শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

১৭ পৌষ, (৩ জানুয়ারি) পরমারাধ্যা সারদা মায়ের পূত জন্মতিথি। আমার আজকের লেখাটি শ্রীমায়ের পাদপদ্মে অর্পণ করলাম।

বৃন্দাবনে যাওয়ার আগে মা সারদা ও তাঁর সাথীরা বৈদ্যনাথধাম দর্শন করেন। দেওঘরে নেমে তীর্থদর্শন করে পরের গাড়িতে সকলে কাশীধামে যান। সেখানে তিনদিন থেকে তীর্থ দর্শন করেন। বাবা বিশ্বনাথের আরতি দেখে কাশীতে শ্রীমার ভাবসমাধি হ্য়। ভাবের ঘোরে দুম দুম শব্দে পা ফেলে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। তাঁর ভাবের ঘোর কাটার পর বলেছিলেন যে, ঠাকুর তাঁর হাত ধরে মন্দির থেকে নিয়ে আসেন।

সকলে একদিন কাশীর সচল ভৈরব ত্রৈলঙ্গস্বামীরও দর্শন করে আসেন। দেখে মনে হয়েছিল নির্লিপ্ত মহাযোগী, শীতোষ্ণ সব ঋতুতেই নির্বস্ত্র। দেহাতীতবোধের সীমায় গেলে এরূপ অবস্থা হয়ে থাকে। এখান থেকে মা সারদা সহ সাথীরা গেলেন শ্রীরামের লীলাস্থলী অযোধ্যাপুরীতে। একসময় এই সকল তীর্থ স্থান মথুরবাবুর সঙ্গে ঠাকুর দেখেছিলেন।
আজ শ্রীমা যেন তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন একের পর এক তীর্থক্ষেত্রে। এরপর তাঁরা বছর খানেক বৃন্দাবন বাস করেন। তারপর সকলে হরিদ্বারে তীর্থ দর্শনে যান। সেখানে ‘হর কি পৌরি’র গঙ্গা দেখেন। গঙ্গার অপর পারের নয়নাভিরাম পর্বতমালার সৌন্দর্যের মাঝে দেবী চণ্ডী ও মনসা মাতার মন্দিরও নিশ্চিতভাবে মা সারদার মনকে আকৃষ্ট করেছিল। কারণ, তিনি তো সশরীর তাঁদেরই অংশ। তবে দর্শন করেছিলেন কিনা, সেকথা জানা যায় না। হরগৌরীর তীর্থে এসে তিনি খুব আনন্দ পান। এখানে পবিত্র ব্রহ্মকুণ্ডে তিনি স্নান করেন। হরিদ্বারের পর তাঁরা সকলে জয়পুর যান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৬: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন—মেয়েদের আলোর দিশারী

এখানে এসে বিখ্যাত গোবিন্দজির মন্দিরে ভগবানের অপরূপ বিগ্রহ দর্শন করে মা সারদা পরমানন্দ লাভ করেন। মধ্যযুগে যখন বৃন্দাবনের তীর্থস্থানগুলো লুপ্ত ছিল। তখন জয়পুরের মহারাজ সোয়াই জয়সিং শ্রীগোবিন্দজিকে জয়পুরে নিয়ে যান। সেই থেকে শ্রীগোবিন্দজি এখানেই অধিষ্ঠিত হয়ে যান। জয়পুর থেকে তাঁরা প্রয়াগতীর্থে ত্রিবেণী সঙ্গমে যান। এখানে শ্রীমা ঠাকুরের পবিত্র দেহাবশেষের অংশকে ত্রিবেণীর স্বচ্ছধারায় উৎসর্গ করেন। এখান থেকে তাঁরা শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দর্শনে যান। তারপর দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরে আসেন। ১৩১৭ সালে তীর্থাটনের সময়ে রামনাদের রাজা তাঁর রত্নভাণ্ডার খুলে দেন। সারদা মা যে সম্পূর্ণ ভাবে কাঞ্চনজয়ী, তার পরীক্ষা তো ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে বহুবার নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

একবার ঠাকুরের মারোয়ারি ভক্ত লছমীনারায়ণ ঠাকুরের প্রণামীর জন্য দশহাজার টাকা নিয়ে আসে। পূজারীরূপে ঠাকুরের তখন সাতটাকা মাইনে ছিল। তা তিনি নিজে তো গ্রহণ করতেনই না। এমনকি, মা সারদার কাছেও দিতেন না। সেই টাকা হৃদয় রাখত। ঠাকুর যখন লছমীনারায়ণের টাকা নিতে চাইলেন না। তখন সে হৃদয়ের কাছে রাখতে চায়। ঠাকুর বাধা দিয়ে বলেন, ‘তাহলে তো ঘুরিয়ে আমারই নেয়া হল’। লছমীনারায়ণ ভাবতে লাগলেন যে, ঠাকুরের প্রণামী তাহলে কাকে দেবেন!

এ বার ঠাকুর সারদা মার মন পরখ করার জন্য তাকে শ্রীমায়ের কাছে পাঠালেন। লছমীনারায়ণ মনে মনে খুশি হয়ে ভাবলেন যে মা সারদা একজন সংসারী নারী। তিনি তার প্রণামীর টাকা নিশ্চিত ফেরাবেন না। ফল হল ঠিক উল্টো। মা সারদা বললেন, ‘আমি টাকা নিলে যে ঠাকুরেরই নেওয়া হয়। তাই ওই টাকা নিতে পারব না’। ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য মন্তব্য করেছেন যে, শ্রীমায়ের কথায় যেন বৃহদারণ্যকোপনিষদের মৈত্রেয়ীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যেনাহং নামৃতা স্যাম্, তেনাহং কিং কুর্যাম্—যা দিয়ে আমি অমৃতা হব না, তা নিয়ে কি করব? দারুণ খুশি হয়েছিলেন সেদিন ঠাকুর।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

তাই রোগশয্যায় জননী সারদার ওপর নিজের অসম্পূর্ণ কাজের দায়িত্বভার নিশ্চিন্তে অর্পণ করে গিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘এ আর কি করেছে, তোমায় অনেক কিছু করতে হবে’। জননী সারদাই যে হলেন মূল চালিকা শক্তি, তা স্বয়ং ঠাকুরও জানতেন। জননী সারদা নিজেকে আড়ালে রাখতেন। স্বামীজি পর্যন্ত তাঁর মুখখানি দেখতে পেতেন না। রাখাল মহারাজের কাছেও কখনও অবগুণ্ঠন খোলেন নি। স্বামী সারদানন্দ তাই রসিকতা করে বলতেন, ‘আমাকে যেন মনে করেন শ্বশুর’। মা সারদা তাঁর বহিরঙ্গের রূপকেই নয়, তাঁর ঐশীরূপকেও আচ্ছাদিত রাখতেন। এইভাবে সাধারণের মাঝে সাধারণভাবে থেকেই তিনি সকলের জননী হয়েছিলেন। তীর্থভ্রমণ শেষে প্রথমে মা সারদা কামারপুকুরে ফিরে আসেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content