বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।

১৬০১ থেকে ১৬২৩ খ্রিস্টব্দ যশোধর মাণিক্যের রাজত্বকাল। তাঁর রাজত্বকালে ত্রিপুরায় মোগল আক্রমণ ঘটেছিল। মোগল সম্রাট তখন জাহাঙ্গীর। রাজার হস্তী সম্পদের উপর লোভ হল মোগলদের। সম্রাটকে কর হিসেবে ত্রিপুরার রাজার কাছে কয়েকটি হাতি ও ঘোড়া চাওয়া হল। কিন্তু স্বাধীনচেতা রাজা তা দিতে অস্বীকার করেন। তখন বাংলার সুবাদার ইব্রাহিম খাঁ ফতেজঙ্গকে সম্রাট ত্রিপুরা আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। শুরু হল মোগলদের ত্রিপুরা আক্রমণের বিরাট প্রস্তুতি। মোগল স্হল বাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করে উদয়পুরের দিকে পাঠানো হল।

একজন দক্ষ নৌ সেনাপতির নেতৃত্বে কুমিল্লা হয়ে গোমতী নদীপথে পাঠানো হল এক বিরাট নৌ বাহিনী। যথাসাধ্য প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন যশোধর। ত্রিপুরার সৈন্যগণ প্রাণপণে লড়ে গেলেও বিশাল মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতে পারল না। যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটল ত্রিপুরার। ঐতিহাসিকগণ অবশ্য এর কারণ হিসেবে মোগলদের উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের সুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন। ত্রিপুরার বাহিনীতে তখন বন্দুক গোলাবারুদের ব্যবহার শুরু হলেও মোগলগণ এ ব্যাপারে অনেক দক্ষ ছিল এবং তাদের অস্ত্রও অনেক উন্নত ছিল। তদানীন্তন মোগল সেনাপতি মির্জানাথন-এর স্মৃতিকথা ‘বহরিস্তান-ই-ঘায়েবি’ গ্রন্থ ত্রিপুরার এই যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।

‘বহরিস্তান-ই-ঘায়েবি’ গ্রন্থ উল্লেখ রয়েছে: “…One regiment, consisting of more than two thousand and seven hundred cavalry, four thousand match-lock men and twenty famous elephants was sent under the command of Mirza Isfandiyar…A fleet of three hundred war boats with large equipments of war was sent under the command of Admiral Bahadur Khan,an officer of the Khan Fathe Jung…”।

মোগলরা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে খবর পেয়ে রাজা পরিবার পরিজন-সহ গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন। অনেক প্রজাও রাজধানী ছেড়ে চলে গেলেন। মোগলরা উদয়পুর প্রবেশ করে যথেচ্ছ লুটপাট শুরু করল। রাজভান্ডার, মন্দির, রাজবাড়ি-সহ ধনী প্রজাদের ঘরবাড়ি নির্বচারে লুন্ঠিত হল। হত্যা করা হল বহু নিরীহ মানুষকে। রাজার হাতিশালার সব হাতিও নিয়ে গেল মোগলরা। রাজধানী যেন এক মৃত নগরীতে পর্যবসিত হল। তবে অরণ্যে পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পেলেন না যশোধর মাণিক্য। মোগলদের হাতে রানি-সহ ধরা পড়লেন তিনি। রাজাকে বন্দি করে ঢাকা হয়ে নিয়ে যাওয়া হল জাহাঙ্গীরের দরবারে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর অবশ্য হাতি আর ধনরত্নের বিনিময়ে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যশোধরকে। কিন্তু রাজা বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। বৃন্দাবনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একদিন রাজার মৃত্যু ঘটে। মোগল বাহিনী অবশ্য দীর্ঘদিন উদয়পুরে অবস্থান করেনি। আড়াই বছর পর ব্যাপক মহামারীর প্রাদুর্ভাবে মোগলরা উদয়পুর পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মেহেরকুল অর্থাৎ কুমিল্লায় আশ্রয় নিয়ে অবশ্য তারা সমতল ত্রিপুরায় অধিকার কায়েম রাখে। মোগল রাজস্ব খাতায় তাদের অধিকৃত সমতল অঞ্চল ‘সরকার উদয়পুর’ হিসেবে লেখা হয়।

