রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


কলকাতায় বৃষ্টি

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দোল যাত্রার আরম্ভ হয় সূর্যের উত্তরায়ণের সময় বসন্ত ঋতুর আগমন থেকে। চন্দ্র যখন ফাল্গুনী নক্ষত্রের পাশ দিয়ে যায় তখনই উত্তরায়ণ শুরু হয়। এই সময় বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটে। মানুষ তখন শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়। প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের মনও তখন আনন্দিত হয়ে থাকে। এই সময় মানুষ নানা উৎসবে মেতে ওঠে।

বসন্তের আগমনে দেশের নানা জায়গায় মানুষের মধ্যে যে উৎসব পালিত হয় সেটাই কালক্রমে দোল উৎসব নামে পরিচিত। উত্তর ভারতের লোকেরা অবশ্য এই দোলকে হোলি বলে থাকেন। কিন্তু বাংলা এবং ওড়িশায় এটি দোলযাত্রা নামে পরিচিত।
এই দোলযাত্রাকে নিয়ে অনেক পুরাকাহিনি কথিত আছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল, দৈত্য রাজ হিরণ্যকশিপু বোন হোলিকা রাক্ষসীকে তাঁর পুত্র নারায়ণ ভক্ত প্রহ্লাদকে বধ করবার জন্য আদেশ দেন। হোলিকা দাদার আদেশ পেয়ে এক বিরাট আগুন জেলে তার মধ্যে প্রহ্লাদকে ফেলে দেয়। কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পেয়ে যান এবং হোলিকা নিজেই সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই হোলিকার রাক্ষসীর নাম থেকেই হোলি নামের উৎপত্তি হয়েছে।
সেকালের কলকাতায় দোল উৎসব প্রায় বড়সড় উৎসবের আকার ধারণ করেছিল। তখনকার লোকেরা কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গেলেই বলতেন, ওদের বাড়ি দোল দুর্গোৎসব হয়। অর্থাৎ দোল সেকালের কলকাতায় দুর্গোৎসবের মতোই বড় একটা উৎসব ছিল।
আরও পড়ুন:

দেশের ও দশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সুভাষ

দশভুজা, অন্য লড়াই: এই স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করিনি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৭ সাল থেকে দোলে পাঁচ-পাঁচটি দিন ছুটি দিত। পুরনো কলকাতার এই পাঁচটি দিন নানা উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাটতো। সেই সময় দোল উপলক্ষে সঙও বের হতো। মহিলা এবং পুরুষেরা যাকে সামনে পেতো তারই গায়ে রং দিয়ে দিত। এমন কেউ ছিলেন না যার গায়ের কাপড় রং ছাড়া থাকতো এই ক’দিন। মোটকথা বলা যায়, এই সময় মানুষ খুব আমদ করতেন। সেকালে জার্মান থেকে আসত নানা রং। দামও ছিল অনেকটা সস্তা। তাই আমজনতা সহজেই কিনতে পারতেন এই রং। গোলাপি-সবুজ-গাঢ় নীল ইত্যাদি নানা রং সেই সময় পাওয়া গেলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু লাল রংটিই পছন্দ করত বেশি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

দোল খেলার পর পথঘাট লাল হয়ে থাকত বেশ অনেকদিন পর্যন্ত। দিনের বেলা রং-পিচকিরি নিয়ে মাতামাতি চললেও বিকেলে, রাতে কখনও বা পরের দিন শুধুই আবির দেওয়া হতো। পিচকিরি টিন-বাঁশ-পিতল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হতো। ধনী-অভিজাত বাড়ির দোলখেলায় পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতিতে রং, কিংবা সুগন্ধি আবির, পিতল বা কাঁসার রেকাবিতে অভ্র ও ফুলের পাপড়ি ছড়ানো আবির ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাঁশ-টিনের পিচকিরি ব্যবহার করতেন যার দাম ছিল তুলনায় অনেক কমও। দু’পয়সা থেকে দু’আনার মধ্যে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

অন্যদিকে পিতলের পিচকিরি পাওয়া যেত ছ’আনা থেকে দশ আনার মধ্যে। এই দিন অবস্থাপন্ন মানুষজন বাড়িতে দোল খেলার জন্য বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করত। সেই দিন রঙের উৎসবে আনন্দের পাশাপাশি থাকতো এলাহি ভোজের আয়োজন। বিকেলে আবার চলতো আবির খেলা। ছোটরা বড়দের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করত। সন্ধ্যায় ঘরোয়া গানের আসর যেমন থাকত, তেমন কেউ কেউ ওস্তাদ গাইয়ে-বাজিয়েদেরও আমন্ত্রণ জানাতেন বাড়িতে। নিধুবাবুর টপ্পা, যদু ভট্টের গান ছিল অন্যতম। বাঈজি নাচও হতো কোনও কোনও বড়লোকদের বাড়িতে।

তবে বৈষ্ণবরা আয়োজন করতেন কীর্তন গানের। এছাড়া কবিগান, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াই গানেরও ব্যবস্থা হতো। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দোললীলা, বসন্তলীলা প্রহ্লাদচরিত, কংসবধ বিষয়ক নাটকও অভিনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে সেকালের দোলের উৎসব ছিল রঙিন এবং বর্ণাঢ্য।

Skip to content