শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।

মধ্যযুগে ত্রিপুরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি হলেন ধন্য মাণিক্য। ১৪৯০ থেকে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩০ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। এই বীর নৃপতি ত্রিপুরার পূর্ব প্রান্তে কুকিদের পরাজিত করে ব্রক্ষ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন রাজ্যের পূর্ব সীমা। তিনি জয় করে নিয়েছিলেন বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে গৌড়, আরাকান ও ত্রিপুরার মধ্যে অনেক যুদ্ধ বিগ্ৰহ ঘটেছে। ধন্য মাণিক্য মগ বাহিনীকে পরাস্ত করে একসময় আরাকানেরও কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। ধন্য মাণিক্যের সময়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহ বারকয়েক ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু রাজার বীর সেনাপতি রায় কয়চাগ তা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন। ত্রিপুরার সৈন্য বাহিনী গৌড় সুলতানের কামান অধিকার করে নিয়ে আসে।

অবশ্য ঐতিহাসিকরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, এক সময় ত্রিপুরার অধিকৃত কিছু এলাকায় হুসেন শাহ নিজ অধিকার কায়েম করেছিলেন। ঘন ঘন যুদ্ধবিগ্ৰহের মধ্যেও ধন্য মাণিক্য প্রজা কল্যাণে নানা কাজ করেছিলেন। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে উদয়পুরে ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কথিত আছে, রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে দেবীকে এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রাজ্যে হাজার নরবলির প্রথা রদ করেছিলেন। একমাত্র গুরুতর অপরাধী এবং শত্রুপক্ষের যুদ্ধবন্দিদের বলিদানের প্রথা প্রচলন করেছিলেন তিনি। রাজা সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

তাঁর রাজত্বকালে কয়েকটি পৌরাণিক গ্রন্হ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ এই রাজা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির ছাড়াও উদয়পুরে মহাদেব মন্দির এবং রত্নপুরে চতুর্দ্দশ দেবতার মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজা তাঁর মহারানি কমলা মহাদেবীর নামে কৈলারগড়ে কমলাসাগর নামে একটি বিরাট জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। ধন্য মাণিক্যের প্রচারিত মুদ্রাতেই প্রথম ত্রিপুরার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর আমলের ১৪১২ শকাব্দের আবিষ্কৃত মুদ্রায় ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ অর্থাৎ ত্রিপুরার রাজা কথাটির উল্লেখ রয়েছে।
মধ্যযুগে ত্রিপুরার অন্যতম বীর নৃপতি হলেন বিজয় মাণিক্য। ১৫৩২ থেকে ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ তাঁর রাজত্বকাল। সম্রাট আকবরের প্রায় সমসাময়িক এই রাজা তাঁর বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে বঙ্গদেশ অভিযান করেছিলেন। নানা যুদ্ধ বিগ্ৰহে জয়লাভ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধাভিযানে খাসি, জয়ন্তিয়া, চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও, শ্রীহট্ট বিজয়ের মাধ্যমে বিজয় মাণিক্য এক অমিতবিক্রম রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিপুরা-সহ নোয়াখালী, চট্টগ্ৰাম ও শ্রীহট্টের বিস্তীর্ণ এলাকা বিজয় মাণিক্যের শাসনাধীন ছিল।

বিজয় মাণিক্যের রাজত্বকাল ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধি দিয়েছে। সেসময় রাজ্যের আয়তনও বিস্তৃত হয়েছে। বিজয় মাণিক্যের বিশাল সৈন্য বাহিনী ছিল। বহু সংখ্যক হাতি তিনি রণক্ষেত্রে পাঠাতে সক্ষম ছিলেন। সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও বিজয় মাণিক্যের সমর সম্ভারের উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, এই রাজার দুই লক্ষ পদাতিক ও এক হাজার হাতি আছে। তবে ঘোড়ার সংখ্যা নগণ্য।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

