শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অ্যারোমাথেরাপির সাত সতেরো ছবি: সংগৃহীত

ইজিপ্টের মহারানি ক্লিওপেট্রার নাম ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে তার বুদ্ধি ও সৌন্দর্যের জন্য। ক্লিওপেট্রা কেবলমাত্র পুরুষ সমাজের কাছে নয়, নারীদের কাছেও ছিলেন সমান আকর্ষণীয় ও ঈর্ষণীয়। প্রাণোচ্ছল ও সৌখিন এই রমণী নিজের রূপ-যৌবন সর্বদা ধরে রাখার জন্য ভরসা রাখতেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভেষজ এবং সুগন্ধি চর্চা বা অ্যারোমাথেরাপিতে। শোনা যায়, রানি যখন মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, তখন জাহাজ বোঝাই করে সুগন্ধি নিয়ে যেতেন এবং জাহাজের পাল সুগন্ধি দ্রব্যে সিক্ত করে নিতেন। এটি চারিদিকে মহারানীর আগমনবার্তাকে ছড়িয়ে দিত।

অত্যন্ত পুরাতন এই পদ্ধতি প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আদৃত। সুপ্রাচীনকালে ভারত, চিন-সহ মিশরে এই থেরাপি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই থেরাপি আমাদের ঘ্রাণের অনুভূতি দ্বারা মানসিক অবস্থাকে উদ্দীপিত করে এবং আমাদের একটি আরামদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করে; যা মনসহ শরীরকে সুস্থ রাখতে যথেষ্ট কার্যকর। সন্ধ্যায় বাড়িতে জ্বালানো সুগন্ধি ধূপ সত্যিই আমাদের মনকে অন্য জগতে নিয়ে যায়, রাত্রে ঘরে থাকা একগুচ্ছ জুঁইফুল আমাদের অতি সহজে নিদ্রার জগতে প্রবেশ করায়।

পোশাক-পরিচ্ছদ বা শাড়ি আয়রন করার সময় জলের সাথে দু’ ফোটা চন্দনের গন্ধ মিশিয়ে দিলে সহযাত্রীর মনেও একটি ভিন্ন বার্তা বহন করে। ঘামের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য আজ থেকে বহু বছর আগে থেকেই আতর সহ বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এগুলিই বডি স্প্রে বা ডিওড্রেন্ট হিসাবে বাজারে বিক্রি হয়। ঠাকুর মন্দিরে বা কোন উপাসনাগৃহে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ফুল রাখার চল বহু বছরের পুরনো। এই সুগন্ধি আমাদের অনুভূতির উচ্চতম মার্গে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
বর্তমানে যে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি তেল ব্যবহার করা হয়, সেগুলি এসেন্সিয়াল অয়েল বা অপরিহার্য তেল নামে পরিচিত। ক্লারিসেজ, টি ট্রি, ইউক্যালিপটাস, অরিগ্যা নো, লেমন, পিপারমেন্ট, দারুচিনি, ফ্রাঙ্কলিনসেন্সরের মতো বিভিন্ন অপরিহার্য তেল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অভূতপূর্ব সাহায্য করে যা, আজ পরীক্ষালব্ধ সত্য । অ্যারোমাথেরাপি সাধারণত রিলাক্সেশন টেকনিক হিসাবে পরিচিত। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করে ওষুধের বিকল্প হিসাবে বর্তমানে অ্যারোমা থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা যেতে পারে, পুরনো এই থেরাপি আবার নতুন মোড়কে ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি, এই থেরাপি বিজ্ঞান ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

অত্যন্ত জটিল এই সময়ে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগমুক্ত করে মনকে শান্ত রাখতে ও ঘুমের মানকে উন্নত করতে অ্যারোমা থেরাপির জুড়ি মেলা ভার। মুখের বলিরেখা দূর করে মুখ তথা সর্বোপরি ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে বিভিন্ন ধরনের এসেন্সিয়াল অয়েল, যা মূলত অ্যারোমাথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়। বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনে ভ্রমণের সময় যে বমি বমি ভাব দেখা যায়, এছাড়াও কেমোথেরাপি প্রয়োগের পর বমন ইচ্ছাকে প্রশমিত করতে ও রক্তচাপ কমাতে ল্যাং ল্যাং এবং ল্যাভেন্ডার ব্যবহৃত হয়।

ব্যথা দূর করতে, রক্ত চলাচলের সাথে আরোগ্য লাভ ও উন্নততর স্মৃতিশক্তি করতে সেজ অয়েল ব্যবহার করা হয়। চাপ, ধকল ও বিষন্নতা দূর করে রাত্রে ভালো ঘুম আনতে জেসমিন অয়েল ব্যবহৃত হয়। মুখে ব্রনের দাগ দূর করতে টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে ও মরিঙ্গা মুখের বলিরেখা দূর করে। সানবার্ন জনিত কালো দাগ কমাতে ক্যা মোমাইল, ল্যাভেন্ডার ও পিপারমেন্ট অয়েল খুবই কার্যকরী। মহিলাদের পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথা, বেদনা ও ক্লান্তিনাশ করে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্লারিসেজ এবং গেরানিয়ামের অ্যারোমাথেরাপি খুবই কার্যকর।
আরও পড়ুন:

