বয়সের মানুষ দেশের জন্য নিজের প্রাণের বাজি রেখে এগিয়ে এসে বিপ্লবের অংশীদার হয়েছেন। ঘরে বসে নিজের ব্যক্তিগত ভবিষতের স্বপ্ন দেখেনি অল্প বয়সীরাও। বইখাতা একহাতে থাকলে অন্য হাতে ছিল দেশের পতাকা।

১৮২৬-এ ইয়ান্ডাবু সন্ধির পর ইংরেজরা মূলত নিজেদের সুবিধার জন্য অসমের প্রাথমিক শিক্ষা দিকে নজর দিতে শুরু করে। ডেভিড স্কট অসমে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং আন্দোলনের পর শিক্ষিত মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়ে উঠল। তাঁরা বুঝতে পারলেন দেশের জন্য কিছু করতে হলে দেশবাসীকে শিক্ষিত হতে হবে। ১৯২৬ সালে দেশীয় নেতাদের চাপে অসমে তৎকালীন ইংরেজ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে দিল। কিন্তু সেই সব বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই ছিলেন ইংরেজ। তাই স্কুলে ছাত্রদের যথেষ্ট সম্মান যেমন দেওয়া হত না, তেমনি তাদের স্বাধীনতাতেও স্কুল হস্তক্ষেপ করত।
১৯৩০ সালে কনিংহাম সাহেবের শিক্ষানীতি অসমের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক জোয়ার এনে দেয়। সমগ্র দেশে তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুন জ্বলছে। অসমের ছাত্ররাও সেই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কানিংহামের আইন অনুযায়ী, বিপ্লবী ছাত্ররা সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করতে পারবে না। সুতরাং শুরু হল স্বদেশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ। কিন্তু সহজেই তো কোনও কিছুই হয় না। যে কোনও বিপ্লবেরই পথ বড়ই বন্ধুর হয়। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বদেশি স্কুল চালু করা এবং ছাত্রদের ভবিষ্যৎ দৃঢ় করা এতো সহজ ছিল না। তবে এগিয়ে এলেন অনেক জননেতা, ছাত্রদের অবিভাবকরা।

ছাত্ররা নির্ভীকভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘বন্দেমাতরম’ গানটি গাইত। বড়পেটা, তেজপুর এবং অন্যান্য স্থানে ছাত্ররা স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের জন্য সাধরণ মানুষকে উৎসাহিত করতে লাগল। অসমের বিদ্যার্থীরা গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্রই স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। তাদের দেশভক্তির জোরে ইংরেজ সরকারও ভয় পেয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন অসমের সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক ভাবে আলোড়ন ফেলেছিল। মূলত ছাত্ররা এগিয়ে আসায় তাদের অবিভাবকরাও এগিয়ে এলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৫: স্বাধীনতা আন্দোলনে বরাকের পড়ুয়ারা

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৬: ত্রিপুরার উন্নয়নে বীরচন্দ্র বহুমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ করেছিলেন

এ দিকে কনিংহামের শিক্ষানীতির জন্য অনেক ছাত্রদেরই স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অসমের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধি সেই সময়ের এক বিশিষ্ট ছাত্র নেতা ছিলেন। সোনারাম হাই স্কুল, কটন কলেজ ইত্যাদিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ছাত্ররা ধর্না দিতে শুরু করল। তারা স্বাধীনতা আন্দোলনেও নেমে পড়ল। এ বার পরিবর্তন আসবেই। স্বাধীন দেশের আকাশে দেশের পতাকা উত্তোলন হবে এই স্বপ্ন ছিল প্রত্যেক ভারতবাসীর চোখে। গৌরীকান্ত তালুকদার ছাত্র জীবনেই স্বরাজের জন্য বিপ্লবে নেমে পড়েন। দেশের জন্য বহু বার কারাবরণ করেন। কানিংহামের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এ দিকে ইংরেজ সরকারের প্রধান সচিব কার্লি সাহেব আগেই জেলা শাসনাধিকারীকে গোপন নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশে বলা হয়েছিল, কোনও ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিলে তাকে যদি স্কুল কর্তৃপক্ষক শাস্তি না দেয়, সরকার সেই স্কুলের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবে। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ালেন অমিয়কুমার দাস, লক্ষ্মীধর শর্মা, চন্দ্রনাথ শর্মা, কামিনীকুমার চন্দ প্রমুখ। ১৯২০ সালে নাগপুরে হওয়া অল ইন্ডিয়া স্টুডেনস্ট সম্মিলনে আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে অসম থেকেও অনেক ছাত্র গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তারা আহযোগ আন্দোলনকে আরও দৃঢ় করতে সরকারী বিদ্যালয়গুলিতে যাওয়া বন্ধ করতে লাগল। অসম জুড়ে পড়ুয়াদের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছিল। শুরু হল স্বদেশি বিদ্যা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোড়জোড়। গুয়াহাটিতে কামরূপ অ্যাকাডেমি, শিবসাগরে শিবসাগর বিদ্যাপিঠ প্রতিষ্ঠিত হল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৮: অন্যরা যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন তখন পঞ্চমের হাত ধরলেন শক্তি সামন্ত

