বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


মানবরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের লোক ব্যবহার সত্যই অনুধাবনযোগ্য। মুর্হুমুহু সমাধিবান যে পুরুষ তাঁর পক্ষে সমাজে লোকব্যবহার যে স্বাভাবিক হবে অথবা দৃষ্টান্তকরি হতে পারে তা অকল্পনীয়। অদ্ভুত শ্রীরামকৃষ্ণের এ স্থলেও অন্যথা হবার নয়। দক্ষিণেশ্বরে থাকার সময় কত প্রকার মানুষজনই না এসেছেন। প্রত্যেকে তো আর ধর্ম অনুসন্ধানে আসতেন না। মাতাল, ঔষধ প্রার্থী, টাকাকড়ি বা অন্যান্য অনেক কিছুর প্রত্যাশায় নিত্য এসে হাজির হতেন বা স্থায়ীরূপে বসবাস করত। রামকৃষ্ণদেব তাদের সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করতেন, যাতে দুই দিক রক্ষা হয়, যা দৃষ্টান্ত মূলক।

পরমহংসদেব বলছেন, কয় জনের থেকে সাবধানে থাকতে হয়। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শেষে বলছেন, “…তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও তাহলে বলবে তোর চৌদ্দপুরুষ, তোর হেন-তেন বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয়, কি খুড়ো কেমন আছো? তাহলে খুব খুশি হয়ে তোমার কাছে বসে তামাক খাবে।”
“অসৎ লোক দেখলে আমি সাবধান হয়ে যাই। যদি কেউ এসে বলে, ওহে হুঁকোটুকো আছে? আমি বলি আছে।” “কেউ কেউ সাপের স্বভাব। তুমি জানো না, তোমায় ছোবল দেবে। ছোবল সামলাতে অনেক বিচার আনতে হয়। তা না হলে হয়তো তোমার এমন রাগ হয়ে গেল যে, তার আবার উল্টে অনিষ্ট করতে ইচ্ছে হয়। তবে মাঝে মাঝে সৎসঙ্গ বড় দরকার। সৎসঙ্গ করলে তবে সদসৎ বিচার আসে।”
সামাজিক জীবনশৈলী কেমন হওয়া উচিত শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের মতো আর কেউ ভাবেনি। শ্রীরামকৃষ্ণ তবু বাছাই করা কয়েক জনকে নিয়েছেন। কিন্তু শ্রীমায়ের কথা ভাবলে, অবাক হওয়ার অন্ত থাকে না। ইচ্ছায় স্বীকার করেছেন শরীর ও এ সংসার, তার উপর পরিবারের লোকজন প্রত্যেকে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, অভিমান, লোভ সমস্ত কিছুর চরম সীমায়। তারজন্য প্রত্যেকে তাদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে নিতে কসুর করত না। শ্রীশ্রীমাও চাইতেন সকলকে আনন্দ দিতে এবং সকলকে নিয়ে আনন্দ করতে। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধ শক্তি অনেক ক্ষেত্রেই সে চেষ্টাকে প্রতিহত করত। ভাইদের স্বার্থ বুদ্ধি, ভাতুষ্পুত্রীদের পরস্পর হিংসা, নলিনীদিদের শুচিবাই, রাধুর বাতুল সদৃশ্য আবদার এবং ছোট মামির পাগলামি এই সব মিলিয়ে যে অবর্ণনীয় আবহাওয়ার সৃষ্টি হত, তাতে একমাত্র র্সবাংসহা ধৈর্যময়ী শ্রীমায়ের পক্ষেই শান্তভাবে সংসারে কাজ করা সম্ভব ছিল।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫০: তিনি নর শ্রেষ্ঠ, ত্যাগের ঈশ্বর…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

>এই সমস্ত নিয়েই শ্রীমায়ের পারিবারিক জীবন। শ্রীমায়ের সামাজিক জীবন অনেক ক্ষেত্রেই বেদনাদায়ক ছিল। কিন্তু তার প্রভাব তাঁকে প্রভাবিত করত না। তিনিই জগৎ-পসরা সাজিয়েছেন। তিনিই পালন করবেন। যেমন করে গুটি সাজিয়েছেন খেলা তো তেমনি হবে!

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পরিবারের কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে শিক্ষা যেমন দিয়েছেন, তেমন উচ্চতম ধর্মতত্ত্বও শুনিয়েছিলেন। তিনিও নিজে ছিলেন নিপুন খেলোয়াড়। হাজরা মহাশয়ের মতো লোক যিনি সর্বদাই দক্ষিণেশ্বরে থাকতেন কোনও না কোনও অজুহাতে। তাঁকে কত না কত ভাবে সামলাতে হতো।
এক দিন হাজরা মহাশয় বারান্দায় বসে আছেন। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে প্রাণকৃষ্ণকে, যাকে ঠাকুর মোটা বামুন বলতেন, বলছেন— “হাজরা একটা কম নয়। যদি এখানে বড় দরগা হয় তবে, হাজরা ছোট দরগা।” ঠাকুরকে আবার শিক্ষা দেয়, “তুমি কেন ছোকরাদের জন্য অত ভাবো?”