বিপন্ন বাংলার রাজ্যপশু বাঘরোল

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

বর্ষা এবং শীতকালে মেয়েদের চুল পড়া থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ পিপারমেন্ট, রোজমেরি ও ল্যাভেন্ডার তেল নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে চুলে ম্যাসাজ করে এবং তাদের মতামত অনুসারে জানতে পারা যায় এ থেকে তাদের চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চুল পড়া অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। এছাড়াও লেমনগ্রাস অয়েল খুশকি দূর করতে খুব কার্যকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একজন ফরাসি শল্যচিকিৎসক বিভিন্ন আহত, ক্ষতবিক্ষত সৈনিকদের ক্ষত সারাতে ও ক্লান্তি নাশ করতে অ্যারোমাথেরাপির শরণাপন্ন হয়েছিলেন, তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন।

ঘর পরিষ্কার করার পর, আমিষ জাতীয় খাবার পর টেবিলের আঁশটে গন্ধ এবং ফ্রিজের গন্ধ দূর করতে কয়েক ফোঁটা ল্যা ভেন্ডার ও ইউক্যালিপটাস তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। স্নানের সময় ব্যবহৃত জলে দু-এক ফোঁটা গোলাপজল মিশিয়ে নিলে দেহ-মনে একটি তরতাজা ভাব আসে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

ব্রিটেন এবং আমেরিকাসহ ধনী ও উন্নত দেশগুলিতেও অ্যারোমাথেরাপির যথেষ্ট কদর আছে। ‘দি ন্যা শানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর হলিস্টিক অ্যারোমাথেরাপি’ একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা আমেরিকাতে অ্যারোমা থেরাপির উপর দীর্ঘদিন ধরে নানান কাজ করে আসছে। এছাড়াও ব্রিটেনে অবস্থিত ‘ব্রিটিশ অ্যারোমা থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন’ যথেষ্টই সুনামের সঙ্গে কাজ করে।

ভারতেরও একাধিক ধরনের অ্যারোমাথেরাপির সেন্টার রয়েছে। শুধু আধুনিক সময়ে নয়, প্রাচীন ভারতেও অ্যারোমাথেরাপির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ বৎসর আগে ঋকবেদে অ্যারোমাথেরাপির উল্লেখ আছে। ভারতে আয়ুর্বেদ ও শল্যূ চিকিৎসার জনক চরক ও সুশ্রুতের লিখিত বই ‘চরক সংহিতা’ ও ‘সুশ্রুত সংহিতা’তে বিভিন্ন গাছগাছালি, ফুলের মাধ্যমে অ্যারোমা থেরাপি করা হতো বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

রামায়ণে যখন রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ শক্তিশেল দ্বারা লক্ষণকে বিদ্ধ করে, তখন জ্ঞানহারা লক্ষণ মৃতসঞ্জীবনীর গন্ধ নিয়ে আবার জ্ঞান ফিরে পান, এটি একপ্রকার অ্যারোমাথেরাপি বলেই মনে হয়। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে এই থেরাপির সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। একবার বিশেষ কারণে গৌতম বুদ্ধের ‘ক্ষুদ্রান্ত বন্ধ’ হয়ে গেলে জীবক তাঁকে তিনটি বড় পদ্মের গন্ধ নিতে বলেন। এরপর বুদ্ধ এই রোগ মুক্ত হন। একবার দেবদত্ত বুদ্ধকে পাথর দ্বারা আঘাত করলে, তার পায়ে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। জীবক এই ক্ষত বিভিন্ন গাছের রস এবং কিছু এসেন্সিয়াল অয়েল বা অপরিহার্য তেল দিয়ে তাকে জীবানু নাশ করে। ধীরে ধীরে সেই ক্ষত ভালো হয়ে যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অপরিহার্য তেল ব্যবহৃত হতো এবং সম্রাটেরা প্রত্যেকেই অ্যারোমাথেরাপির কদর করতেন।

তবে তারা এই থেরাপি মন ভালো রাখার জন্যই প্রধানত ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। আকবরের স্ত্রী সালিমা সুলতান বেগম ‘রোজ এসেন্সিয়াল অয়েল’ তৈরি করেন পরে তা ‘জাহাঙ্গীরের সুগন্ধি’ নামে খ্যাতি লাভ করে। মুঘল যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লেখা থেকেও মুঘল সাম্রাজ্যের অ্যারোমাথেরাপির নানান খুঁটিনাটি তথ্য জানা যায়। সুতরাং বহুপরীক্ষিত অ্যারোমা থেরাপি বা সুগন্ধি চিকিৎসা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে পারে। যতই বিজ্ঞানীরা একে সিউডোসাইন্স বা ছদ্মবিজ্ঞানের চিকিৎসা পদ্ধতি তকমা দেগে দিক না কেন, এই থেরাপি চিরশাশ্বত।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content