শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

শীতের দিনে লোকজন এক জায়গায় বসে শরীর গরম করার জন্য গরমাগরম বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। শুধু দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়, উত্তরপ্রদেশের একজন মহিলা বিচারকের চিঠির প্রসঙ্গ যেমন উঠে আসছে, সেই সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলনের দাবিকে নস্যাৎ করার একটি সুকৌশল প্রবণতাও এই আলোচনার পরিসরে উঠে আসছে বারে বারে। নারীরা চার দেওয়ালের মধ্যে কীভাবে ঘরাফেরা করবে বা করে থাকে আর বাড়ির বাইরেই বা কীভাবে ঘরাফেরা করবে বা কেমন করে ঘরের কাজ ছাড়াও অন্য কাজ, যা মূলত এতদিন পুরুষেরা করে এসেছেন সেই কাজের মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়া নিয়ে মূলত বিবাদ দেখা দিয়েছে। এই বিবাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা যেমন আছে, তেমন আছে মূল্যায়নের ফলাফলের প্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম।

আমাদের এই আলোচনার মধ্যে কোনও ভাবেই যেন আমরা নারী-পুরুষের মধ্যকার বিবাদ বলে দেগে দেওয়ার প্রবণতার প্রতি পক্ষপাত না দেখাই। আমাদের মধ্যে একটা বিষয় এখনও পরিষ্কার হয়নি যে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো একটি সমাজ নির্মিত কাঠামো যা নারী এবং পুরুষ উভয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে বয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়। নারী পুরুষ উভয়ই এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে বয়ে নিয়ে চলতে গিয়ে বর্তমান সময়ের নারী বাদী আলোচনার প্রভাবে শুধুই নারীর অত্যাচারের গল্প গুল শুনে চট করে ধরে নেন যে, সব পুরুষ খারাপ এবং সব মেয়ে নিপীড়িত। এই বিভাজন বা বলা যেতে পারে সরাসরি দুই যুযুধান পক্ষ বিশিষ্ট বিভাজন লিঙ্গ রাজনীতির মূল বিষয় যে পিতৃতন্ত্রের কর্ম পদ্ধতি তা বেমালুম ভুলে গিয়ে নারীর দোষ ধরার আর পুরুষের উপর অত্যাচারের নমুনা পেশের খেলাতে মেতে উঠেছে সবাই। আসল বিষয় সেখানে অলক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর গুরুত্ব হারাচ্ছে লিঙ্গ সাম্যের লড়াই। কীভাবে?
>আসলে আমরা একটি অবস্থন থেকে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অন্য একটি অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমরা এখন টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা ট্রানজিট অবস্থানে আছি। কিছুদিন আগেই আমার দুই সহকর্মী আমার সঙ্গে আলোচনা করছেন পুরুষ এবং তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে। একজন সহকর্মী বলছেন, তিনি বাড়িতে এক জায়গায় টাকা রাখেন এবং স্ত্রী সন্তানরা নিজেদের প্রয়োজনে টাকা ব্যবহার করতে পারে। তিনি বাড়ির বাইরে থাকলে টাকার দরকার পড়লে কোথায় যাবে তাই বাড়িতে সবার প্রয়োজনের টাকা এক জায়গায় রেখে আসেন। এই কথা শুনে আমরা বলব এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। আমাদের বাবাদের সময়ে টাকা স্ত্রীকে দিলেও তার একটা হিসেব ছকা থাকত মাথায় এই বলে যে কত টাকা খরচ হতে পারে একটা সংসার চালাতে গিয়ে।

পুরুষ যেহেতু বাজার অর্থনীতি নিয়ে সচেতন, তাই টাকার বেখেয়াল হিসেব নয় বরং অত্যন্ত সচেতন হিসেব থাকত। অর্থাৎ অর্থের উপর কন্ট্রোল থাকত পুরুষের। এখন কি নিয়ন্ত্রণ নারীর নিজের কাছে এসেছে? এর পরেই শুনতে পেলাম বলছেন, সহকর্মীর স্ত্রী অনেক দিন পর্যন্ত জানতেন না এক সপ্তাহ সংসার চালাতে কত টাকা লাগে। স্ত্রী অনুযোগের সুরেই বলতেন কী করে যে বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। সহকর্মী খরচের হিসেব জানতেন তাই বেশি করে টাকা যৌথ টাকার ব্যাগে রেখে দিতেন। আমি নিজেও সংসার চালাই, তাই আমার খটকা লাগল মহিলারা যারা নিজেরা রান্না করেন তারা চাল-ডালের পরিমাপের হিসেব ভালোই রাখতে পারেন। কারণ ঘরের কাজ জানাটাই তার মূল পড়াশুনো বা জেনে নেওয়ার বিষয়। সেই পরিস্থিতিতে হিসেব করতে না পারা কী মনে করব সেই নারীর নিজস্ব সমস্যা?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪২: অভীপ্সা বনাম অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

