রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


 

চতুর্থ দিন ও পঞ্চম দিনের সকাল

গাছপালাহীন অঞ্চল, চোদ্দ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় অক্সিজেনের যোগান কম। তাই এ পথে একটু একটু হাঁপ ধরে। চারপাশ দেখে আশ মেটে না। গতি আপনা থেকেই ধীর হয়ে আসে। মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্প থেকে প্রায় ৪ কিমি রাস্তা। অনেককেই দেখি, প্রায় ট্রেন ধরার তাড়া নিয়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। আমার আজ পাহাড়ের কোলে অবগাহন করার দিন। আমি নিজের গতিতেই এগোতে থাকি।
এদিন পথ চলার শুরু থেকেই নুরী আমাকে ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে চলেছে। গিয়ালজিনের সঙ্গে আসা বাকি মিষ্টি ছেলেগুলোর কাছে শুনি, নুরীর খান চারেক প্রেমিকার মধ্যে একটি আপাতত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। গতকাল রাতে মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্পে মুঠোফোনে এমত বেদনাময় খবর আসার পর থেকে নুরীর মুখে একটা উদাস বাউল ভাব। সোনালি ঘাসে মোড়া পথে একলা নুরী চলেছে হাতে একতারা নিয়ে, যার অপর নাম মোবাইল ফোন। আর এ পথে কোনও কানেকশন না পেলেও সেটি তার কানেই লাগানো সর্বদা।
আরও পড়ুন:

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল

বেশ কিছুটা একা চলার পর আজ আমার সঙ্গী আমাদের দলের কনিষ্ঠতম সদস্য, প্রাণের স্পন্দনে ভরপুর দূর্জয়। এই উন্মুক্ত পাহাড়ের খোলা প্রাঙ্গণে কত রকম বিষয়ে কথা বলতে বলতে চলি আমরা। কিন্তু চোখ সারাক্ষণ অর্জুনের মতো লক্ষ্য রেখে চলে বেস ক্যাম্পের দিকে।
কারণ ইতিমধ্যেই চোখের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিশালাকার অন্নপূর্ণা দক্ষিণের নীচে কতগুলো লাল, নীল ঢালু ছাদ! ওই তো বেস ক্যাম্প! দেখা যায় অনেক আগে থেকেই কিন্তু এর কাছে পৌঁছতে বেশ ধৈর্য রাখতে হয়! সুলভে কি পাওয়া যায় কোনও মহার্ঘ্য সম্পদ!

অবশেষে বহুদিনের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ। ‘নমস্তে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প’ লেখা ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন অলীক লাগে যেন! সকলের চোখেই বিষ্ময়! আসা হল তাহলে! পারলাম!!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

টি-হাউস এর বিরাট বড় আরামদায়ক গদিমোড়া ডাইনিং হলে বসে কবোষ্ণ রোদ পিঠে নিয়ে চা খাই। চারদিক ঘেরা কাঁচের জানালা দিয়ে বয়ে আসে অলস দুপুর! ক্যাটকেটে নীল আকাশের ব্যাকড্রপে দুধসাদা মচ্ছপুছারে থেকে শুরু করে গঙ্গাপূর্ণা, হিমচুলী, অন্নপূর্ণা দক্ষিণ, অন্নপূর্ণা ২,৩,৪। তারা নীচের এই অতি ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে মায়াভরা দৃষ্টি মেলে দেখে!
বিকেলে মেঘে চারদিক সাদা ওড়নায় ঢাকে! একটু মন খারাপ হয় অবশ্যই। হঠাৎ সেই মেঘ ছিঁড়ে দেখা দেয় সামান্য আলোর লুকোচুরি! কোথা থেকে এক জাদুকরি এসে শুরু করে আরেক নতুন ম্যাজিক। সূর্যাস্তের রঙ মাখানো পাহাড়ের অন্তরাল বেয়ে উঠে আসছে পূর্ণিমার চাঁদ!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার

মাঝরাতে জমে যাওয়া ঠান্ডা আর অনাঘ্রাত নির্জনতায় বাইরে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি! সারা আকাশ তখন তারার বসতবাটি, মাথার ওপরে হীরকদ্যুতি ছড়ানো চাঁদ! জ্যোস্নাজড়ানো এই বরফঢাকা উত্তুঙ্গ পাহাড়ের সামনে যাবতীয় সমতলীয় হুঙ্কার কি তুচ্ছ, ক্ষুদ্র!!

আমাদের ঘরের প্রায় পেছন থেকেই টানা উঠে গেছে অন্নপূর্ণা। ৩৬০ ডিগ্রি নানাবিধ নামী-দামি শৃঙ্গ ঘেরা বেস ক্যাম্পটি যেন অনেকটা গামলার মতো। মাঝে রয়েছি আমরা।
সকালে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি ঘরের পিছনে। অন্নপূর্ণায় প্রথমে হালকা লাল, তারপর গাড় লাল-কমলা, এরপর গলানো সোনা রঙে বারেবারে দেখা, তবুও নতুন সূর্যোদয়! আর কিছুক্ষণ পরেই নামা শুরু। হৃদমাঝারে আমার প্রিয় কটি শব্দ ঘুরপাক খায়, ঘুরপাক খেতে থাকে, খেতেই থাকে…
চলো, আবারও প্রেমে পড়ি।
পরিচিত ভান, বুদ্ধিদীপ্ত ভন্ডামী
চুপচাপ ঘুমোক এখানে।
নির্ভেজাল অকপট জীবন
চেখে নিই আজ রেড ওয়াইনের মতো….

—শেষ।

ছবি ও ভিডিয়ো ক্লিপ: লেখিকা
* লেখিকা মৌসুমী সেনগুপ্ত শিক্ষিকা, গয়েশপুর নেতাজি বালিকা বিদ্যামন্দির (উচ্চ মাধ্যমিক)।

Skip to content