১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন কল্যাণ মাণিক্য। রাজ্যভার গ্রহণের পর তিনি রাজধানী পুনর্গঠন সহ শাসনব্যবস্থার সংস্কার কাজ শুরু করেন। উদয়পুরে অবস্থান কালে মোগল সৈন্যরা ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। বিভিন্ন জলাশয়ও তারা নষ্ট করে দিয়েছিল। কল্যাণ মাণিক্য সে সবের সংস্কার করেন। তিনি স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে চতুর্দশ দেবতার মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের পূর্ব দিকে একটি সরোবর খনন করিয়েছিলেন তিনি, যা কল্যাণ সাগর নামে পরিচিত। উদয়পুর অভিযান কালে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়াটি ভেঙে দিয়েছিল। রাজা তারও সংস্কার করেন। কল্যাণ মাণিক্যের রাজত্বকালেও মোগলরা হাতির লোভে ত্রিপুরা আক্রমণ করে। বঙ্গদেশের শাসনকর্তা তখন সুলতান সুজা। ত্রিপুরার বাহিনী প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করে মোগলদের। যুদ্ধে জয়ী হয় ত্রিপুরা। বীর নৃপতি কল্যাণ মাণিক্য মোগলদের হাত থেকে ত্রিপুরার কিছু কিছু হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

কল্যাণ মাণিক্যের সময়কালে ইউরোপীয় পর্যটক পিটার হেলস ভারত সফর করেন। তিনি লিখে গেছেন ত্রিপুরার সঙ্গে মোগলদের অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত।ত্রিপুরার পাহাড় পর্বতের জন্য মোগলদের প্রতিরোধ সম্ভব হতো। রাজত্বের শেষ দিকে কল্যাণ মাণিক্য মোগলদের কাছে কিছুটা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন বলেও ঐতিহাসিকরা ইঙ্গিত করেছেন। কৈলারগড়ে সুউচ্চ ভূমিতে শুরু করেছিলেন মন্দির নির্মাণ। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তর নির্মিত সিংহবাহিনী মহিষাসুর মর্দ্দিনী দশভূজা বিগ্ৰহ। ত্রিপুরায় নগরায়নের কাজও শুরু করেছিলেন এই রাজা। ধারণা করা হয় এই ভাবেই পত্তন হয়েছিল আজকের কল্যাণপুরের।ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে কল্যাণ মাণিক্যই প্রথম বাংলা ভাষায় তাম্রশাসন প্রদান করেছিলেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরার সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন গোবিন্দ মাণিক্য। কিন্তু সে সময় ত্রিপুরার রাজপরিবারে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছিল। রাজ্যাভিষেকের পর থেকেই গোবিন্দ মাণিক্যের সঙ্গে বৈমাত্রেয় ছোট ভাই নক্ষত্র রায়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে। রাজপরিবারে এ নিয়ে অশান্তি শুরু হয়। এমনকি নক্ষত্র রায় বাংলার শাসনকর্তা সুজার সহযোগিতায় সিংহাসন অধিকারেরও চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রাজা গোবিন্দ মাণিক্য ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ এড়াতে স্বেচ্ছায় রাজধানী ছেড়ে চলে যান রাজ্যের অরণ্যাঞ্চলে। সেই সময়ে মোগল সম্রাটের পুত্রদের মধ্যেও চলছিল ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। ঔরঙ্গজেবের ভয়ে বাংলার শাসনকর্তা সুজা পালিয়ে এসেছিলেন ত্রিপুরার দিকে। ঔরঙ্গজেব সুজাকে ধরে তাঁর হাতে তুলে দেবার জন্য ত্রিপুরার রাজাকে হুমকি দিয়ে এক পত্র পাঠিয়েছিলেন।

