বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বারণাবতে কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডবকে জতুগৃহে দগ্ধ করতে চেয়েছিলেন কৌরবদের দুষ্ট চক্র। কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের পূর্ণ সম্মতি নিয়ে দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, কর্ণ এই চক্রান্তে অংশ নিয়েছিলেন। চক্রান্ত ব্যর্থ হল। বিদুরের সহায়তায় রক্ষা পেলেন পাণ্ডবরা। পালিয়ে গেলেন তাঁরা। সামনে অজানা গন্তব্য। রাক্ষস অধ্যুষিত গহন অরণ্যে, রাক্ষসী হিড়িম্বা, ভাই হিড়িম্বের নির্দেশানুসারে নরমাংস ভক্ষণের লোভে পঞ্চপাণ্ডবকে হত্যা করতে উপস্থিত হল। সেখানে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন চার পাণ্ডবভাই ও মা কুন্তী। পাহারায় রয়েছেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। উন্নতদেহী অনন্যসুন্দর ভীমসেনকে দেখে মুগ্ধ হল রাক্ষসী। রাক্ষসী হিড়িম্বা,রাক্ষস হিড়িম্বের চক্রান্ত ফাঁস করে দিলেন। প্রণয় নিবেদন করলেন ভীমসেনকে। ইতিমধ্যে হিড়িম্বার সন্ধানে উপস্থিত হলেন ভাই হিড়িম্ব। ভীমসেন মুখোমুখি হলেন ক্রুদ্ধ রাক্ষস হিড়িম্বের। যুযুধান হিড়িম্ব ও ভীম। প্রমত্ত, দুই শক্তির সংঘর্ষে জেগে উঠলেন, কুন্তী ও পাণ্ডবভাইরা।

রাক্ষসী হিড়িম্বা অপরূপা। তার অতিলৌকিক রূপে মুগ্ধ হলেন তাঁরা। মা কুন্তী, মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পরিচয়। কস্য ত্বং সুরগর্ভাভে! কা বাঽসি বরবর্ণিনি!। কেন কার্য্যেণ সংপ্রাপ্তা কুতশ্চাগমনং তব।। হে সুরলোকবাসিনীদেবীতুল্যা, তুমি কার? এতো সুন্দরী রূপবতী, তুমি কে? কোন কাজে এসেছো? কোথা হতে তোমার আগমন? হিড়িম্বা বনদেবী বা কোনও অপ্সরা, যেই হন শুধু জানান কীহেতু তাঁর এখানে অবস্থান?

হিড়িম্বা জানালেন, ওই যে নীল মেঘবরণ অরণ্য সেখানেই তাঁর ও ভাই হিড়িম্বের নিবাস। সেই নিষ্ঠুর ভায়ের নির্দেশে হিড়িম্বা এখানে এসেছিলেন সপুত্র কুন্তীকে নিধনের উদ্দেশ্যে। এখানে উপস্থিত স্বর্ণকান্তি, মহাবলশালী ভীমসেনের রূপমুগ্ধ হয়েছে রাক্ষসী। সবপ্রাণীর অন্তর্নিহিত ওই কামদেবের লীলায় মজে, ভীমসেনের অনুগত হয়েছে সে। হিড়িম্বা স্বামীরূপে ভীমসেনকে বরণ করে নিলেও, স্থানান্তরিত করতে পারেননি তাঁকে। হিড়িম্বা জানাল, ভগিনীর খোঁজে উপস্থিত, ক্রুদ্ধ নিধনোদ্যত হিড়িম্বকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ভীমসেন। হিড়িম্বা কুন্তীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, দেখালেন মহাবেগে, মহাপরাক্রমে যুদ্ধরত দুই মানুষ ও রাক্ষসকে।
শুনে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। তাঁরা দেখলেন, সিংহবিক্রমে ভীম ও হিড়িম্ব পরস্পরকে পরাজিত করবার উদ্দেশ্যে একে অপরকে তীব্র আকর্ষণ করছেন, ধূলিধূসর দেহে তুষারাবৃত দুটি পর্বতের মতো দৃশ্যমান দুই মহাবলী। অর্জুন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। সাহায্যেঽস্মি স্থিতঃ পার্থঃ পাতয়িষ্যামি রাক্ষসম্। এই আমি পার্থ অর্জুন, সাহায্যে প্রস্তুত, রাক্ষসের পতন হবে আমার হাতে। ভীমের উত্তর— নিরপেক্ষ থাকো পার্থ, দেখে যাও শুধু। রাক্ষসনিধনে ব্যস্ত হয়ো না। আমার দুই বাহুর নাগালে এসে পড়েছে সে, আর নিস্তার নেই এর। উদাসীনো নিরীক্ষস্ব ন কার্য্যঃ সম্ভ্রমস্ত্বয়া। ন জাত্বয়ং পুনর্জীবেন্মদ্বাহ্বন্তরমাগতঃ।।