উদয়পুরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজা উদয় মাণিক্যের নাম। তিনি অবশ্য মাণিক্য রাজবংশের কেউ ছিলেন না। গোপীপ্রসাদ ছিলেন রাজা অনন্ত মাণিক্যের শ্বশুর এবং রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। একদিন রাজা অর্থাৎ নিজ জামাতাকে হত্যা করিয়ে উচ্চাকাঙ্খী গোপীপ্রসাদ নিজেই বসলেন সিংহাসনে। নাম ধারণ করলেন উদয় মাণিক্য। নিজের নামানুসারে রাজধানীর নাম রাখলেন উদয়পুর। ১৫৬৭ -৭২ খ্রিস্টাব্দ তাঁর রাজত্বকাল। তাঁর আমলে ত্রিপুরার সীমা খর্ব হয়েছিল। দেখা দিয়েছিল নানা বিশৃঙ্খলা। রাজা ও পারিষদবর্গের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল প্রজাবর্গ। তাঁর সময়ে গৌড়ের নবাব আক্রমণ করেছিলেন ত্রিপুরা। গৌড় বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যাপী তুমুল লড়াই চলে ত্রিপুরার। ঘটে বিপুল লোকক্ষয়। যুদ্ধের পরিণতিতে রাজ্যে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। রাজার বিরুদ্ধেও শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। শেষপর্যন্ত এক দাসী গোপনে বিষ পান করিয়ে উদয় মাণিক্যকে হত্যা করে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

ত্রিপুরার অপর একজন বীর নৃপতি হলেন অমর মাণিক্য। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে বসেন। অমরের রাজত্বকালের প্রায় পুরোটাই ছিল যুদ্ধের উত্তেজনা আর অশান্তিতে পরিপূর্ণ। প্রথম দিকে উপর্যুপরি নানা যুদ্ধে বিজয়ী হলেও শেষে তাঁর করুণ পরিণতি ঘটে। একদিকে টানা যুদ্ধবিগ্রহ, অপরদিকে নিজ পুত্রদের মধ্যে বিবাদ,রাজত্বকালে অমর মাণিক্য মোটেই স্বস্তিতে ছিলেন না। এর মধ্যে আবার পুত্র বিয়োগের শোকও সামলাতে হয় তাঁকে। বীর যোদ্ধার পাশাপাশি অমর মাণিক্য একজন প্রজাকল্যাণকামী রাজা ছিলেন। সিংহাসনে বসার পর তিনি প্রজাদের জলকষ্ট দূর করতে বিরাট এক সরোবর খনন করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩০: বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

এই সরোবরের পাড়ে বিচিত্র কারুকার্যময় একটি ত্রিতল অট্টালিকা নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। হয়তো বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য রাজা উদয়পুরের কিছু দূরে তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাহাড় প্রতিরক্ষার প্রাচীর হবে, হয়তো এই উদ্দেশ্য নিয়েই দেবতামুড়ার পাশে রাজা তাঁর নতুন রাজধানীর পত্তন করেছিলেন। মহারাজার নামানুসারে এই জনপদের নাম হয়েছিল অমরপুর। চট্টগ্রাম নিয়ে আরাকান রাজার সঙ্গে যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর তিনি সপার্ষদ রাজধানী ছেড়ে চলে যান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে। সেখানে মণু নদীর পাড়ে স্হাপন করেন অস্হায়ী রাজপাট।

চট্টগ্রাম যুদ্ধ ক্ষেত্রে আরাকান রাজা প্রেরীত এক মুকুটকে কেন্দ্র করে কলহ বাঁধে অমর মাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে।আর এর পরিণতিতেই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটে রাজার।মুকুট গল্প ও নাটকের মাধ্যমে এই ঘটনা উজ্জ্বল হয়ে আছে রবীন্দ্র সাহিত্যে।দুর্ভাগ্যপীড়িত রাজা অমর মাণিক্য শেষপর্যন্ত আফিম সেবনে আত্মহত্যা করেছিলেন।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content