ঔরঙ্গজেব লিখেছিলেন—”…আমি সুনিশ্চিত রূপে অবগত হইয়াছি যে, আমার চিরশত্রু সুজা ভবদীয় রাজ্যে গোপনে অবস্থান করিতেছে। মদীয় পূর্ব্ব পুরুষের সম্মানিত মহোদয়গণের সহিত আপনার গৌরবান্বিত পূর্ব্ব পুরুষগণের পরষ্পর আত্মীয়তা ও প্রণয় থাকা বশত আমাদিগের সহিত বিবাদে লিপ্ত দুর্ভাগ্য আফগানেরা ভবদীয় রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলে আপনার মহামান্য পূর্বপুরুষগণ অসি প্রহারে যে রূপ সেই দুষ্ট আফগান দিগকে বঙ্গদেশে বিতাড়িত করিতেন, আমিও তদ্রূপ আশা করি- আমার লিখানুসারে আপনি উক্ত শত্রু (সুজা)কে ধৃত করিয়া সত্ত্বর আমার নিকট প্রেরণ করেন। যদি আপনার অভিমত হয়, তবে আমার সেনাপতিকে মুঙ্গেরে অপেক্ষা করাইব। তাহাকে ধৃত করিবার পর আপনার সেনাপতির রক্ষণাবেক্ষণে সাবধানে প্রেরণ করিয়া বাধিত করিবেন-যেন প্রাচীন বন্ধুতা স্থায়ী রহে। নতুবা ইহা নিশ্চয় জানিবেন-আপনার রাজ্যে উক্ত অপরিণামদর্শির অবস্থান করার জন্য ভবিষ্যতে আমাদিগের পরষ্পর মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্য সংঘটিত হইবে। আমার লিপি অনুসারে কার্য্য হইবে বলিয়া আমি সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করি।”

কিন্তু তখন গোবিন্দ মাণিক্য সিংহাসনচ্যুত। রাজা তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ছত্র মাণিক্য। ভাগ্য বিড়ম্বিত সুজাও আশ্রয় নিয়েছেন আরাকানে। অবশ্য রাজ্যচ্যুত গোবিন্দ মাণিক্যের সঙ্গে সুজার সাক্ষাতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন তথ্যে। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সেই সময়কার ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বিসর্জন-এ অমর হয়ে আছেন ঋষিতুল্য রাজা গোবিন্দ মাণিক্য। ছত্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর আবার সিংহাসনে বসেন গোবিন্দ মাণিক্য। দ্বিতীয় বারের রাজত্বকালে তিনি প্রজাকল্যাণে নানা কর্মসূচি রূপায়ণ করেন। সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল এই রাজা সাহিত্য সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি রাজ্যে নরবলির প্রথা রদ করেছিলেন। তাঁর মহারানি গুণবতী দেবী ছিলেন এক মহিয়সী নারী। একবার রিয়াং বিদ্রোহী প্রজাদের মৃত্যু দণ্ডাদেশ রদ করে বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৩: বিপর্যয়ের দিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ

দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৭১৪-২৯ খ্রিস্টাব্দ) ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ সমতল এলাকায় মোগল আধিপত্য স্হায়ী রূপ নেয়। দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্য রাজ্যভার গ্ৰহণ করে মোগলদের হস্তিকর দেওয়া বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসা এই হস্তিকর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মোগল শাসক ত্রিপুরার রাজার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। বাংলার নবাব ত্রিপুরার বিরুদ্ধে এক বিরাট সৈন্য বাহিনী পাঠান। যুদ্ধে পরাজিত হন ধর্ম মাণিক্য। ত্রিপুরার সমতল অঞ্চল অধিকার করে নবাব সেখানে মোগল জমিদার নিয়োগ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর ধর্ম মাণিক্য পাল্টা আক্রমণ করে বেশিরভাগ জমিদারকে বিতারণ করেন। এই ঘটনার পর নবাব ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে সন্ধি করেন। কিন্তু ত্রিপুরার রাজপরিবারে আবার ষড়যন্ত্র প্রবল হয়ে উঠে। নক্ষত্র রায়ের বংশের জগৎ রায় সিংহাসন দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে তিনি বলদাখালের জমিদার আকা সাদিকের শরণাপন্ন হন। আকা সাদিক তখন যোগাযোগ করেন ঢাকা নেয়াবতের দেওয়ান মীর হাবিবের সঙ্গে। দেওয়ানকে তিনি ত্রিপুরা আক্রমণে প্ররোচিত করেন।