অর্জুনের পরামর্শ হল—আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। কারণ পূর্বদিকে রক্তিমাভা দেখা দিয়েছে, সূর্যোদয়ের পূর্বের সেই চরমমুহূর্তে রাক্ষসরা দুর্বার হয়ে উঠবে। তাই তরস্ব ভীম! মা ক্রীড় জহি রক্ষো বিভীষণম্। পুরা বিকুরুতে মায়াং ভুজয়োঃ সারমর্পয়।। আর একে নিয়ে আর খেলা নয়। শীঘ্রই এই ভয়ানক রাক্ষসকে হত্যা করুন। না হলে সেই চরম মুহূর্তে এ মায়া বিস্তার করবে, তাই বাহুদুটিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করুন। ভীম ক্রোধে জ্বলে উঠলেন, বাহুতে বিধ্বংসী বায়ুবেগ ধারণ করলেন। মেঘতুল্য কৃষ্ণবর্ণ রাক্ষসকে তুলে ধরে শতগুণ বেগে ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন, তোর এই মাংসল হৃষ্টপুষ্টদেহ বৃথা, বৃথা তোর জ্ঞানহীন বার্ধক্য, তোর বিবেকহীন বুদ্ধি নিষ্ফল, অকারণ মৃত্যুর যোগ্য তুই, তবে তা অর্থহীন, বৃথা হবে না আজ। বৃথা মাংসৈর্বৃথা পুষ্টো বৃথা বৃদ্ধো বৃথামতিঃ। বৃথা মরণমর্হস্ত্বং বৃথাদ্যন ভবিষ্যতি।।

এই স্থানটির কল্যাণে এই বনকে নিষ্কণ্টক করবেন ভীমসেন। এই রাক্ষস আর মানুষকে ভোজ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না। অর্জুন প্রস্তাব দিলেন, ভীমসেন যুদ্ধে এই রাক্ষসকে যদি দুর্বহভার বলে মনে করেন তবে তিনি সাহায্যে প্রস্তুত অথবা ভীম নিশ্চিতভাবে সফল হয়েছেন যখন, তবে এ বার রাক্ষসকে হত্যার ভার নেবেন অর্জুন। শোনামাত্র ভীম, যেন পশুবধ করছেন এমনভাবে রাক্ষসকে মাটিতে পিষে হত্যা করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

নিহত হল হিড়িম্ব রাক্ষস। পাণ্ডবভায়েরা উল্লাসিত হয়ে, ভীমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। অর্জুনের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁরা দুর্যোধনের কাছে অজ্ঞাত, অদূরবর্তী নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাক্ষসী হিড়িম্বা তাঁদের অনুসরণ করতে লাগলেন।

ভীম হিড়িম্বার প্রতি সন্দিহান, রাক্ষসীরা মায়াবলে অনেক শত্রুতার সৃষ্টি করে। তাই হিড়িম্বা বরং ভায়ের পথ অনুসরণ করুক। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সতর্ক করলেন ভীমকে, পুরুষব্যঘ্র ভীম, শত ক্রোধেও নারীবধ নয়। দেহরক্ষা থেকেও ধর্মরক্ষার গুরুত্ব বেশি। সেইহেতু, হে পাণ্ডুপুত্র তুমি ধর্মরক্ষা কর। ক্রুদ্ধোঽপি পুরুষব্যাঘ্র! ভীম! মাস্ম স্ত্রিয়ং বধীঃ। শরীরগুপ্ত্যভ্যধিকং ধর্ম্মং গোপায় পাণ্ডব!।। হিড়িম্ব মৃত, তাঁর ভগ্নী ক্রুদ্ধ হলেও আমাদের কী ক্ষতি করতে পারে? হিড়িম্বা নতজানু হলেন কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে। হাতজোড় করে বলল, হে মহাশয়া, নারীদের কামনাজাত যে দুঃখ সেটি আপনার অজ্ঞাত নয়। আমার কষ্টের কারণ এই ভীমসেন। আর্য্যে! জানাসি যদ্ দুঃখমিহ স্ত্রীণামনঙ্গজম্। তদিদং মামনুপ্রাপ্তং ভীমসেনকৃতং শুভে!।।

