বিপদ শব্দহীন। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।
এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণ
না। প্রাথমিকভাবে যে আশংকাটা মনে এসে যাবেই, এই ফোনটা সেই বেলভিউ নার্সিংহোম থেকে ছিল না। ফোন করেছিলেন সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে কীরা কাকিমা। সুরঙ্গমা এক ঝলক টেলিফোনের পাশে রাখা টাইম পিস-এর দিকে চোখ দিয়েছিলেন। ভোর পৌনে পাঁচটা।
—কীরা! এত ভোরে মানে তোমার ওখানে তো
—ইয়েস। মিডনাইট। প্রিসাইলি টুইয়েল্ভ ফিফটিন।
কীরা কাকিমা সব সময় মায়ের সঙ্গে ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলেন। খুব অসুবিধা হলে ‘আই মিন টু সে’ বলে ইংরেজিতে কথাটা বুঝিয়ে আবার বাংলায় ফিরে আসেন। ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। অথচ সেই মানুষটা আজকে ইংরেজিতে কথা বলছে শুনে মা’র মনে খটকা লাগলো।
—কি হয়েছে কীরা। তুমি এত ভোরে ফোন করছ গলাটা কেমন শোনাচ্ছে! ইজ এনিথিং রং।
—কীরা! কীরা কী হয়েছে আমায় বলো! কীরা! কীরা!
কোনওক্রমে পরের শব্দগুলো বলেই কীরা কাকিমা ফোনটা কেটে দিলেন।
—আই উইল কল ইউ ব্যাক!
কট করে একটা শব্দ। কাঁধে কারও হাতের ছোঁয়া পেয়ে মা চমকে উঠলেন। বাবা উঠে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। মা বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে ফোনের দিকে দেখালেন।
—কীরা! ফোন করেছিল। কি হয়েছে বলার আগেই… ফোনটা
—কেটে গেল?
—না। কীরা বলল ও ফোন করছে। …তুমি একবার চেষ্টা করে দেখবে।
—ওতো বলেছে ফোন করবে। একটু অপেক্ষা করো। তাছাড়া এখন তো ডিউটিতেও থাকতে পারে।
বাবার কথার মধ্যেই আবার ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠলো। এবার ফোনটা তুলতে মার যেন সাহসে কুলোচ্ছে না। বাবা সেটা বুঝে ফোনটা তুলে নিলেন।
—হ্যালো, কীরা আমি সেজদা বলছি।
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪১: সেই দুঃসংবাদ শোনার ক্ষমতা বসুন্ধরা ভিলার কারও ছিল না
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৮: সত্যব্রতর ছানবিন
—কি হয়েছে আমায় সব খুলে বল।
বাবা ফোনে কীরা কাকিমাকে বললেন—
—ওকে। উই উইল কল ইয়ু ব্যাক। টেক কেয়ার।
ফোনটা রেখে দিয়ে বাবা টেবিলের ওপরে মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েকটা মুহূর্ত বসে রইলেন। মাবুঝতে পেরেছিলেন একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু সেটা কী বা কতটা সাংঘাতিক তা বুঝতে পারছিলেন না।
—সরি বাবু! এত সকালে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম। হ্যাঁ আমি জানি আপনি আরলি-রাইজার। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসুন। বসুন্ধরা ভিলায় আপনাকে খুব জরুরি দরকার।
ফোনটা রেখে বাবা-মায়ের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসালেন।
—মন শক্ত করো সুরঙ্গমা। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। একটা বড় সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অনেককে তোমায় সামলাতে হবে। ম্যানচেস্টারে …
—ম্যানচেস্টারে কী? ওখানে তো আমার তনু গিয়েছে।
মা এভাবেই আগলে রেখেছে বসুন্ধরা ভিলাকে। তাই বিপদের মুহূর্তে মুখ দিয়ে “আমাদের তনু” না বলে ‘আমার তনু’ বেরোলো।
—আজ ২৩ তারিখ । ওর তো ছাব্বিশ তারিখ ফেরার কথা।
—কথা ছিল।
—ছিল মানে?? কোনও সমস্যা। তাই ফেরা পিছিয়ে গিয়েছে।
—তনুর আর কোনোদিন ফেরা হবে না সুরঙ্গমা। তনু আর নেই।
মা জীবনে কখনও এভাবে চিৎকার করে কেঁদে উঠেনি।
—না। এসব কি বলছো তুমি!!
