রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ভগবান স্বয়ং মনুষ্য লীলা করার জন্য ভক্তের কারণে মানুষ রূপ ধরে অবতীর্ণ হন। ভগবান মধুর রস আস্বাদন করতে চান। প্রতি যুগেই তিনি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সে রস আস্বাদন করেছেন। শুধু তাই নয়, ভগবানের সত্ত্বা মানুষের মধ্যেই বেশি প্রকাশিত হয়। তিনি তাদের নিয়ে থাকতে বেশি ভালোবাসেন। শুদ্ধসত্ত্বদের তাঁর লীলা সঙ্গী করেন। কামনাহীন প্রেম তাঁকে রেশমের সুতোর মতো বেঁধে রাখে ভক্তের সঙ্গে। ভক্তি, ভক্ত আর ভগবান অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। মায়াধীশ মায়াকে আশ্রয় করে, মায়ার বন্ধনে পড়ে যান ও অবিকল মানুষের মতো জগতের সমস্ত কর্ম করেন। ভগবত প্রেম আস্বাদন করে মানুষের সঙ্গে এক হয়ে, মানুষকে ভগবত প্রেমরসে ডুবিয়ে দেন। সেই আনন্দে মশগুল হয়ে মানুষ হারিয়ে যায় তার সত্ত্বাকে। ভগবত সত্ত্বায় হাবুডুবু খেতে খেতে উতরে যায় ভব নদী। অচিন দেশে আনন্দে বিচরণ করে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন ভক্তদের দেখে, “এই হাতে লাগার দরুন আমার স্বভাব উল্টে যাচ্ছে। এখন মানুষের ভিতর ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ দেখিয়ে দিচ্ছে। যেন বলছে, আমি মানুষের ভিতর রয়েছি। তুমি মানুষ নিয়ে আনন্দ করো।”
শুদ্ধ ভক্তের ভিতর ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ। তাই তিনি নরেন্দ্র রাখাল এদের জন্য এত ব্যাকুল হন। ঠাকুর বলছেন, “জলাশয়ের কিনারায় ছোট ছোট গর্ত থাকে। সেখানে মাছ, কাঁকড়া এসে জমে। তেমনি মানুষের ভেতর ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ। এমন আছে যে শালগ্রাম হতেও বড় মানুষ। নরনারায়ণ। প্রতিমাতে তাহার আবির্ভাব হয় আর মানুষে হবে না? তিনি নরলীলা করার জন্য মানুষের ভিতর অবতীর্ণ হন যেমন রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যদেব। অবতার কে চিন্তা করলেই তার চিন্তা করা হয়।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪৭: মানুষের অন্তরে ভগবান অধিষ্ঠিত হলে তিনি আর কোনও অমঙ্গলকারী কাজ করতে পারেন না

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা

এমন অপূর্বতা! মানুষের সঙ্গে ভগবানের মেল বন্ধন এর আগে কেউ দেখেনি। তিনি সুক্ষাকারে যেন সেতু বেঁধে দিলেন যে সেতু দিয়ে সহজে জীব পৌঁছে যাবে ঈশ্বরত্বে। মানুষের খোলে ঈশ্বর ঘুরছেন ফিরছেন, যেন সং সেজে আসা। সেই এক চৈতন্য ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত। স্বামীজি কুম্ভকোণম বক্তৃতায় বলছেন, “তুমি যে কোনও জাতির লোক হও, তাহাতে ক্ষতি নাই তবে সেজন্য অপর জাতির কাহাকেও ঘৃণা করিতে পার না। প্রেম—একমাত্র প্রেমই আমি প্রচার করিয়া থাকি; আর আমার এই উপদেশ বিশ্বাত্মার সর্বব্যাপিত্ব সমত্বরূপ বেদান্তের সেই মহান তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

সর্বাবয়ব বেদান্তকে জাগতিক রূপ প্রদান। প্রেমের নতুন কাঠামোর উপর ঈশ্বর রূপ মানুষের প্রতিমা। ঈশ্বর আছেন এইখানে। ব্যষ্টি রূপে তিনিই আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। স্বামীজি আর এক, মাদ্রাজে পদত্ত তৃতীয় বক্তব্যে বলছেন, “প্রত্যেক নরনারীকে—সকলকেই ঈশ্বরদৃষ্টিতে দেখিতে থাক। তোমরা কাহাকেও সাহায্য করিতে পার না, কেবল সেবা করিতে পার। প্রভুর সন্তানদের, যদি সৌভাগ্য হয়, তবে স্বয়ং প্রভু সেবা কর। যদি প্রভুর অনুগ্রহে তাহার কোন সন্তানের সেবা করিতে পার তবে ধন্য হইবে। নিজেদের খুব বড় কিছু ভাবিও না। তোমরা ধন্য যে সেবা করবার অধিকার পেয়েছ, ওপরে পায় নাই। উপাসনাবোধে ওইটুকু কর। দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে আমি যেন ঈশ্বরকে দেখি, নিজ মুক্তির জন্য তাহাদের নিকট গিয়ে তাহাদের পূজা করিব—ঈশ্বর তাহাদের মধ্যে রইয়াছেন। কতগুলি লোক দুঃখ পাইতেছে, তাহা তোমার আমার মুক্তির জন্য, যাহাতে আমরা রোগী, পাগল, কুষ্ঠী, পাপী প্রভৃতি রুপধারী প্রভুর পূজা করিতে পারি।”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণের বাণী রূপ শরীরের স্বামীজি দিলেন অসাধারণ প্রকাশ ও প্রসার। সূত্র আকারে দেওয়া বাণী, স্বামীজি দিলেন বেদান্তের নতুন রূপরেখা। সর্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম—এর জাতীয় প্রকাশে মহীরুহ রূপ।

কথাভাষ্যের শরীর ধারণ: শ্রীশ্রীমা বলছেন, জগত আপনার কেউ পর নয় মা সবাই আপনার। নলিনী দিদি যখন স্বভাব সিদ্ধ ভাবে শ্রীশ্রী মাকে ছত্রিশ জাতের এঁঠো কুড়োনোর জন্য কটুক্তি করছেন। তখন শ্রী শ্রীমা গম্ভীর ও তাৎপর্য পূর্ণ উত্তরে, সেই এক সর্বব্যাপী চৈতন্যের কথায় প্রকাশ করলেন। শ্রীশ্রীমা বলছেন, কোথায় ছত্রিশ! সবাই তো আমার। এ উত্তরের মধ্যে প্রকাশ পেল তার অদ্বৈত ভাবনা। সকল মানুষের মধ্যে সেই প্রেমময় বিরাজ করছেন রূপ ঢেকে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের ভাবময় বাণীর কর্মে পরিণত প্রকাশ শ্রীশ্রীমা; আর তার ভাবময় বাণীর শারীরিক রূপকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন স্বামীজি।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content