রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অসম বলতেই মনে হয় সবুজের অসম, গাছের অসম, বিহুর অসম, বৃষ্টির অসম, আমার অসম। সবুজ ঘেরা এই অসমে এক সময় দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সাধারণ মানুষের আগমন ঘটেছিল। তারাই অসমের মাটিতে চা উৎপাদন করে বিশ্ব দরবারে অসমের নাম পৌঁছে দিয়েছে। এক সময় মোগল সম্রাটরা ভারতের একাধিক প্রদেশে শাষণ করলেও অসমকে কিন্তু নিজের অধীনে আনতে পারেনি। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে সে কাহিনি। আর একথাও মেনে নিতে হয় অসমকে সাজিয়ে রাখতে প্রকৃতি যেন কোনও দিনই কার্পণ্য করেনি।

আসলে প্রকৃতি পৃথিবীর প্রত্যেকটি অঞ্চলকে তার নিজের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে, কোথাও পাহাড়, কোথাও বা সমুদ্র, আবার কোথাও বা মরুভূমি। নিজের সৌন্দর্যের ডালা মেলে রেখেছে অকৃপণভাবে। আমাদের দেশে প্রতিটি রাজ্য তার মতো করে সুন্দর, তাই-ই তো আমরা বলি— “সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।” আমাদের অসমও এর ব্যতিক্রম নয়।
একটি দেশ কিংবা রাজ্যের আসল রূপ ফুটে ওঠে তার ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সেই জায়গার সঙ্গে জড়িত থাকা ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং আরও অনেক কিছুকে কেন্দ্র করে। দেশ বা রাজ্য মানে শুধু একটি সীমানা নয়। সুতরাং একটি অঞ্চলকে ভালো করে জানতে হলে এই সব বিষয়গুলিকে নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। তাই অসম সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে হলেও আমাদেরকে শুরু করতে হবে তার ভূগোল দিয়ে।

অসমের প্রধান নদী বরাক এবং ব্রহ্মপুত্র। অসমের উত্তর অংশে রয়েছে ভূটান এবং অরুণাচল প্রদেশ। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উত্তর-পূর্বদিকে পূর্ব হিমালয়ের পর্বত শ্রেণি। আর দক্ষিণে নাগা পাহাড়, মেঘালয়। অসমের দক্ষিণ প্রান্তে বরাক উপত্যকা এই অঞ্চলের পূর্বদিকে মণিপুর এবং দক্ষিণে মিজোরাম অবস্থিত। উত্তরে রয়েছে বড়াইল পাহাড় আর জয়ন্তীয়া পাহাড়। আর পশ্চিম দিকটি বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকার সঙ্গে সংলগ্ন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী

সময়ের সঙ্গে অসমের ভৌগোলিক চেহারারও পরিবর্তন ঘটেছে। দেশভাগের আগে বর্তমান মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের সিলেটের কিছুটা অংশ অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দক্ষিণ অসমের প্রধান নদী বরাক বর্তমান কাছাড় জেলার হরিটিকর নামক স্থানে সুরমা এবং কুশিয়ার নামে বিভক্ত হয়েছে। এই সুরমা নদীর তীরে রয়েছে বাংলাদেশের সিলেট শহর। সিলেটের পূর্ব সীমানায় থাকা কাছাড় জেলা ছিল হেড়ম্ব রাজার স্বাধীন ভূমি। ১৮৩২ সালে কাছাড় জেলা ইংরেজরা দখল করার পর ১৮৭৪ সালে সিলেট কাছাড় জেলাকে অসমের অন্তর্ভূক করা হয়। সুরমা উপত্যকায় ছিল সিলেট ও কাছাড়, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ছিল গোয়ালপাড়া, কামরূপ, নগাঁও, দরংগ, শিবসাগর ও লুসাই পাহাড়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪০: রামচন্দ্রের পিতৃসত্যপালনের অঙ্গীকারে ধর্মবোধ, যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মনোমুগ্ধকর প্রভাব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

স্বাধীনতার পর অসমের মানচিত্র পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় কিছুটা অঞ্চল বাদে সিলেট জেলার বাকি অংশ পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে বর্তমান করিমগঞ্জ জেলার রাতাবাড়ি, পাথরকান্দি, বদরপুর থানা এবং করিমগঞ্জ জেলার কিছু অংশ ছাড়া বাকি অংশ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীনতার আগে ১১টি জেলা ছিল অসমের। আর শৈলশহর শিলং ছিল অসমের রাজধানী।

পরবর্তী সময়ে ১৯৬৩-এ নাগাল্যান্ড, ১৯৭০ সালে মেঘালয়, ১৯৭১ সালে মিজোরাম অসম থেকে পৃথক হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে গুয়াহাটির দিসপুরে অসমের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে অসমের জেলার সংখ্যা ৩১টি। কিন্তু কোকরাঝার, চিরাং, বাকসা এবং উদালগুড়ি এখন বিটিএডি (Bodoland Territorial Area District) এর অন্তর্গত। বিটিএডি ২০০৩ সালে গঠিত হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় জেলা কার্বি আংলং, আর সবচেয়ে ছোট হল কামরূপ। রাজনীতি একটি অঞ্চলের সীমানা তথা জনসাধারণের জীবন কীভাবে পরিবর্তন করতে পারে অসম তার উজ্বল দৃষ্টান্ত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মণ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

পাহাড় পর্বত নদ নদী ঘেরা এই রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা বাংলাদেশের খুবই কাছে হওয়ায় দেশভাগের প্রভাব এখানে যথেষ্ট পড়েছে। করিমগঞ্জ জেলার কুশিয়ারা নদীর ওপারে রয়েছে বাংলাদেশ। আগে এই নদী পেরিয়ে সাধারণ মানুষের অবাদ আনাগোনা ছিল, কিন্তু আজ নদী পেরোতে গেলে চাই সরকারি অনুমোদন। দেশ ভাগ করে আসা স্বাধীনতার করুণ ইতিহাসের গান যেন গাইছে এই নদী। বরাক উপত্যকার একাধিক সাহিত্যে রয়েছে সেই অতীতের ইতিবৃত্তের ছবি।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content