ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
এদের অভিধানে ‘অবসর’ শব্দটা নেই। তাই বলে অত্যধিক কাজের মধ্যেও তারা দিন কাটায় না। সারাদিনই স্বল্প কর্ম, স্বল্প আহার করে থাকে আপান করে প্রচুর পরিমাণে ভেষজ গ্রিন-টি। সারাদিনে তারা মাঝেমধ্যে ছোট ছোট ন্যাপ দেয়। আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে ছোট ছোট ন্যা প হৃদরোগের আশঙ্কা অনেকখানি হ্রাস করে। বিকালে তারা হয় শরীরচর্চা অথবা হাঁটা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে মজলিস বসায়। লাফিং ক্লাবে গিয়ে কৃত্রিম হাসি নয় বরং প্রাণ খোলা হাসি এবং গল্প তাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
আধুনিক ঝাঁ চকচকে জীবন, বিপুল বৈভব মানুষকে এমন এক পর্যায়ে এনে ফেলেছে যে সে তার জীবনে বাঁচার আদব কায়দা শিখতে এবং পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত করতে জীবনের অনেকাংশ ব্যয় করে। তারপরেও যে সে তার মনের মতো কাজ পায় তা নয়। অর্থাৎ একটা অসন্তুষ্টি তাদের গ্রাস করে। ঠিক এমনই মুহূর্তে ইকিগাই ধারণা সমগ্র বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করছে। মানুষ আর ওয়েলথ নয় বরং ‘বিয়ন্ড ওয়েলথ’ এ আনন্দ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুটা ভারতের সনাতন সাধু সন্ন্যাসীদের মতো। ইকিগাই ধারণা হল বাস্তব এবং আধ্যাত্মিক জীবনের মেলবন্ধন, যেটা জাপানি জীবনযাত্রার একটি পদ্ধতি। এটি মানুষকে খুব সহজে শিখিয়ে দেয় তার জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবেই জীবনের আসল লক্ষ্য খুঁজে পেলে মানুষ তার জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তির অধিকারী হয়, যা এক সুদীর্ঘ, সুখী জীবনযাপন করতে ভীষণভাবে সাহায্য করে।
ইকিগাই দর্শন বা ইকিগাই ফিলোসফি
জাপানি এই দর্শনের মতে, একজন মানুষ কেবলমাত্র শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে তাই নয়, মানসিকভাবেও সুস্থ থাকার চেষ্টা করে। আর কেউ যদি পারপাস অফ লাইফ বা জীবনের সঠিক লক্ষ্য খুঁজে পায় সে মানসিক আনন্দ যেমন লাভ করে, তেমনি শরীরের সুস্থতা, অর্থ এবং পৃথিবীর জন্যও কিছু করতে পারে।
আমি যে কাজে দক্ষ এবং যে কাজ আমি ভালোবাসি সেটা হলো আমার প্যাশন। আমি যে কাজ ভালোবাসি এবং পৃথিবীর যে কাজ প্রয়োজন সেটা হল আমার মিশন। পৃথিবীর যে কাজ প্রয়োজন এবং যে কাজের জন্য আমি অর্থ উপার্জন করি সেটা হল আমার ভোকেশন। সর্বশেষ আমি যে কাজে দক্ষ এবং আমি যে কাজ করে অর্থ উপার্জন করি সেটা হলো আমার প্রফেশন। এই প্যাশন, মিশন, ভোকেশন এবং প্রফেশন এই চার মিলেই হয় ইকিগাই। জাপানের মানুষেরা নিজের ইকিগাই খুঁজে পায় বলেই প্রত্যহ সকাল মনের আনন্দে তাদের শয্যা ত্যাগ করে।
হয়তো অনেকের মনে হতে পারে, ইকিগাই কেবলমাত্র কয়েকটি পেশাতেই সম্ভব যেমন শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি। কিন্তু আসল ব্যাপার হল প্রত্যেক পেশার মধ্যেই ইকিগাই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ কোনও গায়ক হয়তো গান গাইতে ভালোবাসেন, তিনি সেই গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করেন, বহু শ্রোতা তার গান শুনে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়, এছাড়াও গান গেয়ে গায়কের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে তাহলে সেই গায়কের গান গাওয়াই হল তার জীবনের ইকিগাই। এছাড়াও কোন ব্যবসায়ী, কোন চাষী বা যেকোন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষই তাদের জীবনের ইকিগাই নিজের নিজের মতো করে সন্ধান করতে পারেন।
