শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


১৮৬০-৬১ সালের কুকি আক্রমণেও ঈশানচন্দ্র এক চরম সংকটে পড়েছিলেন। ত্রিপুরা ও সংলগ্ন ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে একের পর এক কুকি আক্রমণ ঘটতে থাকলে রাজার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে যে, রাজা সীমান্ত সুরক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় বারবার কুকি আক্রমণ ঘটছে। এমন কথাও শোনা যায় যে, বারবার কুকি আক্রমণ ঘটতে থাকলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য ত্রিপুরাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের খাস এলাকাভুক্ত করতে বাধ্য হবে। কুকি তাণ্ডবের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য ত্রিপুরার জন্য একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত করে। তাঁর প্রধান কাজ ছিল সীমান্ত সন্নিহিত এলাকায় কুকি হামলা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে অবহিত করা।

১৯৬১ সালে উদয়পুরে ভয়াবহ কুকি আক্রমণ ঘটে। বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় তারা। নিহত হয় ১৫০ জন। এ ছাড়াও ২০০ লোককে কুকিরা ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার পর রাজা আগরতলা থেকে সৈন্য পাঠান। কুমিল্লা থেকে ব্রিটিশ ফৌজও আসে। পলায়মান কুকিদের সঙ্গে ব্রিটিশ ফৌজের খন্ডযুদ্ধে কিছু কুকি নিহত হয়। বাকিরা আশ্রয় নেয় গভীর অরণ্যে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ঈশানচন্দ্রের মৃত্যু ঘটে। এরপর একটি বিতর্কিত রোবকারি মূলে রাজ্যভার গ্ৰহণ করেন প্রয়াত রাজার ভাই বীরচন্দ্র। এ নিয়ে অবশ্য মামলা মোকদ্দমা কম হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত জয়লাভ করেন বীরচন্দ্র।
১৮৬২ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত বীরচন্দ্র মাণিক্যের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে ত্রিপুরা আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু করে। তাঁর রাজত্বকালে ঘটনার নানা ঘনঘটা। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে রাজপরিবারে দ্বন্দ্ব, মামলা মোকদ্দমা, কুকি তাণ্ডব, জমাতিয়া বিদ্রোহ, সর্বোপরি ছিল ইংরেজদের প্রবল চাপ তথা রাজার ক্ষমতা খর্ব করার সার্বিক চেষ্টা। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আগরতলায় ইংরেজ পলিটিকাল এজেন্ট নিযুক্ত হন এবি পাওয়ার সাহেব। এতে রাজার অধিকার খর্ব হয়েছিল। ১৮৭১ সালে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ কুকিদের বিরুদ্ধে এক বিরাট অভিযান চালিয়েছিল ত্রিপুরার পূর্ব প্রান্তে। বীরচন্দ্র অবশ্য এই অভিযানে ইংরেজদের নানা ভাবে সাহায্যও করেছিলেন। কিন্তু সে সময়েই ত্রিপুরার পূর্ব প্রান্তের এক বিরাট এলাকা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘোষণার মাধ্যমে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। লঙ্গাই নদী থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত ত্রিপুরার প্রায় ৮৫০ বর্গ মাইল এলাকা তখন ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হয়েছিল।

কুকিদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভাবে অভিযান চালানোর জন্য উল্লিখিত এলাকাকে ব্রিটিশরা সাময়িক ভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। কিন্তু অভিযান শেষেও তা আর রাজাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। সতীদাহ ও ক্রীতদাস প্রথা রদ করেছিলেন বীরচন্দ্র। রাজ্যের উন্নয়নেও বহুমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ করেছিলেন তিনি। সাহিত্য সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী ছিলেন এই রাজা। ভারতের তদানীন্তন সময়ের গুণী শিল্পীরা বীরচন্দ্রের দরবার আলোকিত করেছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন সে যুগের এক সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি। তাঁর ছয়টি কাব্যগ্ৰন্থ লেখার কথা জানা যায়। কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম এই রাজাই অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ভারতে ফটোগ্রাফি চর্চারও অগ্ৰদূত হলেন ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

