রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

হৃদয় হোক প্রভুর আশ্রয়স্থল। যেখানে প্রভু নিশ্চিন্তে আসতে পারেন, থাকতে পারেন। আর বাসগৃহ মন্দির হোক, যেখানে প্রভু ও প্রভুর ভক্তেরা নিশ্চিন্তে আনাগোনা করতে পারেন, থাকতে পারেন। ভাবনা ও উদ্বেগহীন দিন কাটাতে পারেন। এমনই প্রভুর ইচ্ছা হোক, যা ভক্ত পূরণ করতে পারে। যদিও তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন না, কিন্তু যদি করে থাকেন তা পূরণ করতে অকুণ্ঠচিত্তে অগ্রসর হয়। এমনই ভক্তের লক্ষণ। ভগবান এমন ভক্তেরই বোঝা বয়ে চলেন, ভক্তেরও ভক্ত হয়।
অবনত মস্তক করা সকলের জন্য নয় যেমন, আত্মসমর্পণের কাজও সহজ নয়। পূর্ণ সমর্পনে আপনাআপনি গুরু তথা প্রভুর চরণে লুটিয়ে পড়া যায়। সে যতই অর্থবল বা লোকবল থাকুক না কেন, তার অসারত্ব যতক্ষণ না উপলব্ধি হয়, ততক্ষণ সে ভাব আসতে পারে না। যাতে সমস্ত হৃদয় নিগড়ে তার নির্যাস দিয়ে যেন গুরুর চরণ ধুয়ে দেওয়া যেতে পারে। অহংকার সর্বস্ব জীবন, আর নাম যশ আকাঙ্ক্ষা মনুষ্য সমাজের দুই প্রতিপত্তি। এর অন্ত নাই, কিরূপে সূক্ষ্মভাবে সমাজের চক্রকে ঘুরিয়ে চলেছে আমরা টের পাই না। তিনি দেখেন হৃদয়ের অন্তস্থলে তাঁর জন্য কতটা জায়গা রাখা রয়েছে। না সেখানে অহংকার ও আকাঙ্ক্ষা জায়গা করে বসে রয়েছে। এরকম প্রভু তথা গুরুর প্রতি অনুরাগ হোক, “যা কিছু মোর সবই তোমার”, এ ভাবে উৎসর্গকৃত জীবন ও তার ভক্তের প্রতি সমান দৃষ্টি ও প্রেম সম্পন্ন।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫৯: অনেক সাধনা করলে তবেই ঈশ্বরের কাছে মনকে অর্পণ করা যায়

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

শ্রীরামকৃষ্ণ এমন এক মণ্ডলীতে রয়েছেন, যিনি বলরামবাবু নামেই পরিচিত। যাঁর হৃদয়ে যেমন প্রভু নিত্য লীলা করতেন, তেমন তার গৃহও সমান ভাবে প্রভুর আগমনের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকত। হৃদয় ও গৃহকে সমানভাবে শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর ভক্তদের জন্য সমানভাবে খুলে দিয়েছিলেন। আর বলতে হয় চিরকালের জন্য আজও তাঁর গৃহ ভক্তদের আনাগোনার জন্য খোলা রয়েছে। ধন্য বলরাম আজ তাঁর গৃহ মন্দির হয়েছে। যেমন শত শত ভক্তের আনাগোনায় পূর্ণ হয়েছে প্রভুর ইচ্ছা আর ভব রোগের চিকিৎসার জন্য উৎসর্গকৃত। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে রসদদার বলতেন। আজও তিনি আড়ালে থেকে রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর গৃহে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কতদিন পদার্পণ করেছেন, রাত্রি বাস করেছেন তার ঠিক নাই। ভক্তের হৃদয়ে ভগবানের বৈঠকখানা আর বলরামের গৃহ ছিল ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের বৈঠকখানা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন

শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ বা সামান্যতম বাক্যেরও তিনি অবজ্ঞা করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, বলরাম পরম বৈষ্ণব, তার পিতাও বৈষ্ণব। কিন্তু বৈষ্ণবের একঘেয়েমি ভাব থেকে সরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতের লোকের প্রতি সমান ভাব সম্পন্ন করানো ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি কারও ভাব নষ্ট করতেন না কিন্তু সেই ভাবের উৎকর্ষ আরও কীভাবে বাড়ানো যায় সেই দিকেই চেষ্টা করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “সব মতে লোকেরা আপনার মতটাই বড় করে গিয়েছে।” বলে একটি গল্প বলছেন, “শাক্তরাও বৈষ্ণবদের খাটো করার চেষ্টা করে, শ্রীকৃষ্ণ ভব নদীর কাণ্ডারী, পার করে দেন—শাক্তরা বলে, “তা তো বটেই। মা রাজরজেশ্বরী তিনি কি আপনি এসে পার করবেন? ওই কৃষ্ণকেই রেখে দিয়েছেন পার করবার জন্য।”
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: ফে স ডা উ ন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

এ বাকযুদ্ধ এমনই, সেই যুদ্ধের মতো রাম আর শিবের। রাম আর শিবের বেশ যুদ্ধ হল। তাঁদের মিটমাট হয়ে গেল। রামের গুরু শিব আর শিবের গুরু রাম। কিন্তু তাঁর চেলাদের গন্ডগোলা আর থামে না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “যে সমন্বয় করেছে, সেই লোক। অনেকেই একঘেয়ে। আমি কিন্তু দেখি সব এক। শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত সব সেই এককে লয়ে। যিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার তারই নানা রূপ। বেদে যাঁর কথা আছে, তন্ত্র তাঁরই কথা, পুরাণেও তাঁরই কথা। সেই এক সচ্চিদানন্দের কথা। যারই নিত্য, তারই লীলা।”

এ হল সমন্বয়সূত্র। উপলব্ধির বিষয়। যিনি অনুরাগ চিত্তে অনুধাবন করেন, তিনি এ সত্যই উপলব্ধি করতে পারেন। এ অপূর্ব সত্য অনুভূতির অপূর্ব আনন্দ তিনি বলরামকে পান করিয়েছিলেন। বলরামের গৃহ যখনই যেতেন, সদা ভগবত আনন্দে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন।

তিনি বলতেন, “সর্বদাই স্মরণ মনন থাকা উচিত।” জ্বলন্ত বিশ্বাস থাকলে যেমন মন কিছুতেই টলে না। ভক্তির তম চায়। যেন ডাকাত পড়া ভক্তি। বলরাম ভক্তি, ভক্তির সত্ত্ব। বলরাম গৃহ যেন, সেই অদ্বৈত আঙ্গিনায় শ্রীনিবাস, আদি ভক্তের সঙ্গে শ্রীপ্রভুর আনন্দে নৃত্য ও নিত্য বিহারের সম্পূরক।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content