পরকীয়া ও প্রেম, সব দোষ হরমোনের
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম
নিজের জীবনের ইকিগাই খুঁজে বার করুন
প্রত্যেকের নিজের জীবনের ইকিগাই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। নিজে থেকে নিজের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো করলেই এই দর্শনের সন্ধান পেতে পারি। প্রশ্নগুলি হল এইরূপ
এছাড়াও জাপানিদের মধ্যে দশটি প্রণালীর কথা আছে, যা তাদের দীর্ঘায়ু ও মানসিক শান্তি প্রদান করে থাকে। এই প্রণালীগুলি হল:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’
ওকিনাওয়া দ্বীপের মানুষের জীবনযাত্রা
সূচনাতে কিছুটা আলোচনা করা হলেও এই অংশে আমরা নিখুঁতভাবে ওকিনাওয়া দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করব। এই দ্বীপের অধিকাংশ বাসিন্দার গড় আয়ু ১০০ বছর বা তার অধিক। তারা প্রত্যহ সকালবেলা থেকেই ইঁদুর দৌড়ে নামে না, বরং বলা যেতে পারে তাদের জীবন কিছুটা স্লথ। তারা ধীরেসুস্থে তাদের কাজ করে, দুপুরে কিছুটা ঘুমিয়ে নেয়, বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় এবং সারা দিনে অল্প পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে। তারা তাদের ডিশকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নেয় এবং প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি, স্থানীয় ফলমূল ও খাবার নিয়ে খেতে বসে। তারা ভেবে থাকে অনেকটা খাবার খেলো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খায় অল্প খাদ্য যা তাদের পেটকে আশি শতাংশ পূর্ণ করে। বাকি অংশ জল এবং গ্রিন-টি দ্বারা ভর্তি করে। জাপানিদের খাবার থালাকে দেখলে মনে হয় রামধেনু রং। কারণ তারা লাল, সবুজ, সাদা, হলুদ, গেরুয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সবজি এবং ফলমূল গ্রহণ করে। তাদের ডায়েটের মধ্যে থাকে টফু, মিশো, টুনা, গয়া, স্যা পনিন চা, গ্রিন-টি, শিকুওয়াসা নামে এক টক লেবু জাতীয় ফল।
এই ফলের মধ্যে নোবীলেটিন জাতীয় এক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়, যা ভারতীয় কমলালেবুর থেকে চল্লিশ গুণ বেশি। গবেষণা জানাচ্ছে এই পদার্থটি অ্যান্টি এজিং হিসাবে কাজ করে, ক্যান্সার, টাইপ টু ডায়াবেটিস, মোটা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি থেকেও মানুষকে রক্ষা করে। অনেক শতায়ু মানুষের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে তারা কোনদিনই অ্যালকোহল গ্রহণ করেনি।
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
ইকিগাই কেন এত জনপ্রিয়?
সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অর্থ ও সম্পত্তির পিছনে ছোটা বন্ধ করে, নতুন আনন্দময় জীবনের সন্ধান পাচ্ছে এই জাপানি দর্শন থেকে। মানুষ আবারো চাইছে সহজ, সরল, সাদাসিধে জীবনযাপন। খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে চাইছে। তারা দেখছেন জোর করে ভালো না লাগা কাজের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত। অনেক মানুষ আত্মহত্যা করতে চাইছে। তখনই জাপানের এই ছোট্ট শব্দ তাদের জীবনের আনন্দের সন্ধান দিচ্ছে। কেবলমাত্র তাই নয় ইকিগাই দ্বারা মানুষ কেবল নিজের উন্নতি করে তাই না, এই দুনিয়ারও উন্নতি করে। তাই এই জীবন দর্শনের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।