হিড়িম্বা এতক্ষণ এই কষ্ট সহ্য করেছেন, আর নয়। এখন সেই সুসময় সমাগত। কুন্তীর কাছে তার আবেদন, আমি সুহৃদবর্গ, আত্মীয়স্বজন, স্বধর্ম ত্যাগ করে, আপনার পুরুষব্যাঘ্র পুত্রটিকে স্বামীরূপে বরণ করেছি। ময়া হ্যুৎসৃজ্য সুহৃদঃ স্বধর্ম্মং স্বজনং তথা। বৃতোঽয়ং পুরুষব্যাঘ্রস্তব পুত্রঃ পতিঃ শুভে!।। হিড়িম্বা আরও জানাল, তার সত্যশপথ হল—বীর ভীমসেন ও কুন্তীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা হলে সে আর বাঁচবে না। বিমুগ্ধা, ভক্তা, অনুগতা মনে করে তার প্রতি দয়া করুন। কুন্তীর পুত্রটি হিড়িম্বার স্বামী, শুধু কুন্তীর সংযুক্তিকরণের অপেক্ষা। কুন্তীর পুত্রটিকে নিয়ে কিছুকাল স্থানান্তরে যাবেন, পরে তাঁকে আবার পৌঁছিয়ে দেবেন।

হিড়িম্বাকে মনে মনে স্মরণকরামাত্র সে বিপদ হতে পরিত্রাণের জন্য উপস্থিত হবে এবং পাণ্ডবদের দুর্গম বিষম স্থানে নিয়ে যাবে। যদি তাড়া থাকে তবে পিঠে বহন করে নিয়ে যাবে, শুধু একটিই অনুরোধ— আপনাদের অনুগ্রহে ভীমসেন যেন আমায় বিবাহ করেন। যূয়ং প্রসাদং কুরুত ভীমসেনো ভজেত মাম্।।

হিড়িম্বার মতে, বিপদোদ্ধারে যে কোনও উপায় অবলম্বনে করে প্রাণধারণ শ্রেয়। ধর্মবোধ বজায় রেখে, সমাদরপূর্বক কার্যোদ্ধার কর্তব্য। বিপদকালে অপরের ধর্মরক্ষা করেন যিনি তিনিই উত্তম ধর্মবিদ। ধর্ম হতে স্খলন বা পতন, ধার্মিকদের বিপদ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। আপৎসু যো ধারয়তি ধর্ম্মং ধর্ম্মবিদুত্তমঃ। ব্যসনং হ্যেব ধর্ম্মস্য ধর্ম্মিণামাপদমুচ্যতে।। ধর্ম্ম জীবনরক্ষক। তাই ধর্ম্ম প্রাণদাতা। ধর্ম্মপথে বিচরণকারী নিন্দিত হন না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার মত মেনে নিলেন। সুন্দরী হিড়িম্বাকে যুধিষ্ঠির কথিত সত্যবদ্ধ থাকতে হবে। ভীমসেন স্নান, আহ্নিক, মাঙ্গলিকক্রিয়া কর্তব্য সম্পন্ন করবার পরে, রাক্ষসী তাঁর সঙ্গে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিহার করতে পারেন। কারণ হয়তো দিবাভাগে রাক্ষসদের মায়ার কবলে আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম। দিবালোকে, মনের তুল্য বেগবতী হিড়িম্বার ভীমের সঙ্গে বিহারে কোনও মানা নেই, রাত্রিতে কিন্তু সর্বদাই ভীমকে এনে দিতে হবে। ভীমসেনও সম্মত হলেন। তিনি কিন্তু শর্ত আরোপ করলেন। যাবৎ কালেন ভবতি পুত্রস্যোৎপাদনং শুভে। তাবৎ কালং গমিষ্যামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে।। হে সুতনু, পুত্রোৎপাদন পর্যন্ত আমি তোমার সঙ্গে থাকব। অর্থাৎ পুত্রের পিতা হওয়ার পরে আর তোমার সঙ্গে সহবাস নয়। হিড়িম্বা সম্মতি দিলেন।

