শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য ও অমিয়কুমার দাশ। ছবি: সংগৃহীত।

‘দেশ’ শব্দটি শুধুই ভৌগোলিক সীমানা নয়। দেশ আর মাকে আমরা একই আসনে বসাই। আমাদের দেশ উন্নত হলে আমাদের উন্নতি, দেশের বিপদ মানে নিজেদের বিপদ। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশের জন্য যাঁরা জীবনের বাজি রাখতে পারেন তাঁরা সব সময়ই নমস্য। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও আত্মবলিদান দিয়ে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ার পর কেউ বা ভারতের আকাশে দেশের পতাকা উত্তোলের উৎসব দেখেছেন, আবার কেউ বা স্বাধীনতার স্বপ্ন চোখে নিয়ে অমর হয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অসমের দেশভক্তরাও জোরদার ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ২২ জন বিপ্লবী পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। ১৯৪৩ সালের ১৫ জুন কুশল কোঁয়রের জোরহাট জেলে ফাঁসি হয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্বে সিলেট অঞ্চল ছিল তৎকালীন ‘আসাম’ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৩৪ সালের ২ জুলাই সিলেটের জেলে ফাঁসি হয় অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের। অসমের প্রথম আত্মদানের গৌরব লাভ করেন অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য।
১৯৩৩ সালের ১৩ মার্চ শ্রীহট্ট হবিগঞ্জের ইটখোলা রেলস্টেশনে সুরমা মেলের সরকারি ডাক লুঠ হয়। ছয়জন বিপ্লবী সেই লুণ্ঠন কার্যে জড়িত ছিলেন। আর তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য। উল্লেখ্য, তখন অসিতের বয়স আঠেরোও হয়নি। সস্ত্রস আন্দোলনের জন্য অর্থের প্রয়োজন হত, তাই বিপ্লবীরা বেশ কয়েকটি লুণ্ঠন অভিযান চালান। অসিতের দলে ছিলেন বিরাজমোহন দেব (বাঘা), বিদ্যাধর সাহা, গৌরাঙ্গলাল দাস, মহেশ রায়, মনমোহন সাহা। অসিতের পায়ে আঘাত লাগায় তিনি ধরা পড়ে যান, পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি বিরাজ মোহন দেব, বিদ্যাধর সাহা এবং গৌরাঙ্গলাল দাসও। মহেশ রায় ও মনমোহন সাহা পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

ইটাখোলা ডাক লুটের ঘটনা এবং মামলা সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। তাই ইংরেজ সরকার নিজের সুবিধার জন্য সেই মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেয়। সিলেটে অসিতরঞ্জনের বিচার স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে হয়েছিল। সিলেটে কোনও হাইকোর্ট ছিল না,এখনও নেই। কলকাতা হাইকোর্ট অসিতের ফাঁসি এবং বিরাজ মোহন দেব, বিদ্যাধর সাহা ও গৌরঙ্গলাল দাসের আন্দামানের সেলুলার জেলে আজীবন কারাদণ্ড হয়। সেই সময় অসিত ভট্টাচার্যের সঙ্গে সিলেট জেলে ছিলেন বিপ্লবী চঞ্চল শর্মা।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১২: স্বাধীনতা আন্দোলনে শিলচর ও চন্দবাড়ি

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

চঞ্চল শর্মা তাঁর ‘স্মৃতি কথা’য় লিখেছেন, “ফাঁসি কোঠায় কেউ কোনও দিন অসিতকে কালো মুখ করে থাকতে দেখেনি। রোজই গীতা পড়তেন। ফাঁসির আদেশ পাওয়ার পর তাঁর ওজন বেড়ে যায়। ফাঁসির দিন শেষ রাতে উঠে স্নান করে পূজাঅর্চনা এবং গীতাপাঠ করেন। তার পরে তিনি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। ফাঁসির সময় হাকিম, পুলিশ, সুপারিন্টেন্ট প্রত্যেককে সামনে থাকতে হয়। তাঁরা সকলে এসে যখন দরজা খুলে হাত দুটো পিছমোড়া করে হাতকড়া দিয়ে অসিতকে বের করলেন, তখন বাঘ যেভাবে খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে লাফিয়ে বের হয়, ঠিক সেই ভাবেই বন্দেমাতরম ধ্বনি সহকারে অসিতও ঘর থেকে লাফিয়ে বের হন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা যাঁরা রাজবন্দিরা হাজত ওয়ার্ডে, ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে এবং পিঁজরাওয়ার্ডে যে যেখানে ছিলাম সকলে বন্দেমাতরম, ভারত মাতা কি জয়, অসিত ভট্টাচার্য কি জয় প্রভৃতি ধ্বনি দিয়ে জেলের ভিতর মুখরিত করে তুললাম। আমরা অসিত ভট্টাচার্যের ফাঁসি পর্যন্ত প্রায় আধঘণ্টা ধরে স্লোগান চালালাম। …অসিতের ফাঁসি হয়েছিল ২ জুলাই। তাঁর শবদেহ পুলিশের হেফাজতে শ্মশান ঘাটে (সিলেট সাগরদিঘির পাড়ে) দাহ করা হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রমোদরঞ্জন ভট্টাচার্য ব্যতীত আর কাউকে দাহের সময় উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি।’’
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

