মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর, ২০২৪


এই সেই ভাটুরা জংশন।

চণ্ডীগড়ে কনফারেন্সে গিয়েছিলাম চারদিনের জন্য। তৃতীয় দিনে উদ্যোক্তারা ঠিক করলেন আমাদের সকলকে চণ্ডীগড়ের‘ সেক্টর সেভেন্টিন’-এ শপিংয়ে নিয়ে যাবে। সেক্টর সেভেন্টিনকে চণ্ডীগড়ের হার্ট বলা যায়। এখানে সবরকম দোকান আছে। খাবার দোকান তো প্রচুর। ১৯৮১ সালের জুন থেকে ১৯৮৩ এর ডিসেম্বর অবধি আমি চণ্ডীগড়ে ছিলাম পিজিআই মানে পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউটে এমএস করতে। মনে আছে হাওড়া থেকে কালকা মেলে উঠে দিল্লি হয়ে আম্বালা স্টেশনে নেমে অটো ধরে চণ্ডীগড়ে পৌঁছেছিলাম।

হাওড়া স্টেশনে আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাতে এগারো জন এসেছিল। আমি কবিতা ছেড়ে, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে চণ্ডীগড় যাচ্ছি কেন অনেকে বুঝতে পারছিল না। কলকাতায় কি পোস্ট গ্রাজুয়েট করা যেত না। দুই রাত ট্রেনের আপার বাঙ্কে শুয়ে এটা সেটা ভাবতে ভাবতে ভোর রাতে আম্বালা স্টেশনে পৌঁছলাম। সঙ্গে টিনের বাক্স, একটা মাদুর আর সঞ্চয়িতা (অনেকটা সেই অপুর সংসারের অপুর মতো)। ভর্তির কাজকর্ম সেরে ওখানকার কায়রন ব্লকের পাঁচ তলায় রুম পেলাম। রুম নম্বর ৫৫১। এখনকার মতো তখন লিফট-টিফট ছিল না।
ফার্স্ট ইয়ার মানে সব থেকে উঁচু তলা। ছাতে পণ্ডিতজির ক্যান্টিন। নিরামিষ। তবে ডিমের ভুজ্জি পাওয়া যেত। জীবন ছিল বেশ কঠিন। কনকনে ঠান্ডার সকালে সাড়ে ছটায় পৌঁছতে হবে আই ডিপার্টমেন্টের ওয়ার্ডে। একটা ছোট্ট কার্ড বোর্ডের বাক্সে ছয় রকমের ড্রপ। অপারেশন করা পেশেন্টদের চোখের পট্টি খুলে ড্রপ দেওয়া। সকালে ক্লাস সাতটায়। তারপর ওপিডি-তে রোগী দেখা। পাঞ্জাবি ভাষাটা অত শক্ত নয়। শুধু ক কে কাক্কা, খ কে খাখখা বলতে হবে। একটা ক ওদের পক্ষে যেন যথেষ্ট নয়। আর গুড মর্নিং-এর জায়গায় সতশ্রী গাল। ব্যাস। সোম থেকে শনিবার ফুল ডিউটি। রবিবার শুধু সকালটা। মাঝে মাঝে এক সপ্তাহ অন-কল। হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে না। তবে রবিবার বিকেলটা ফাঁকা। মুক্ত বিহঙ্গ।

ওই রবিবার বিকেলে সেক্টর সেভন্টিনে যেতাম। পকেটে রেস্ত ছিল না। নশো টাকা স্টাইপেন্ড। ঘুরতে ঘুরতে দোকান দেখা। ঘোরা-টোরা শেষ করে যেতাম আমার ফেভারিট ফুড জাংশনে। নাম ভাটুরা জংশন। এখন মনে নেই ঠিক কত টাকা লাগতো দুটো ভাটুরার। তবে সেই ছোলা ভাটুরার স্বাদ এখনও মনে আছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে যেতাম বলে দোকানের মালিকের সঙ্গে একটু সখ্যতাও হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা বলছি।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

কনফারেন্স কো-অর্ডিনেটর বলে দিয়েছিলেন, আমাদের গাড়ি ডেলিগেটদের সেক্টর সেভেন্টিনের মুখে ছেড়ে দেবে সন্ধে ছটায়। তারপর যা খুশি করতে পারো। ৮টার মধ্যে ফিরে আসলেই হবে। এগারোটা দেশ থেকে ৭৫ জন তরুণ চিকিৎসক এসেছেন। তাঁরা তো খুবই খুশি। সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছটা অবধি ওঁদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে এই কদিন। এ বার একটু মুক্তি। ঠিক এরকমই মনে হতো আমার বিয়াল্লিশ বছর আগে। সারা সপ্তাহ কাজ করে রবিবার বিকেলে পিজিআই হাসপাতাল থেকে খানিকটা হেঁটে বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাস ধরে সেক্টর সেভেন্টিনে। তারপরে পায়ে হেঁটে সেই ভাটুরা জংশন।

সেক্টর সেভেন্টিনে নেমে ডেলিগেটরা খুঁজছিলেন ড্রেস ম্যাটেরিয়াল। কে যেন বলে দিয়েছিলেন, এখানে খুব ভালো এথনিক ড্রেস পাওয়া যায়। যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁরা ওই সব দোকানই খুঁজছিলেন। আমার মন আছে, সেই ভাটুরা জংশন খুঁজে পাবার জন্য। বিয়াল্লিশ বছর আগে ওই দোকানটাই ছিল আমার লক্ষ্যস্থান। সারা সপ্তাহ হাসপাতালের ক্যান্টিনের শক্ত ছোলার ডাল, রাজমা আর আধ পোড়া রুটি খেয়ে ক্লান্ত আমি যেন ভাটুরা জাংশনের ওই দুটো ভাটুরা আর ছোলাকে অমৃত মনে করতাম।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