ভীমকে নিয়ে সুন্দর সাজে, আভরণভূষিতা হিড়িম্বা মধুর কথায় মন ভরিয়ে, ভীমসেনের সান্নিধ্যে সুন্দর, মনোরম স্থানে ভ্রমণ করতে লাগল। ভীমসেনের মনের আনন্দ হল সে। যথাকালে এক মহাবলবান পুত্রের জন্ম দিল হিড়িম্বা। পুত্রটি দেখতে কেমন? তার বিকট চক্ষু, বিশাল মুখমণ্ডল, শঙ্কুতুল্য তীক্ষ্ণাগ্র কর্ণ, ভীষণাকৃতি সে। ভয়ঙ্কর শব্দকারী তার ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ, শাণিত দন্ত, গম্ভীর কণ্ঠস্বর। মহাধনুর্ধর, মহাশৌর্যশালী, বিশেষ অধ্যবসায়ী, মহাবাহু, বিশেষ গতিমান, বিশালাকৃতি, ঘোর মায়াবী, শত্রুদমনকারী পুত্রটি। তাঁর দীর্ঘনাসিকা, প্রশস্তবক্ষ, জানু ও গুলফের মধ্যবর্তীস্থানের পশ্চাদ্ভাগ সুডৌল গোলাকৃতি মাংসস্তূপবিশিষ্ট। সে মানবপুত্র অথচ, অমানব, মহাবেগবান, মহাবীর সেই ভীমপুত্র, পিশাচ ও রাক্ষসদের অতিক্রম করে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

রাক্ষসদের মধ্যে,বালক হয়েও যৌবনে, উপনীত, মহাবলশালী, হিড়িম্বাপুত্র,সমস্ত অস্ত্রপ্রয়োগে নৈপুণ্য অর্জন করল। রাক্ষসরা গর্ভাবস্থা হতে প্রসূত হয়েই ইচ্ছানুসারে রূপ ধারণ করতে পারে। বহুরূপী হয় তারা। বিশিষ্টকেশ অথবা কেশহীন যার মস্তক, সেই পুত্রটি পিতামাতাকে প্রণাম করে তাঁদের চরণ গ্রহণ করল। পিতামাতা এই মহাধনুর্ধারী পুত্রটির নামকরণ করলেন ‘ঘটোৎকচ’। ঘটোহাস্যোৎকচ ইতি মাতা তং প্রত্যভাষত। অব্রবীত্তেন নামাস্য ঘটোৎকচ ইতি স্ম হ।। ঘটের মতো মাথাটিতে ঊর্ধ্বমুখী কেশ, তাই মা নাম দিলেন ‘ঘটোৎকচ। সেই থেকে সেই নাম ধরেই সকলে তাকে ডাকতে লাগল। পাণ্ডবদের অনুগত,সেই ঘটোৎকচ তাঁদের পরম প্রিয় এবং একান্ত স্বজন হয়ে উঠল। চুক্তি অনুসারে ভীমসেনের সঙ্গে সহবাসের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। হিড়িম্বা একটি শপথ নিয়ে বিদায় নিল।

ঘটোৎকচ পিতামহী কুন্তী ও পাণ্ডবদের অভিবাদন করে জানতে চাইলেন তাঁদের প্রতি তার নিজের কর্তব্য কী? পিতামহী তাকে পৌত্রের মর্যাদা দিলেন। ত্বং কুরূণাং কুলে জাতঃ সাক্ষাদ্ভীমসমো হ্যসি। জ্যেষ্ঠঃ পুত্রোঽসি পঞ্চানাং সাহায্যং কুরু পুত্রক।। বাছা তুমি কুরু বংশজাত, ভীমের প্রতিরূপ তুমি। পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠপুত্র তুমি। হে পুত্র,তুমি আমাদের সাহায্য কর। ঘটোৎকচ, পিতামহীর চরণধূলি মাথায় নিয়ে বললেন, রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিৎ যেমন পিতার তুল্য বলশালী তেমনই সেও আকৃতি ও শক্তিতে পিতার তুল্য বিশিষ্টরূপে পরিচিত হবে এই পৃথিবীতে। রাক্ষসশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ কৃত্যকাল উপস্থাস্যে পিতৃনিতি পিতাদের যথাকর্তব্যকালে উপস্থিত হব—এই অঙ্গীকার করে, প্রস্থান করল ঘটোৎকচ। ঘটোৎকচের জন্মরহস্যের অন্তরালে ছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নিজের স্বার্থচিন্তা। পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ, কোরবপক্ষীয় কর্ণের শক্তির মোকাবেলার উদ্দেশ্যেই ঘটোৎকচের উৎপত্তি। সে বৃত্তান্ত কুরুপাণ্ডবদের মহাযুদ্ধপ্রসঙ্গে বর্ণনার বিষয়।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডবদের অজানা গন্তব্যে যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা ছিল, ছিল হিড়িম্ব রাক্ষসের প্রাণঘাতী আক্রমণ, রূপবতী হিড়িম্বার রূপজমোহের কামনার আগুনের মোহময় আকর্ষণ। এমনটাই ঘটে অনিশ্চিত জীবনের যাত্রাপথে। হিংস্র অপ্রত্যাশিত বিপদ ওত পেতে বসে আছে, পদস্খলনের চক্রান্তরত কামনার প্রলোভন। উন্নত সুঠাম ব্যক্তিত্ব, চরিত্রবান, দৃঢ়চেতা, কর্তব্যপরায়ণ কোন ভীমসেন সেটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। সাধারণের জীবনে—ধর্ম, অর্থ, কাম তিনটি প্রধান। এই তিনটির ভারসাম্য বজায় রাখলে পুরুষার্থলাভ সম্ভব। ধর্মবোধ,কর্তব্যে সজাগ রাখে, অর্থ—ধার্মিকজীবন ও কামনাপূরণে সহায়ক। কামনা বাসনাবিলাস বা বিষয়াভিলাষ। কামনার প্রয়োজন হয়তো জীবনের রঙরূপ অনুভবে। এর অভাবে ধর্মচিন্তা, অর্থচিন্তা ব্যাহত হয়, বড় নীরস হয়ে যায় জীবন, যদি কামনাপূরণ না হয়। তিনটির ভারসাম্য জীবনকে ধরে রাখে। একে অপরকে ছাপিয়ে গেলেই বিপদ, পদস্খলন নিশ্চিত।

