শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রং ঘর। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।

আজকের বৈচিত্রপূর্ণ অসমের সঙ্গে আরও একটু বেশি ভালো করে পরিচয় করে নিতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। রাজ্যটির নাম সম্পর্কে কিংবা অতীতে তার রাজনৈতিক অবস্থানই বা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে আমাদের। নইলে আমাদের ‘অসমের আলো-অন্ধকার’ ধারাবাহিকটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

আমাদের প্রত্যেকের যেমন একটি নাম থাকে, তেমনি প্রত্যেকটি জায়গারও নাম থাকে। তবে জায়গার নাম সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের দেশেরই তো কত নাম—ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান। প্রতিটি নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি ইতিহাস। তেমনি আজকের অসম নামটির পেছনেও রয়েছে অনেক গল্প, ইতিহাসের ঘটনা। প্রাচীনকালে অসমকে বলা হত প্রাগজ্যোতিসপুর কিংবা কামরূপ। প্রাগ শব্দের অর্থ হল পূর্ব এবং জ্যোতিষ শব্দের অর্থ জ্যোতিষ্ক। স্যার এডওয়ার্ড গেইট তাই বলেছেন, “the city of eastern astrology.’’
‘কামরূপ’ নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। রাজা দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে সব দেব-দেবী, রাজা-মহারাজারা আমন্ত্রীত থাকলেও তাঁর মেয়ে সতী আর জামাতা শিবের নিমন্ত্রণ ছিল না। পিতার এমন যজ্ঞ করার খবর পেয়ে সতী নিজেকে আর ঘরে আঁটকে রাখতে পারলেন না। তিনি বিনা আমন্ত্রণেই ছুটলেন বাপের বাড়ি।

এ দিকে রাজা দক্ষ জামাতা শিবের নিন্দে-মন্দ করতে ব্যস্ত। সতী সেখানে পৌঁছে পিতার মুখে পতিনিন্দা শুনে সহ্য করতে না পেরে, সেই যজ্ঞের আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন। সতীর বিয়োগের খবর পেয়ে শিব অস্থির হয়ে ওঠেন। সতীর মৃতদেহ পিঠে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরতে শুরু করেন। উন্মাদ শিবকে শান্ত করার জন্য বিষ্ণু তখন তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে দেন।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

সতীর দেহ ৫১টি টুকরো হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং প্রতিটি স্থান এক একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়। সতীর দেহ যখন শিবের কাছে থাকল না তখন শিব ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ধ্যানে বসলেন। কিন্তু আবার যখন সৃষ্টির কল্যাণের জন্য শিবের প্রয়োজন পড়ল তখন নারায়ণের আদেশে কামদেব শিবের ধ্যান ভঙ্গ করেন। ফল স্বরূপ শিবের তৃতীয় নয়নের দৃষ্টি কামদেবের উপর পড়ে এবং তিনি ভষ্ম হয়ে যান। পরে আবার তিনি দেহ ফিরেও পেয়েছিলেন। কথিত, এই ঘটনাটি এখানে ঘটে বলে কামদেবের নামানুসারে জায়গাটির নাম হয় কামরূপ। মহাভারত কিংবা পুরাণে যে প্রাগজ্যোতিসপুর কিংবা যে কামরুপের উল্লেখ আছে তার সঙ্গে বর্তমান অসমের ভৌগোলিক চেহারা পরিবর্তন যথেষ্ট লক্ষণীয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

অসম নামের উৎস শব্দটি নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। তবে আজকের দিনে আসাম নয়, রাজ্যটির নাম ‘অসম’ বলেই আমরা জানি। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে ইংরেজিতে ‘আসাম’ বানানটিতে একটি ‘S’ ব্যবহার করা হতো। অনেকের মতে, ‘অসমতল’ শব্দটি থেকে ‘আসাম’ বা ‘অসম’ শব্দের উৎপত্তি হলেও হতে পারে। তবে দীর্ঘদিন অসমে রাজত্ব করা অহমদের থেকেই অসম শব্দ এসেছে বলে বেশির ভাগ গবেষকরা মনে করেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-১: টি-হাউসের সামনের পাহাড়ের শৃঙ্গ-রা যেন রঙের উৎসবে মেতে উঠেছে

অহমরা নিজেদেরকে ‘টাই’ জাতির বলতেন। অসমে আসার পর থেকে তাদেরকে ‘অহম’ বলা হত। তাদের ভাষা ছিল ‘টাই’ বা ‘শ্যান’। আর সেই থেকেই কালের গতিতে ‘অহম’ থেকে ‘অসম’ শব্দের সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। চাওলুং চুকাফা ছিলেন অহম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১২২৮ সালে চুকাফার রাজার নেতৃত্বে প্রায় ৯০০০ মানুষ দক্ষিণ-পশ্চীম চিনের মুংমাওলুঙ্গ থেকে অসমে এসে নিজেদের সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ১২৫৩ সালে চড়াইদেওতে নিজেদের রাজধানী স্থাপন করা হয়। আহমরা অসমকে এক শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। অসমিয়া ভাষা এবং সংস্রিতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে আহমদের অবদান যথেষ্ট। ১২৬৮ সালে চুকাফা অসমের তৎকালীন রাজধানী চরাইদেওতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু দিনটি আজও অসমে ‘চুকাফা দিবস’ কিংবা ‘অসম দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।

রাজনীতিতে কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা পরিবার চিরদিন একক শাসন করেছেন বলে শোনা যায় না। কালচক্রের কড়াল আঘাতে অহমদের হাত থেকেও রাজতন্ত্র সরে গেল। ৬০০ বছরের রাজত্ব মান অর্থাৎ বর্মীদের আক্রণে অবসান টেনে এনেছিল। আর এখানেই শুরু হয় ইতিহাসের নতুন পর্ব।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content