মাস্টার (স্বগত)”ঠাকুরের হাতে কি জীবের মুক্তি চাবি?” হাজরা তখন বললেন, “ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে পারলেই হল, আবার অবতার থাকুন আর না থাকুন।”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

ঠাকুর কোনওদিন ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলতেন না। তাঁকে কেউ ‘অবতার’ বললে তিনি প্রতিবাই করতেন। তিনি মা ভবতারিণীর সন্তান হয়ে থাকেন। অহংকার শূন্যতা তাঁর মহত্বের প্রমাণ। শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন, “বিষ্ণুপুরে রেজিস্টারির বড় অফিস, সেখানে রেজিস্টারি করতে পারলে, আর গোঘাটে গোল থাকে না।” ঠাকুরের অভিমান রাহিত্যের অভিনব নিদর্শন।

ঠাকুর বলছেন, “বিচার করো না। তাঁকে জানতে কে পারবে? ন্যাংটা বলত শুনে রেখেছি, তাঁরই এক অংশে এই ব্রহ্মাণ্ড।” এখানে, হাজরার যে এ মত পছন্দ নয়, তা ঠাকুর জানতেন। তাই বলছেন, “হাজরার বড় বিচারবুদ্ধি। সে হিসাব করে, এতখানিতে জগৎ হল, এতখানি বাকি রইল। তার হিসাব শুনে আমার মাথা টনটন করে। আমি জানি, আমি কিছুই জানি না। কখনও তাঁকে ভাবি ভালো, আবার কখনও ভাবি মন্দ। তাঁর আমি কি বুঝব?”

ভক্তি বিশ্বাস না হলে ঈশ্বরলাভ করা যায় না বহু সময় ঠাকুর বলেছেন। হাজরা মহাশয় কাছে থাকলেও সে ভাব আয়ত্ত করতে পারতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ হাজরা মহাশয় কে বলছেন, “তোমার বিশ্বাস কই? তবে তুমি এখানে আছ যেমন জটিলে-কুটিলে, লীলা পোস্টটাই জন্য।” সব যুগেই অবতার সঙ্গী এমন কত জন থাকেন। হাজরা কে দেখিয়ে ঠাকুর বলতেন, হাজরা নরেন্দ্রের ফেন্ড (Friend)।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

শ্রীমায়ের ক্ষেত্রেও এ রকম কম কিছু সামলাতে হয়নি। পাগলী মামির সহিত নলিনী দিদির অহি-নকুল সম্পর্ক। অথচ উভয়ই শ্রীমায়ের গৃহস্থলীর অন্তর্ভুক্ত, উভয়কেই মানিয়ে চালানো মায়ের স্বেচ্ছাবৃত কর্তব্য। তিনি বলতেন, “যা কিছু করে না কেন সকলকে নিয়ে একটু মান দিয়ে পরামর্শ শুনতে হয় বৈকি। একটু আলগা দিয়ে সব দিক দূরে দূরে লক্ষ্য করতে হয়, যাতে বেশি কিছু খারাপ না হয়। আমি এই যে রাধুর ঘরে তত্ত্ব পাঠাব, তা নলিনীর সঙ্গেও পরামর্শ করি। ওতে ছোট বউ এতে সাপে-নেউলে। ও তার ভালো দেখতে পারে না। সে ওর ছায়া মাড়াতে চায় না। কিন্তু আমি যখন নলিনীকে মুরুব্বী বানিয়ে তারপর যাই বলি, দেখ নলিনী, কী তোর পছন্দ? এই সব দেখে শুনে বল, তখন আমি যেসব জিনিসের ফর্দ দিই, তাতে সে বলে, “ওতে কী করে হবে, পিসিমা? ওরা যেমনই ব্যবহার করুক- আর রাধীটা তো একটা পাগল, জ্ঞানগম্য কিছুই নেই। কিন্তু তোমার তো একটা মর্যাদা আছে। তুমি এত ছোট নজর দেখাতে যাবে কেন, পিসিমা? তুমি তোমার মতন করে যাও”—এই বলে সে ফর্দ বাড়ায়।
শ্রীমা বলছেন, “আমিও মনে মনে হাসি। ওইটুকু যদি ওকে না জানিয়ে সেখানে তত্ত্ব পাঠাই, এমনি দু’জনে তাই নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। দেখ, সব লোককে কিছু কিছু অধিকার দিয়ে নিজেকে একটু নীচু হয়ে চলতে হয়। আমি এই ধিঙ্গী নিয়ে তাদের হাওয়া বুঝে সাবধানে চলি; তবু সময় সময় লেগে যায়, যেন ওটা হচ্ছে ওদের স্বভাব! কী করব বল? ভাবি তার সংসার তিনিই দেখছেন।” শ্রীরামকৃষ্ণের মতো শ্রীশ্রীমাও সামাজ, সংসার থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ চালনা, সঙ্গে ভক্তদের বিভিন্ন আবদার রক্ষা করা; সবই কর্তব্য বোধে দায়িত্ব পালন করেছেন, এ জগৎজননীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। —চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content