গীতা শর্মা।
পরের জা’গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই… মেয়েদের নিজস্ব কোনও জায়গা নেই। ভার্জিনিয়া উলফের এ প্রসঙ্গে লেখা ‘A Room of one’s own’ মনে পড়ল। কিছু কিছু মেয়ে নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল নয়। সর্বস্ব দিয়ে মানিয়ে নেওয়াই বেঁচে থাকার নাম তাদের। যে মেয়েটি নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে নিজেকে ক্রমাগত খাপ খাওয়াতে খাওয়াতেই জীবন শেষ করে ফেলল, তার জন্যই এত কথার অবতারণা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা—এই মতে বিশ্বাসী বাবার আটটি কন্যার পর পুত্র। কয়েকটি কন্যা জন্মানোর সময়ই মারা যায়। সব মিলে পাঁচ জন রইল। তারপর দুই ছেলে। এদিকে আয় সামান্য। অর্ধাহারেই কাটে দিন।
মেজ মেয়েটি মাছ খেতে বড় ভালোবাসে। ঠাকুমা বলেন, আগের জন্মে বেড়াল ছিল। তবে এ জন্মে মাছ তো কালভদ্রে জোটে। যদি পাশের পুকুরে ছিপ ফেলে দু’ একটা ল্যাটা, পুঁটি জোটে…তার থেকে বাবার পাতেই যায়। ঝটতি-পড়তি থেকে একটু পেলেই কি আহ্লাদ মেয়েটির। কোনওরকম ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনো। তারপর বিয়ের অপেক্ষা। নিঃসম্বল মেয়েকে কে বিয়ে করবে? বাবা- মায়েরও গরজ নেই। মেয়েটি সুন্দর ও খুব শান্ত স্বভাবের। প্রতিবেশীদের একজন দয়া করে এক পাত্র আনলো। প্রবাসী, অবাঙালি। হিন্দি ভাষী। মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র এর কাছে মোরেনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের। এখনকার মোরেনা নয়। পঞ্চাশ বছর আগের। কোনওরকমে বিয়ে সারা হল। তারপর মেয়ে রওনা হল নতুন শ্বশুরবাড়ি।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৬: ত্রিবেণী শক্তি
মুভি রিভিউ: মিথ না মিথ্যা? কোনটা বেশি সিরিয়াস? প্রশ্ন তুলল নওয়াজউদ্দিনের ‘সিরিয়াস মেন’
কোথায় কোন পরিবারে চললো কারও মাথাব্যথা নেই। বাড়ির একটা বোঝা নামলো। একা মেয়ে পাড়ি দিল অজানা দেশে, অচেনা এক স্বামী ও পরিবারে। তাদের ভাষাটিও সে জানে না।
বিয়েতে মেয়েরা ঢোলক বাজিয়ে নাচ গান করে। নববিবাহিতা বউও। তাই করল সে সবার দেখা দেখি। শ্বশুরবাড়ির কারও ভাষা বুঝতে পারে না। আকার ইঙ্গিতে বোঝায়। খুব কষ্ট হয় কথা বুঝতে ও বোঝাতে। ছোট ছোট ঘর। জানালা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন স্বামীর কাছেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারতো না। স্বামীর সঙ্গে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া কোনও সখ্য গড়ে ওঠে না। চোখে জল আসতো। নীরবে আড়ালে গিয়ে সাক্ষীবিহীন চোখের জল ফেলতো।
প্রচণ্ড গরম সেখানে। আমিষ খায় না সে বাড়ির লোকেরা। অনেক গরু মহিষ গোয়াল ভরা। রান্নাবান্না, গরু মহিষ দেখা এসব বউয়ের কাজ। বৃদ্ধ শ্বশুর আছেন। শাশুড়িও। মনে মনে দিন গোনে কোনদিন দেশে যাবে। বাপের বাড়ি যাবে। দেশের লোকজনের তো দেখা মেলে না। বাংলা কথাও শোনা যায় না। তখন মোবাইল এসছে দু’ একটি বড়লোক বাড়িতে। তাদের নেই। তাই পুরো বিচ্ছিন্ন পুরোনো জগৎ থেকে।
প্রথম সন্তান হওয়ার পর দেশে এসেছিল। ততদিনে মানিয়ে নিতে নিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার। সে ভুলে গিয়েছে তার ভালোবাসার মাছের কথা। সত্যিটা সে জেনে গিয়েছে। তার গোবর, ঘুঁটে, গরু, নিরামিষ খাবার, এসব নিয়েই সংসার। তবে এ সংসারে সে পেট ভরে খেতে পায়। রুটি, দুধ। খাদ্যাভ্যাস পাল্টে গিয়েছে। কথাতেও হিন্দির মিশেল। নিজেকে ওই সংসারের মতো তৈরি করে। ছেলেকে পড়াশুনো শেখায়। ছেলে চাকরি করবে। শহরে বাসা করবে। মা তখন এ জীবন থেকে মুক্ত হবে। ছেলে তাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে। অনেক পয়সা নিয়ে বাপের বাড়ি যাবে। এ সব কথা তার এক প্রবাসী বোনকে বলেছিল যখন ছেলে মাকে অন্য এক বাড়ি থেকে ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল।