পিতা বীরচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৮৯৬ সালে রাজ্যভার গ্রহণ করেন পুত্র রাধাকিশোর। রাজ্যাভিষেকের কিছু দিনের মধ্যেই এক বিরাট ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয় রাজপ্রাসাদ সহ রাজধানীর প্রায় সব অট্টালিকা। স্বাভাবিক ভাবেই রাজধানী পুনর্গঠনের বিষয়টি রাজার কাছে অগ্ৰাধিকার পায়। তখনই গড়ে উঠে আগরতলার উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ। রাজ্যের আয় বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাসের বিষয়ে কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেন রাজা। তিনি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি রূপায়ণ করেন তাঁর রাজ্যে। প্রবর্তন করেন ডাক ও তার যোগাযোগ ব্যবস্থার। শিক্ষা, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে নানা কর্মসূচি রূপায়িত হয় তাঁর আমলে।

খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত হয় ভূতাত্ত্বিক বিভাগ। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাধাকিশোর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তাঁর আমন্ত্রণেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম আগরতলা সফরে আসেন। বঙ্গদেশের তদানীন্তন কালের অনেক পণ্ডিত ব্যাক্তি, সাহিত্যিক রাজার উদার সহায়তা পেয়েছেন। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন, চিত্রশিল্পী শশীকুমার, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে রাজা আর্থিক সহায়তা করেছেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৭: সাধারণের প্রতি পাণ্ডবদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ কোন মহাভারতীয় শিক্ষা?

জগদীশচন্দ্রকে গবেষণা চালিয়ে যাবার জন্যও তিনি অর্থ সাহায্য করেছেন। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই রাজা বার্ষিক অর্থসাহায্য মঞ্জুর করেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজার সখ্যতা, কবির মাধ্যমে বঙ্গদেশের গুণীজনদের সঙ্গে যোগাযোগ, সাহিত্য সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এক বিশেষ স্থান লাভ করেছিল ত্রিপুরার মাণিক্য রাজপরিবার। ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে কাশী থেকে সারনাথ যাবার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় রাধাকিশোরের মৃত্যু ঘটে।

পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন পুত্র বীরেন্দ্র কিশোর। উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক পরিকাঠামো সুদৃঢ় করেছিলেন। রাজ্য প্রশাসনে যাতে দক্ষ আধিকারিক নিযুক্ত হতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে বীরেন্দ্র কিশোর স্টেট সিভিল সার্ভিস গঠন করেন। রাজার বিভিন্ন উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে ত্রিপুরায় হস্ততাঁত ও হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটে। বনকে সম্পূর্ণ খাস ব্যবস্থায় আনার ফলে তখন ত্রিপুরার আয় বৃদ্ধি ঘটে। তাঁর রাজত্বকালে (১৯০৯-২৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজ্যে চা শিল্পের সূত্রপাত ঘটে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া

বর্তমানে ত্রিপুরায় ৫৪টি চা বাগান রয়েছে। এর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছিল বীরেন্দ্রকিশোরের সময়কালে। রাজ্যে রাস্তা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করিয়েছিলেন এই রাজা। তিনি রাজ্যে ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষারও উদ্যোগ নেন। ত্রিপুরায় খনিজ তেলের অনুসন্ধান চালানোর উদ্দেশ্যে বার্মা ওয়েল কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া হয় বীরেন্দ্র কিশোরের আমলে। ইংরেজদের সঙ্গে বীরেন্দ্র কিশোর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাজা যুদ্ধ তহবিলে এক লক্ষ টাকা দান করেন এবং সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেন।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এক আদেশ বলে ‘পার্বত্য ত্রিপুরা’র পরিবর্তে শুধু ‘ত্রিপুরা’ ব্যবহারের অনুমতি দেয়।বীরেন্দ্র কিশোরের আমলে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা নিকট অতীতের তুলনায় ভালো ছিল। রাজ্যের আয়ের বহর বেড়েছিল। আগরতলায় লক্ষ্ণীনারায়ণ বাড়ি, দুর্গাবাড়ি ইত্যাদির পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে শিব মন্দির, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ধর্মশালা নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা। আগরতলায় সুদৃশ্য পুষ্পবন্ত প্রাসাদটিও তৈরি করান তিনি।

বীরচন্দ্রের সময়ে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিল, পৌত্র বীরেন্দ্র কিশোরের আমলেও তা অব্যাহত ছিল। বীরেন্দ্র কিশোরের ব্যবস্থাপনায় ত্রিপুরা থেকে শান্তিনিকেতনের জন্য মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় যুক্ত হয়েছিল মণিপুরী নৃত্য ধারা। বীরেন্দ্র কিশোর একজন উঁচু মাপের চিত্রশিল্পীও ছিলেন।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content