শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কিশোর কুমার, রাজেন্দ্র কুমার, আমিত কুমার ও আরডি। ছবি: সংগৃহীত।

‘লাভ স্টোরি’। এই ছবিতে আনন্দ বক্সীর লেখা গানগুলিতে যেমন রয়েছে যৌবনের প্রথম প্রেমের অভিব্যক্তি, তেমনই আমরা পেয়েছি প্রেমিক পঞ্চমকে। অবশ্যই তাঁর সুরের মাধ্যমে। নবীন নায়ক এবং নায়িকা অর্থাৎ, কুমার গৌরব এবং বিজেতা পণ্ডিতের কথা মাথায় রেখে গীতিকার এবং সুরকারের সৃষ্টি করা এই ছবির গানগুলি এমনই, শোনামাত্র আমাদেরও বয়স নিম্নমুখী হয়ে পড়তে চায়। মনে মনে আমরাও টাইম-মেশিনে চড়ে এক নিমেষে ফিরে যাই আমাদের কলেজের দিনগুলিতে।

উল্লেখ্য, এ বার কিন্তু আর কিশোর নন। পঞ্চম বেছে নেন কিশোরপুত্র অমিতকে। কারণ নায়কের বয়স এবং ব্যক্তিত্ব। কুমার গৌরবের লিপে অমিত কণ্ঠকে এতটাই মানানসই মনে হয় যে, আমরা দু’জনকে কিছুতেই আলাদা করে ভাবতে পারি না। তাই অমিত যে গায়ক হিসেবে এই ছবিটির জন্য ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পাবেন তাতে আর আশ্চর্য কি!
‘দেখো ম্যায়নে দেখা হ্যায় ইয়ে এক স্বপ্না’ অথবা ‘তেরি ইয়াদ আরহি হ্যায়’ দুটি ক্ষেত্রেই লতা-অমিত জুটি কি অনবদ্য ভাবেই না নিজেদের উপস্থাপিত করেছেন। একটি গানকে সফল করার ভার ঠিক যতটা গীতিকার এবং সুরকারের, ঠিক ততটাই গায়ক এবং গায়িকারও। অথবা একটু বেশি বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। কারণ, গানের কথা এবং সুরকে সঠিকভাবে রূপ দিতে গেলে চাই গায়ক-গায়িকার অনুভুতি এবং কণ্ঠের অকৃত্তিম আবেগ। এই ক্ষেত্রে লতা তো বটেই, অমিতকুমারও একই মাত্রায় সফল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৫: তেরে লিয়ে পলকো কি ঝালর…

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

‘কেয়া গজব করতে হো জি’ গানটিতে নায়িকা অরুণা ইরানির খুনসুটি এবং আবেদনকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে আশা ভোঁসলেকে বাদ দিয়ে আর কার কথাই বা ভাবা যায়। গানের পুরো দৃশ্যটি দেখলে এই কথার সত্যতা আপনাদের কাছে প্রমাণিত হতে বাধ্য। যেমন অরুণার সাবলীল অভিনয় তেমনই সেই তালে তাল মিলিয়ে আশার গায়কী। এক কথায় রাজযোটক। ‘ক্যায়সা তেরা পেয়ার‘ গানটি কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। লতা-অমিত মিলে আবারও আমাদের উপহার দিয়েছেন এই মিষ্টি গানটি।
কিন্তু দুষ্টুমিতে ভরা ‘ইয়ে লরকি জারাসি’ গানটি গাওয়ার গুরুদায়িত্ব পঞ্চম দিয়েছেন আশাকে, অমিতের জুটি হিসেবে। নির্ভুল ভাবনা। কারণ এই গানে মহিলা-কণ্ঠ হিসেবে আশার যে জুড়ি মেলা ভার! পুরো ছবিটিতে পুরুষকণ্ঠ হিসেবে রাজত্ব করে গিয়েছেন অমিত কুমার, তাঁর অতুলনীয় গায়কী এবং উপস্থাপনার মাধ্যমে। বাবার যোগ্য পুত্রের মতো। তাই আজও এই গানগুলি সেই সময়ের মতোই একই রকম জনপ্রিয়। বলা বাহুল্য, কিশোর অমিত কুমারের এই বিপুল সাফল্যে অত্যন্ত গর্বিত হয়েছিলেন। যেমনটি শোনা যায়, পঞ্চম এর সঙ্গেও তাঁর এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। পঞ্চম নিজেও নাকি কিশোরের কাছে উচ্ছসিত প্রসংশা করেছিলেন অমিতের।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৯: কম খরচে বেশি মাছ উৎপাদনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ জরুরি