বিয়েতে মেয়েরা ঢোলক বাজিয়ে নাচ গান করে। নববিবাহিতা বউও। তাই করল সে সবার দেখা দেখি। শ্বশুরবাড়ির কারও ভাষা বুঝতে পারে না। আকার ইঙ্গিতে বোঝায়। খুব কষ্ট হয় কথা বুঝতে ও বোঝাতে। ছোট ছোট ঘর। জানালা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন স্বামীর কাছেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারতো না। স্বামীর সঙ্গে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া কোনও সখ্য গড়ে ওঠে না। চোখে জল আসতো। নীরবে আড়ালে গিয়ে সাক্ষীবিহীন চোখের জল ফেলতো।
প্রচণ্ড গরম সেখানে। আমিষ খায় না সে বাড়ির লোকেরা। অনেক গরু মহিষ গোয়াল ভরা। রান্নাবান্না, গরু মহিষ দেখা এসব বউয়ের কাজ। বৃদ্ধ শ্বশুর আছেন। শাশুড়িও। মনে মনে দিন গোনে কোনদিন দেশে যাবে। বাপের বাড়ি যাবে। দেশের লোকজনের তো দেখা মেলে না। বাংলা কথাও শোনা যায় না। তখন মোবাইল এসছে দু’ একটি বড়লোক বাড়িতে। তাদের নেই। তাই পুরো বিচ্ছিন্ন পুরোনো জগৎ থেকে।
প্রথম সন্তান হওয়ার পর দেশে এসেছিল। ততদিনে মানিয়ে নিতে নিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার। সে ভুলে গিয়েছে তার ভালোবাসার মাছের কথা। সত্যিটা সে জেনে গিয়েছে। তার গোবর, ঘুঁটে, গরু, নিরামিষ খাবার, এসব নিয়েই সংসার। তবে এ সংসারে সে পেট ভরে খেতে পায়। রুটি, দুধ। খাদ্যাভ্যাস পাল্টে গিয়েছে। কথাতেও হিন্দির মিশেল। নিজেকে ওই সংসারের মতো তৈরি করে। ছেলেকে পড়াশুনো শেখায়। ছেলে চাকরি করবে। শহরে বাসা করবে। মা তখন এ জীবন থেকে মুক্ত হবে। ছেলে তাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে। অনেক পয়সা নিয়ে বাপের বাড়ি যাবে। এ সব কথা তার এক প্রবাসী বোনকে বলেছিল যখন ছেলে মাকে অন্য এক বাড়ি থেকে ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়
দুটি ছেলে তার। এতদিনের বড় হওয়ার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পরিবেশকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে অহর্নিশি। নিজের কথা বলার, শোনার, বোঝার লোক নেই। হাড়ভাঙা খাটুনিতে কঙ্কালসার চেহারা। কেমন আছে সে? কেউ জানতে চায়ও না। সেও রূপান্তরিত হয়ে উঠল। যেন দুটি জন্ম। একই মেয়ের। বাপের বাড়ি, কলকাতা, বাংলাভাষা, সব ভুলতে লাগলো। ছেলে বড় হয়ে প্রবাসী মাসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। মায়ের কথা জানায়। তার মাকে মারণ রোগে ধরেছে। জানতে পারেনি। ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। একদিন মা তার না ফেরার দেশে চলে গেল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৮: হঠাৎ গলায় হাত দিয়ে দেখি কোনও অনুভূতি নেই!
এখন মায়ের ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। ছেলে গোয়ালিয়র শহরে স্কুল মাস্টার। বাড়িও হয়েছে আধুনিক। কিন্তু মাকে আর সে বাড়িতে আনার সুযোগ হয়নি। তার বাপের বাড়ি নেওয়া হয়নি। প্রবাসী মাসির সঙ্গে অনেক না বলা কথা বলা হয়নি। ছেলে বলেছে, মায়ের কথা, কেমনভাবে মা তাকে এগোনোর শক্তি জুগিয়েছে সে সব কথা বলবে। মাসির কাছে বসে। অন্যদিকে শুনবে মায়ের ছোটবেলার কথা, তার বাড়ির কথা। মাসি সে অপেক্ষায় আছে।
রূপান্তরী সেই মেয়েটির নাম গীতা শর্মা।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।