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই কামরূপ অ্যাকাডেমিতে পড়ানো শুরু হয়। প্রাথমিক ভাবে বাংলা এবং অসমীয়া দুই ভাষাতেই পাঠ দান শুরু হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে স্কুলে শরীরচর্চা এবং আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন শরীরচর্চা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ খুদু মোহন্ত। তবে এতো সহজে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার জন্য বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রথমত ইংরেজও সরকারের ভয়ে কেউ স্কুল কর্তৃপক্ষকে জমি কিংবা বাড়ি বিক্রি বা ভাড়া দিতে চাইছিল না। স্কুলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রায়বাহাদুর কালিচরণ সেনগুপ্ত এবং স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন গৌরীকান্ত তালুকদার।

রায়বহাদুর কালিচরণ পেশাগত ভাবে একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল ছিলেন। তিনি তাঁর এক ধনি মক্কেল রমেশ্বরূপ সিংকে রাজি করিয়েছিলেন তাঁর একটি বাড়ি স্কুলের জন্য ভাড়া দিতে। টোকোবাড়িতে অবস্থিত একটি দোতলা বাড়ি মাসিক তিরিশ টাকাতে ভাড়া দিতে রমেশ্বরূপবাবু রাজি হলেন। তবে তিনি শর্ত রাখলেন, যদি সরকার কোনও রকম হস্তক্ষেপ করে তা হলে রায়বহাদুর তাঁর হয়ে মামলা লড়বেন। দেশপ্রেমের এক নিদর্শন হয়ে উঠল এই কামরূপ অ্যাকাডেমি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

উল্লেখ্য, প্রথম বছর কামরূপ অ্যাকাডেমি কোনও রকম মান্যতা বা কোনও শিক্ষা পরিষদের অনুমোদন না পাওয়ায় বিদ্যর্থীরা মেট্রিক পরীক্ষার জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। সেই অনুরোধ তারা জানিয়েছিল, তাদেরকে যেন প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে মেট্রিক পরীক্ষা দেবার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সে বছর মোট ছয়জন ছাত্র সেই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি চেনিকুঠিতে স্থানান্তরিত হয়। নতুন বিদ্যালয়ে স্বদেশি ভাবনা যেন আরও মজবুত হয়ে উঠল। জ্ঞানন্দ চৌধুরী এবং গিরিশ মালি ছাত্রদেরকে হস্তশিল্প কলার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এমনকি এই স্কুলের ছাত্ররা বর্তমান বাংলাদেশের স্বদেশপুরে গিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে কাগজ তৈরি শিখে এসেছিল।

এই স্কুলে অনেক গুণী জনদের আগমন ঘটেছে। স্বাধীনতার পর একসময় অসমের মুখ্যমন্ত্রী হন শরৎচন্দ্র সিনহা। শরৎচন্দ্র সিনহা নিজে এই স্কুলে গিয়েছিলেন কাগজ বানানো শিখে ছাত্রদেরকে শেখানোর উদ্দেশ্যে। সেই সময় তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কামরূপ অ্যাকাডেমির ছাত্ররা নিয়ম করে প্রতি শনিবারে জেলে গিয়ে কারাবন্দি দেশভক্তদের সঙ্গে দেখা করত। কামরূপ অ্যাকাডেমি স্বদেশি আন্দোলনের এক পীঠস্থান হয়ে উঠল। ১৯৪৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৫জন ছাত্রদেরকে নিয়ে বি বড়ুয়া কলেজ প্রাথমিকভাবে এই একই পরিসরে শুরু হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ বড়দলৈ বি বড়ুয়া কলেজ কলেজ শুরু করেন। স্বরাজের জন্য আন্দোলনকারী ছাত্ররা নিজেদের বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে যাতে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে, সে কথা মাথায় রেখেই কলেজে শিক্ষদান রাতেই হত।

ছবি: সংগৃহীত।

শোণিতপুর জেলার তেজপুর শহরে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল। শোণিতপুর জেলার ছাত্ররা গ্রামে গঞ্জে গিয়ে গিয়ে স্বদেশি দ্রব্যের প্রচার করে। অহযোগ আন্দোলনে নেতাদের কারাবাস হওয়ায় অসমের ছাত্ররা যোগ দিয়েছিল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রভাতফেরি, মিছিল ইত্যাদির জন্য অনেক ছাত্রকে পুলিশ গেরফতার করল। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের উপর লাঠি চার্চও করা হল। লক্ষ্মীমপুরে ধর্না দেওয়ার জন্য তিলক দত্ত, লক্ষী শর্মা এবং আরও অনেক ছাত্রদেরকে পুলিশ অমানবিক ভাবে শাস্তি দিয়েছিল।

১৭ বছরের শহিদ কনকলতা অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। পুষ্প লতা দাসও ছাত্র জীবনেই স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অসমের ইতিহাসের পাতায় ছাত্রদের অবদান অপরিসীম। বিদ্যার্জন করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে শিক্ষকরাও প্ররোচনা দিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদ্যার্থিতের কথা তাই আজকের প্রজন্মকেও মনে রেখেই জীবন পথে এগোতে হবে। তাহলেই তো গড়ে উঠবে আমাদের পূর্বসূরিদের স্বপ্নের ভারত, আর আমারদেরকেও হতে হবে যোগ্য উত্তরসুরী।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content