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

আসে ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নরম গরম’ ছবিটি। গীতিকার সেই গুলজার। বলা বাহুল্য, পঞ্চম ও তাই যেনো একটু ভিন্ন। অথবা বলা যেতে পারে, একটু বেশি সচেতন। এই ছবির একটি গান ‘হামে রাস্তো কি জরুরত নেহি’ যেটি গাওয়ানো হয়েছে আশাকে দিয়ে, শুনলেই আপনারা চিনে নেবেন সেই অন্য পঞ্চমকে। গানটির মেলোডি কোথাও আপনাকে করে তুলবে আবেগতাড়িত। একবার নয়, বারবার শুনতে ইচ্ছে করবে গানটি।

একই কথা প্রযোজ্য এই ছবির আরো একটি গানের জন্য। ‘মেরে অঙ্গনা আয়েরে ঘনশ্যাম’ যেটি গেয়েছেন পঞ্চম-জায়া। গুলজারের লেখাটিকে একটি সেমি ক্লাসিক্যাল সুরে সুসজ্জিত করে আশাকে দেওয়া হয়েছে গানটি গাওয়ার গুরুভার। আশা যে সম্পূর্ণ রূপে সফল হবেন এ আর আশ্চর্য কি। প্রসঙ্গত, গুলজার এবং পঞ্চম দুজনেই আশার এই উপস্থাপনায় অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন।
তেমনই, আরও একটি মিষ্টি গান আশা গেয়েছেন এই ছবিতে। ‘মেরে ছেহেরে মে ছুপা’ গানটি এমন একটি গান যেটি হয়তো এই পৃথিবীর যেকোনো কন্যা সন্তানকে আবেগপ্রবন করে তুলবে। এই গানের কথাগুলির জন্য এই সুর ব্যতীত অন্য কোনো সুর যেনো চলতেই পারে না। যে কথায় এবং সুরে মিশে রয়েছে মা এবং বাবার প্রতি একটি মেয়ের শ্রদ্ধা, আবেগ এবং অপরিসীম ভালোবাসা। আর আশার কথা নতুন করে কি আর বলি বলুনতো? গীতিকার, সুরকার এবং গায়িকা—একসঙ্গে তিনজনেই যদি নিজেদের ১০০ শতাংশ দিয়ে নিজেদের মেলে ধরেন, তার ফল কি হতে পারে এই গানই তার প্রমাণ।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

গানের কথা যতই সাধারণ হোক অথবা গুরুপাক, গীতিকারের লেখার ছন্দ মিত্রাক্ষর হোক অথবা অমিত্রাক্ষর, সুরারোপ করার ব্যাপারে পঞ্চম পিছিয়ে থাকার পাত্র ছিলেন না। যেকোনও ধরনের লেখায় সুর করা যেনো ছিল তাঁর বাঁ হাতের খেলা। শুধু নিছক সুর করার জন্য নয়। সেই সুর এমন মাত্রার হতো যে গীতিকার তো বটেই, শ্রোতারাও তাজ্জব বনে যেতেন। বহু ক্ষেত্রে স্বয়ং গুলজার পঞ্চমের প্রসংশার ভাষা খুজে পাননি। আজও, অনেক ক্ষেত্রে পঞ্চমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি পঞ্চম সম্পর্কে যা যা বলেন সেগুলি শুনে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে পঞ্চমের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। আজও হয়তো কাগজ কলম নিয়ে বসে মনের কোণে জন্ম নেওয়া কোনও কবিতাকে লিপিবদ্ধ করার মুহূর্তে তাঁর দুচোখ খুজে বেড়ায় পঞ্চমকে। চোখের জলে অস্বচ্ছ হয়ে ওঠা দৃষ্টি হয়তো তাঁর কলমকে এক কঠিন শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে ক্ষণিকের জন্য। —চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content