বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাট্যরূপ ইতিপূর্বেই বাঙালি দর্শকরা দেখেছিলেন বেঙ্গল থিয়েটারে, যা অভিনীত হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২০ ডিসেম্বর। বেঙ্গল থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী শরৎচন্দ্র ঘোষ মশাই জগৎ সিংহের ভূমিকায় অভিনয়ের সময় ঘোড়ায় চড়ে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে দর্শকদের চমকৃত করে দিয়েছিলেন। খুব জমেছিল এবং দর্শক সমাগমও যথেষ্ট হয়েছিল। এর বহুদিন বাদে ১৯০৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গিরিশচন্দ্র ঘোষের নতুন ব্যবস্থাপনায় মিনার্ভা থিয়েটারে দর্শকরা দেখলেন ‘দুর্গেশনন্দিনী’। বেঙ্গল থিয়েটারের দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপের পান্ডুলিপি না পাওয়ার জন্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ পুনরায় উপন্যাসটিকে নাট্যাকারে গঠিত করেন এবং আবশ্যিক মতো কয়েকটি নতুন দৃশ্য এখানে সংযোজন করেছিলেন। সেই সঙ্গে কয়েকটি গানও লিখেছিলেন।
প্রথম অভিনয় রজনীতে যেসব শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (বীরেন্দ্র সিংহ), অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি (বিদ্যাদিকগজ), তারকনাথ পালিত (জগৎ সিংহ), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ ওরফে দানি বাবু (ওসমান), মনীন্দ্রনাথ মণ্ডল (কতলু খাঁ), নীলমাধব চক্রবর্তী (অভিরাম স্বামী), প্রকাশমনি (তিলোত্তমা), তিনকড়ি দাসী (বিমলা), তারা সুন্দরী (আয়েশা) চপলা সুন্দরী (আশমানী)।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৪: গিরিশচন্দ্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক নাট্য জগতে যুগপ্রবর্তন করেছিল
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরার সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম
গিরিশচন্দ্র যেমন নিপুণতার সঙ্গে দুর্গেশ নন্দিনীর চরিত্রগুলি নাটক রচনায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন এবং স্বনামধন্য অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেভাবে অভিনয় করেছিলেন, তার ফলেই নাটকটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট হয়েছিল। বীরেন্দ্র সিংহের ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র যে অভিনয় দেখিয়েছেন, তা দর্শকরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিও আসল কি নকল বিদ্যাদিকগজ অভিনয়ে তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এত অসাধারণ অভিনয়ে তিনি করেছিলেন।। বঙ্কিমচন্দ্র বিমলা চরিত্র যেমন ভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন তিনকড়ি দাসীর অভিনয়ে সেই ছবিটাই ফুটে উঠে স্পষ্ট করে। জগত সিংহ, অভিরাম স্বামী, তিলোত্তমা ও আশমানীর ভূমিকাগুলিতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সর্বাপেক্ষা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আয়েশা চরিত্রের শিল্পী তারাসুন্দরী।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী
নাটক দেখতে প্রভূত আশাতীত দর্শক সমাগম হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র নাট্যকারে গঠিত এই ‘দুর্গেশনন্দিনী’ সকল থিয়েটারেই অভিনীত হয়েছিল। অসাধারণ গানও লিখেছিলেন গিরিশচন্দ্র। জগৎ সিং-এর উদ্দেশ্যে আয়েশা একটি অসাধারণ গান গেয়েছিলেন:
“যার ছবি দিবা নিশি যতনে হৃদয়ের রাখো, আপন ভুলিয়া মন তার সুখে সুখী থাকো।
করিয়াছ প্রেমদান চাইনি তো প্রতিদান,
তবে কেন হীনপ্রাণ, শুনিলে নয়ন ঢাকো।
দেখিতে সে মুখে হাসি, সতত তুমি প্রয়াসী,
হয়ে তারি অভিলাষী সাধে বাদ সেধোনাকো”
করিয়াছ প্রেমদান চাইনি তো প্রতিদান,
তবে কেন হীনপ্রাণ, শুনিলে নয়ন ঢাকো।
দেখিতে সে মুখে হাসি, সতত তুমি প্রয়াসী,
হয়ে তারি অভিলাষী সাধে বাদ সেধোনাকো”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
কিছুদিন আগেই গিরিশচন্দ্র হাঁপানি রোগে ভুগে উঠেছিলেন। অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছিলেন। তবুও দর্শকদের কথা মাথায় রেখে, রঙ্গমঞ্চকে ভালোবাসেন বলে তিনি তাঁর শরীরের এই অবস্হা নিয়েও এই নাটক লিখলেন। এবং অভিনয় করিয়ে মঞ্চস্থ করলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। এ কাজ গিরিশচন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।