টয়োটা ইনোভাতে আমিও ডেলিগেটদের সঙ্গে উঠে পড়লাম। হিন্দিতে চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, সেক্ট্রর সেভেন্টিনের ভাটুরা জংশন দোকানটা এখনও আছে কি না। ঠিক বলতে পারল না। এমনকি সেক্টর সেভন্টিনের বড় রেমন্ড শো দোকানের কর্মচারীও বলতে পারলেন না। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে একজন বলতে পারলেন। ওই যে আলো জ্বলছে দোকানগুলো, তার পিছনে একটা ভাটুরার দোকান আছে। তবে তার নাম ভাটুরা জংশন কিনা তা বলতে পারবো না। এখন লোকে খোঁজে পিৎজা, বার্গার, রোল। ইয়াং জেনারেশনের কাছে ভাটুরার তেমন কদর নেই। ভাবলাম চান্স নিয়েই দেখি না একবার। সেই আলো জ্বালা দোকানগুলোর পিছনে সত্যিই পেয়ে গেলাম অল্প আলোয় টিমটিম করে জ্বলা সাইন বোর্ড ভাটুরা জাংশন। মনে হল ইউরেকা ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠি আর্কিমিডিসের মতো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

হ্যাঁ, দোকানটা এখনও আছে। তবে মনে হল একটু যেন ম্লান, বিষণ্ণ। ভিতরে দেখলাম একটা জিন্স পরা মেয়ে মালিকের জায়গায়, ভিডিয়ো দেখছে। যেন একটু উদাসীন। দোকানের একজনই কর্মচারী কাম কুক। তিনিই জিজ্ঞেস করলেন, আপ ভাটুরা লেঙ্গে? হানড্রেড অ্যান্ড টুয়েন্টি—এক প্লেট। তিনি অপেক্ষা করছিলেন আমার উত্তরের জন্য। আমার মন তখন চলে গিয়েছে বিয়াল্লিশ বছর পিছনে, রবিবারের সন্ধেবেলায়। মেয়েটা ওঠেনি সিট থেকে। নিলাম এক প্লেট ভাটুরা, একটা কাপ মশলা চা, আর এক বোতল বিসলারি জল। সেই সময় বিসলারি ছিল বিদেশিদের জন্য। আমরা কাচের জাগ থেকে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে জল খেতাম। ভাটুরার সেই স্বাদ এখনও একটুও পাল্টায়নি।

ভাটুরার সেই স্বাদ এখনও একটুও পাল্টায়নি।

দোকান থেকে বেরনোর আগে মনে হল জিজ্ঞেস করি, দোকানের মালিক কি এখনও আছেন? বোধ হয় এই মেয়েটি ওই মালিকেরই কন্যা হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, মালিক কোথায়? মেয়েটি বলল, পাপা থোড়ি বাহার গয়া হ্যায়। আজকাল কম আতে হ্যায়। ভেবেছিলাম, হয়তো শুনবো পাপা গুজর গিয়া হ্যায়। এখন তাঁর বয়স তো আশির কাছে হবার কথা। মেয়েটিকে বললাম, ম্যায় চেন্নাই সে আয়া হুঁ। বিয়াল্লিশ সাল পহেলে ম্যায় ইসি দুকান মে হর হপ্তে আতে থি। মেয়েটার চোখ এ বার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করলাম, আপকি পাপা ক্যায়সে হ্যায়। বলল, আছছা হ্যায়। জানতে চাইলাম, দোকানকা ফটো লে সকতা হ্যায়। মেয়েটা বলল, ম্যায় লেতা হু। আপ খাড়া হো যাইয়ে। হ্যাঁ, ছবি নিলাম দোকানের সামনে। একটু অন্ধকার। তবু ছবি ভালোই এল।

বিয়াল্লিশ বছর পরে সেই দোকানের সামনে আইপ্যাডে ছবি। উপরে সাইন বোর্ড, হলুদ ব্যাকগ্র্যাউন্ডে কালো অক্ষরে ইংরেজি ও পঞ্জাবিতে লেখা আছে ‘ভাটুরা জংশন’। ফিরতে হবে হোটেলে। ঘোরার জন্য দু’ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ ছিল। ডেলিগেটরা এখনও শপিং করছেন। ওঁরা আগেই প্ল্যান করে নিয়েছেন কী কী কিনবেন। আমার আর কিছু চাই না। মনে হল, স্মৃতি তুমি সতত সুখের। চণ্ডীগড়ে এলে আবার আসব এই ভাটুরা জংশনে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে এক প্লেট ভাটুরা। ততদিন থাকবে তো দোকানটা?

ছবি: লেখক
* ডাঃ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেন ডাকনামে। ‘সবুজ বিশ্বাস’ নামে তিনি একাধিক সাহিত্যকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাচিক শিল্পেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই মুহূর্তে বাচিকশিল্পে আমাদের রাজ্যে যাঁরা স্বনামধন্য, তাঁরা অধিকাংশই ডাঃ বিশ্বাসের বন্ধুস্থানীয়। ছাত্রজীবনে, এই শহরে এমবিবিএস পাঠকালে একসঙ্গে এ-মঞ্চে, সে-মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পরে পেশাগত কারণে বিদেশযাত্রা ও গবেষণাকর্মের শেষে শংকর নেত্রালয়ে যোগদানের ফলে সেই বাচিকশিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। চেন্নাই শহরের বাঙালিসমাজের যে কোনও অনুষ্ঠানে অবশ্য এখনও তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ডাঃ বিশ্বাস চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামধন্য। ভারতের প্রথম শ্রেণির একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের অন্যতম ডিরেক্টর।

Skip to content