অসিতকুমার অল্প বয়সেই স্বাধনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর বাবা করিমগঞ্জের এওলাবাড়ি চা বাগানের কম্পাউন্ডার ছিলেন। ক্লাস নাইনে থাকতেই তিনি পতাকা হাতে নিয়ে এক শোভাযাত্রার প্রথম সারিতে ছিলেন। পুলিশের লাঠির ভয়ে অনেকে পালিয়ে গেলেও তিনি পথেই বসে পড়েন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ছেলেটি ভারতের বীর শহিদের মুকুট মাথায় ধারণ করেন।

অসমের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা আলোচনা করতে গেলে অমিয়কুমার দাশের কথা উল্লেখ করতেই হয়। ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিপ্রাপ্ত অমিয়কুমার দাশ খুব অল্প বয়সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বহুবার কারাবরণ করেন। তিনি মূলত গান্ধীজির অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

১৯৩৫ সালের তৎকালীন সরকারি আইন অনুযায়ী অমিয়কুমার ১৯৩৭ সালে গঠিত বিধানসভার সদস্য হন। তাঁর স্ত্রী পুষ্পলতাও স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা দু’ জনই কারাবরণ করেছিলেন। প্রাক স্বাধীনতাকালে (১৯৪৬ সাল) নাগা পাহাড়ে বিদ্রোহ দমন করার জন্য তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সর্ব প্রথম এখনকার নাগাল্যান্ডের কোহিমা এবং তার আসে পাশের গ্রামের নাগা উপজাতির মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যার কথা জানতে চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

পরবর্তীকালে গোপীনাথ বরদোলই-সহ অসমের তৎকালীন গভর্নর আকবর হায়দারি নাগা বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে কোহিমা পৌঁছন। স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে তিনি অসমের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই অসমের চা শ্রমিকদের প্রিভিডেন্ট ফান্ড গঠন কাজ শুরু হয়। তার আগে এশিয়া মহাদেশে কোথাও এ নিয়ে কেউ ভাবেননি। দেশের জন্য তিনি আজীবন ভেবেছেন, দেশকে ভালোবেসেছেন এবং দেশের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে ভারত সরকারের ডাক বিভাগ তাঁর নামে স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।

বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত স্বাধীনতার পর অসমের শিলচর শহরে এসে বসবাস করেন। বোমা তৈরির অভিযোগে তাঁর ফাঁসির সাজা হয়েছিল, পরর্বতীকালে তা কমে আজীবন দীপান্তর হয়েছিল। প্রায় ১১ বছর আন্দামানের সেলুলার জেলে ছিলেন তিনি। জেলে অমানুষিক অত্যাচারের ফলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফলেছিলেন। জেল থেকে কলকাতা ফিরে তিনি জানতে পারেন তাঁর আগের জীবনের প্রেমিকা লীলাদেবী বিধবা হয়েছেন। এখন তিনি পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে বিছানায়। তিনি লীলাদেবীকে বিবাহ করে শিলচরে আসেন। শিলচরের সাধারণ মানুষ তাঁকে মালা দিয়ে বরণ করে সংবর্ধনা জানায়।

ছবি: সংগৃহীত।

তাঁর শেষ জীবনে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী শিলচরেই ছিলেন। মোজাফফর পুর বোমার মামলায় ক্ষুদিরাম বসু যে বোমা ব্যবহার করেছিলেন, তা তৈরি করেছিলেন উল্লাস কর দত্ত এবং হেম চন্দ্র দাস। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় হওয়ার পর বরাক সুরমার এক নাম না জানা কবি একটি গান রচনা করেন। অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য সম্পূর্ণ গানটি সংগ্রহ করেন।
গানটি ছিল—
‘‘ভুলিবে কি প্রাণান্তে ,ও ভারতবাসী
বড় অবিচারে হইল দেখ ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
মেদিনীপুর ভদ্রঘরে ক্ষুদিরামের জন্ম ধরে,
সে যে ছিল শান্ত শিষ্ট, কর্মনিষ্ঠ, অতি মিষ্টভাষী।
বয়স ছিল ষোলমাত্র, সে যে দেখতে যেন রাজপুত্র,
এমন সোনার চাঁদে দুষ্ট রাহু ফেলিলরে গ্রাসী।
মুজফ্ফরপুর বোমার মামলায়, পড়িয়া ফিরিঙ্গির পাল্লায়,
সে যে চিরতরে কালসাগরে চলিলরে ভাসি-
ভূলিবে কি প্রাণান্তে।।’’ —চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content