এই সমস্যার বিষয়টি নিয়ে একটু এগোতেই বুঝলাম স্ত্রীর সমস্যার দোষ গিয়ে পড়ছে স্ত্রীর মায়ের উপর। মায়ের সন্তান মানুষ করার প্রচেষ্টায় গৃহস্থালি হিসেব নিকেশ জায়গা পায়নি। ছেলে, মেয়ে নির্বিশেষে মাতৃদেবী এই বৈষয়িক বিষয় নিয়ে ট্রেনিং দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এ বার তাহলে এই সমস্যার কী ব্যাখ্যা হবে? আমার আর এক সহকর্মী জানালেন, তার স্ত্রী বাড়ির কোনও বিষয়ে কোনও মতামত দেন না। স্ত্রীর যিনি দাদা তিনিও বাড়ির কোনও বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তিনি স্ত্রীকেই সব দায়িত্ব সমর্পণ করেছেন।

অন্য দিকে কাজের জায়গায় পুরুষ সহকর্মী অনেক সময় সামনে আর বেশিরভাগ সময়ে আড়ালে সুন্দরী মহিলা সহকর্মীর আসে পাশে ঘুরে বেড়ালেও কাজের সময় মহিলা সহকর্মীর কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে চায় না। তারা বরং মহিলা সহকর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দিতে চায়। কাজ বোঝার জন্য মহিলা সহকর্মী যত বেশি বার সাহায্য চাইবে ততই পুরুষ সহকর্মী নিজেকে যথার্থ মনে করবেন। এখানে একটা বিষয় পরিস্কার যে, পুরুষের নিজের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা মহিলার থেকে কিছু সেবা পাওয়ার প্রচেষ্টা প্রবল। সেই সেবা দিতে গিয়ে কোনও নারীর সমস্যা হলে দোষ গিয়ে পড়ে সেই নারীর বিয়ের আগের অভিভাবকদের উপর।

আর কাজের জায়গায় পরিষেবা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ পায় বেশি আর সেই পরিষেবা দেওয়ার অছিলায় যৌন হেনস্থা করার নজির ভুরি ভুরি। কখনও শোনা যায় ঊর্ধ্বতন পুরুষ কর্তৃপক্ষ কাজের অছিলায় নিজেদের চেম্বারে ডেকে পাঠান। অযথা ফোন করে কথা বলতে থাকেন। আবার কখনও কাজের অছিলায় ছুটির দিনে বা কোনও অসময়ে অফিসে ডেকে পাঠান। নারী কর্মীদের পোশাক নিয়ে মন্ত্যব্য করতে দেখা যায়। নারী কর্মীদের অজান্তে ছবি তুলে তাতে ‘ফটো এডিট’ করে পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং নারী সহকর্মীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বাড়ির লোককে ফোন করে বিরক্ত করা বা চাপ সৃষ্টি করা প্রভৃতি কাজ করতে দেখা যায়। বাঙালিদের এই কথা বললে তারা বলবে এই পুরুষরা ঘর জ্বালানি আর পর ভুলানি!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৪: অন্ধকারের উৎস হতে—শীতকালের প্রতিরাত

কী বুঝলেন, খুব জটিল বিষয়? বিষয়ের জটিলতার মধ্যেই আসলে অনেকগুলি বিষয় দলা পাকিয়ে আছে। এই দলা পাকানো বিষয়গুলি আমাদের মধ্যে নারী-পুরুষ বিভাজন এবং তাদের আক্ষরিক অর্থে কী অধিকার থাকবে সমাজে এবং বিভিন্ন লিঙ্গের উপস্থিতি মেনে নেওয়া এবং তাদের কোনও সামাজিক ভূমিকা আমরা কীভাবে মেনে নেব, সব কিছু একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের সামনে লিঙ্গের অধিকার নিয়ে সুস্পষ্ট অভিমুখের দিশা পরিষ্কার ভাবে দেখা দেয়নি এখনও।

আমাদের সমস্যা হল আমাদের লিঙ্গ পরিচয়ের অভিমুখকে নিয়ে। যে লিঙ্গ পরিচয় এবং তার সমাজে ভুমিকা আমরা এতকাল সমাজে দেখে এসেছি সেই ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারছি না। আমরা যেখানে নারীকে দেখতে অভ্যস্ত যে সে প্রথমে পিতার অধীন তারপর স্বামী এবং পরে পুত্রের অধীন সেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন পুরুষ তার নিজের প্রয়োজনে নারীকে বাধ্য করছে বাড়ির বাইরের কাজে বা বাড়ির কোনও কাজে সিদ্ধান্ত নিতে নারীর পক্ষে তখন চট করে নিজেকে নারীর পরম্পরাগত ভূমিকা থেকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তার সঙ্গে যখন তাকে দ্বৈত ভুমিকা অর্থাৎ বাড়ির এবং বাড়ির বাইরের কাজে সমান ভূমিকা নিতে হচ্ছে তখন নারী হতাশ হয়ে পড়ছে। তার কাছে এই ধরনের কাজের চাপ মানসিক অত্যাচারের শামিল। এই ধরনের অবস্থান থেকে নারী যখন আবেদন রাখছে পুরুষদের কাছে বা পুরুষদের মনে হচ্ছে সামাজ নির্দিষ্ট পুরুষের ভূমিকাতে বদল আনতে হবে তখন আবার অন্য ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