কর্তব্যনিষ্ঠ ভীমসেন ধর্মবোধ বজায় রেখেছেন। সুন্দরী হিড়িম্বা কামনার আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেছেন তাঁর মনে, সেটি এককথায় উড়িয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে শত্রুর চক্রান্তের প্রতিরোধ। অর্থকরী এই চিন্তা। উদ্দেশ্যবিহীন জীবন কাম্য নয়। শুধুমাত্র স্বার্থচিন্তা নয়, লক্ষ্যে পৌঁছনোর একমুখী নিষ্ঠা, আগ্রহ, উদ্যম, উদ্যোগ মানুষকে পরম কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সহায়ক হয়। বারণাবতের জতুগৃহ থেকে পরিত্রাণ শেষ কথা নয়, বহু অগ্নিবেষ্টনী ঘিরে আছে জীবনে, বিদুররা আছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, ভীমসেনের মতো কেউ লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হয়ে আছেন, সেটাই আশার কথা। হিড়িম্বার রূপমুগ্ধ হয়েছেন মা কুন্তী। মেনে নিয়েছেন তাকে, পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করেছেন। কামনা, ধর্মের সম্মুখে নতজানু হয়েছে। প্রত্যাখ্যাতা হিড়িম্বা তাকে গ্রহণের জন্যে করজোড়ে প্রার্থনা জানিয়েছে। রাক্ষসীর হিড়িম্বার মধ্যে, ধর্মবোধ আছে। কামনা ও ধর্মের মেলবন্ধন যেন।

হিড়িম্বার মতে, বিপদে ধর্মবোধ বজায় রাখাই—ধার্মিকের লক্ষণ। কামনা মাথা চাড়া দেয় রাতের অন্ধকারে। তাই রাতে কামনার সঙ্গ নয়। ধর্ম ও কামের মিলনে জন্ম নিল যে,তার কামের প্রাধান্যে বা প্রভাবে দৈহিক আকৃতি হল মায়ের, অন্তর্নিহিত ধর্মবোধ রইল পিতার বংশপরম্পরাক্রমে।

পাণ্ডবদের উত্তরসূরী হল রাক্ষসী হিড়িম্বার গর্ভজাত পুত্র। পিতামহী কুন্তী তাকে জ্যেষ্ঠপৌত্রের সম্মান দিলেন। সে মানব হয়েও আকৃতিতে অমানব, অমানব হয়েও তার মধ্যে মানবিক চেতনার অভাব নেই কোনও। এই মানব কখনও দানব হয়ে ওঠে, আবার, দৈহিকভাবে অমানব কেউ, মানবিক আবেদনে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ওঠেন।

মহাভারতের কাহিনির অন্তরালে কত যে জীবনদর্শনের ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে, এর গভীরে রয়েছে চিন্তাশীলের তত্ত্বচিন্তার খোরাক। প্রবহমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কাহিনিগুলিরর ব্যাখ্যাগম্য বৈচিত্র্যময় তত্ত্বানুসন্ধান হয়তো চলতেই থাকবে, যুগান্তরেও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content