ত্রিপুরা বিজয়ের সম্ভাবনা দেখে মীর হাবিব নবাবের অনুমতিক্রমে এক বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। মোগলরা ঢাকা, জয়ন্তিয়া ও চট্টগ্রাম এই তিন দিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালায়। জগৎরায় তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। ত্রিপুরা বিজয়ের পর মোগলরা জগৎরায়কে সিংহাসনে বসায়। শর্ত থাকে নবাবকে নিয়মিত রাজস্ব দিতে হবে। নতুন রাজার নাম হয় জগৎ মাণিক্য। ঐতিহাসিকদের মতে ত্রিপুরার শুধু সমতল এলাকাই তাঁর অধীনে এসেছিল। নবাব সুজাউদ্দিন অধিকৃত ত্রিপুরার সমতল অঞ্চলের নাম রাখেন রোশনাবাদ। পরবর্তী সময়ে তা চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, অন্য লড়াই: এই স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করিনি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

এদিকে সিংহাসনচ্যুত রাজা ধর্ম মাণিক্য পালিয়ে গিয়ে বনপাহাড়ে ঘুরতে থাকেন। তিনি একসময় মুর্শিদাবাদ গিয়ে জগৎ শেঠের মাধ্যমে নবাবের উপর প্রভাব বিস্তার করেন। নবাব অবশ্য বার্ষিক করের বিনিময়ে ধর্ম মাণিক্যকে জমিদারী হিসেবে অর্পণ করেন চাকলা রোশনাবাদ এলাকা। এ বিষয়ে স্টুয়ার্ট তাঁর বাংলার ইতিহাসে লিখেছেন যে, স্মরণাতীত কাল থেকে যে ত্রিপুরা স্বাধীন ছিল তা মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। এই ভাবে সমতল অঞ্চলের জন্য ত্রিপুরার রাজা বাংলার নবাবের অধীনস্থ এক জমিদারে পর্যবসিত হলেন। মোগলদের পর এই ধারা অব্যাহত থাকে ইংরেজ আমলেও। ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের স্বাধীনতা অবশ্য অক্ষুণ্ণ ছিল।

একসময় ত্রিপুরার সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছিলেন সমসের গাজি। ত্রিপুরার রাজনৈতিক মঞ্চে তাঁর অভ্যুদয় স্হানীয় ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য উপাদান। একজন সাধারণ প্রজা থেকে নিজের বুদ্ধি আর বাহুবলে রাজা হয়ে উঠেছিলেন সমসের। প্রথমে দক্ষিণ শিক গ্রামের জমিদার, তারপর মেহেরকুল পরগণা ইজারা নেওয়া এবং শেষে ত্রিপুরার রাজা দ্বিতীয় বিজয় মাণিক্যের মৃত্যুর পর নিজেকে চাকলা রোশনাবাদের অধিপতি ঘোষণা করেন সমসের। ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায়ে ব্যর্থ হয়ে সমসের এক নতুন কৌশল নেন। প্রজাগণ রাজবংশের বাইরে কাউকে কর দেবে না। সমসের তখন রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত বনমালী ঠাকুরকে লক্ষ্মণ মাণিক্য আখ্যা দিয়ে নতুন তৈরি করা এক সিংহাসনে তাকে বসান। কার্যত সমসেরের পুতুল রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ মাণিক্য। কিন্তু এতসব করেও রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলের সব প্রজার কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা সমসেরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সমসের তাঁর অধীন সমতল ত্রিপুরার প্রত্যেক পরগণায় একজন করে শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন।

১৭৫১ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ দশ বছর তিনি চাকলা রোশনাবাদ সহ ত্রিপুরার কর্তৃত্ব করেছেন। কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ লোভ এবং অর্থের জন্য মানুষের উপর অত্যাচারের ঘটনা সমসেরের বিপদ ডেকে আনে। ত্রিপুরা, নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জমিদারদের বাড়িতে সমসেরের বাহিনি প্রায়শ হানা দিয়ে অর্থ সম্পদ লুট করতো। এসব কারণে মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারেও সমসেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ যায়। প্রজাগণও তখন চাইছিলেন সমসেররাজের অবসান ঘটুক এবং সিংহাসনে অভিষেক হোক মাণিক্য রাজবংশের যুবরাজ কৃষ্ণমণির। নবাব মীর কাশিম কৃষ্ণমণিকে ত্রিপুরার রাজা হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং সেইসঙ্গে সমসেরকে বন্দী করার জন্য সৈন্য পাঠালেন।শেষপর্যন্ত অবশ্য সমসেরকে কামানের মুখে বেঁধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content