বর্তমান বাজার অর্থনীতির চাপে পুরুষকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে কাজের জায়গায় কাজ টিকিয়ে রাখার জন্য, কাজ খুঁজে বের করার জন্য। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতার চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে পুরুষদের নিজেদের সমাজ নির্দিষ্ট পৌরুষ ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। তখন তাদের বলতে হচ্ছে তাদেরও কষ্ট হয়। কাজের জায়গায় ‘টার্গেট’-এ পৌঁছতে না পারলে পুরুষকেও অপমানও সহ্য করতে হয়। তখন পুরুষ তার কাজের চাপ— মানে বাজার করা, ব্যাঙ্কের কাজ, বাড়ির কিছু কিছু কাজ প্রভৃতি স্ত্রীদের ঘাড়ে দিয়ে দিতে চায়। নারী তখন এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে বা সেই সঙ্গে নিজের সমাজ নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে অনীহা দেখালে সমাজ আবার দেগে দিতে বসে এই বলে যে এই কারণে পুরুষ আজ নিপীড়নের স্বীকার।

পুরুষ নিজের স্ত্রীকে অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করে বলতে শোনা যাচ্ছে তার স্ত্রী দায়িত্ব পালন করছে না। আবার অন্য দিকে স্ত্রী পুরুষের কম রোজগার বা স্ত্রীর ভরণপোষণ ভালো ভাবে করলে না পারার অনুযোগ জানালে বলা হচ্ছে স্ত্রী সব সময় টাকা চেয়ে অত্যাচার করছে। অর্থাৎ আমরা এখনও নারীকে একজন অনুগত বলেই দেখতে চাইছি। নারী স্ত্রী হোক বা সহকর্মী, আমরা সবসময় দেখছি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীদের ভুমিকা বদল করালেও সব কিছুর মধ্যে যে মূল বিষয়টিকে রেখে দিচ্ছে তা হল নারীকে পরিষেবা প্রদান করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যেতে হবে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

নারীকে সবসময় প্রত্যাশা মিটিয়ে যেতে হবে। নারীর প্রতি সমাজের এই ভূমিকা নিক্ষেপের কারণে অনেক সময়ে নারীর বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কী ভূমিকা হবে এখনও সুস্পষ্ট হয়নি। তাই নারীদের পুলিশ কিংবা বিচারক কিংবা সেনাবাহিনীতে কী ধরনের ভুমিকা থাকবে আজও খুব স্পষ্ট নয়। সেই কারণে আবার দেখা যায় একই বিষয়ে ডিগ্রি থাকা নারী পুরুষের মধ্যে নারীর ডিগ্রিকে কম মূল্য দেওয়া হয়। মহিলা পাইলট প্লেন বা ট্রেন চালাবে শুনলে এখনও অনেকে নার্ভাস হয়ে পড়েন। বিশ্বাস করে উঠতে পারে না মহিলাদের দক্ষতাকে। মহিলাদের লেখা পড়ার ডিগ্রি তাকে একজন দক্ষ মা কিংবা স্ত্রী রূপেই পরিচিত করবে বলে সমাজ ধরে নেয়।

সমাজে যে সব মহিলারা বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করেন তাদের যৌন হেনস্থা এবং পরিবার- সন্তানের দেখাশুনোর কারণে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। তাদের এই ধরনের হেনস্থা মোকাবিলা করতে গিয়ে শারীরিক সমস্যাতে পড়তে হয়। অন্যদিকে চাকরি না করা মহিলারা কোনওভাবেই নিজেদের দখল সম্পত্তি বা অন্য বিষয়ে করতে না পারার ফলে সমাজের চোখে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। শিক্ষিত একটি মেয়ে বিয়ের পর চাকরির চেষ্টায় একটি কলেজে বিনে পয়সায় পড়াতে শুরু করেছিল কিন্তু প্রায় দিন তাকে কাঁদতে দেখা যেত। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে জানিয়েছিল তার জা চাকরি করে কিন্তু সে চাকরি না পাওয়াতে তাকে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে সব কাজ করান হত। তার চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার প্রক্রিয়া তাই কোনও দাম দিতে পারছে না। না সে নিজের শরীর বা মন রক্ষা করতে পারছে, না সে নিজের কোনও মূল্য তৈরি করতে পেরেছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে কিছুটা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা মেয়েরা কিন্তু তাদের স্বামীরা ঘরের কাজও করেন না। আর বয়েসের সঙ্গে বাড়তে থাকা আর্থিক দুর্বলতা এদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিতে থাকে। এই রকম পরিস্থিতিতে নারীদের এই উভয়সঙ্কট অবস্থানের সম্পূর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলেছে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। আমরা বেরোতে পারব কি এই পরিস্থিতি থেকে?
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content