বাবার উত্তর দেবার আগেই ঘরের টেলিফোনটা আবার ঝনঝন করে বেজে উঠেছিল। এবার মা ছুটে গিয়ে টেলিফোন তুলে বলে উঠল—
—হ্যালো কীরা বলো!
ফোনের ও প্রান্ত থেকে শান্ত গলায় সানন্দা জবাব দিয়েছিল
—কীরা কাকিমা নয় মা আমি সানন্দা কথা বলছি। এত টেনশন কিসের? একটু আগে ঋতুর একটা হেলদি বেবি হয়েছে। মেল বেবি। নরমাল ডেলিভারি। বাচ্চা মা দু’জনেই ভালো আছে।
সানন্দাকে বোধহয় অবাক করে মা টেলিফোন রিসিভারটা টেবিলের উপর রেখে বাবার দিকে তাকালো। ও প্রান্তের অবাক সানন্দার গলা রিসিভারের মধ্যে দিয়ে যান্ত্রিকভাবে শোনা যাচ্ছে।
—হ্যালো হ্যালো মা শুনতে পাচ্ছো।
বলেছিলাম না বসুন্ধরা ভিলায় এত নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে যা বলে বোঝানো যাবে না। জীবন-মৃত্যুর এমন নাটকীয় সন্ধিক্ষণ পৃথিবীর একপ্রান্তে স্রষ্টার শেষ অন্য প্রান্তে সৃষ্টির শুরু। কেউ কাউকে দেখলো না। কেউ কাউকে জানলো না।
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন
বাবা প্রথমেই ঋতুর পুত্রসন্তান লাভের কথা সকলকে বললেন। স্বাভাবিকভাবেই কারও মধ্যে সেই আনন্দসংবাদ কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। কারণ সকলেই সেই ভয়ংকর খবরের মূলটুকু তখন শুনে ফেলেছে। এরপর বিশদে জানা গেল।
তনুদাদার ২৬ তারিখ বম্বে হয়ে বিকেলের দিকে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল। লন্ডন থেকে ২৫ তারিখে প্লেনে ওঠার কথা। কিন্তু “নিয়তি কেন বাধ্যতে” কোন প্রয়োজন ছিলনা তবু তন্ময়কান্তি মাঞ্চেস্টার থেকে ২২ তারিখে গ্রিসের করফ্যু যাবার প্লেন নিয়েছিল। ম্যানচেস্টারে কনফারেন্স শুরু হবার পরই তন্ময় জানল কনফারেন্স ২৪ তারিখ নয় ২১ তারিখে শেষ হবে। মানে তার হাতে ২২ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত ফাঁকা সময়। সেই অনুযায়ী প্রাথমিক প্ল্যান ছিল সে আয়ারল্যান্ডের কীরা কাকিমার ওখানে যাবে। ফুলকাকা সেই সময় ব্রিস্টলে ছিলেন না।
ব্রিটিশ এয়ারট্যুরস ব্রিটিশ এয়ার ওয়েসেরই একটা অংশ। ফ্লাইট ৩২৮ বা ২৮ এম টেক অফ করার আগেই বাঁদিকের উইং-এঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। ফায়ার ব্রিগেড এয়ার ক্রুরা চেষ্টা করেও প্লেনের পিছনে বসা যাত্রীদের অনেককেই বাঁচাতে পারেননি।
প্লেনের সামনে থেকে পিছনে মধ্যের করিডরে আগুনের দেওয়াল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৩১ জন যাত্রী আর ৬ জন ক্রু মোট ১৩৭ জনের মধ্যে ৫৩ জন যাত্রী ২ জন ক্রু মারা যান। তন্ময় আর জিউস দু’জনের কেউই বাঁচেনি।
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৯: কম খরচে বেশি মাছ উৎপাদনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ জরুরি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা
১৯৮৫ সালের ২২ আগস্ট ম্যানচেস্টারে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা বসুন্ধরা ভিলার নিদারুণ ক্ষতি করেছিল। কিন্তু এই দুর্ঘটনা বিমানপরিষেবার নিরাপত্তার বিষয়ে যুগান্তর এনে দেয়। বেশিরভাগ যাত্রী মারা গিয়েছিলেন আগুনে-পোড়া বিমানের ভিতরের অংশের বিষাক্ত গ্যাস থেকে। এই দুর্ঘটনার পর – বিমানের ইমারজেন্সি এক্সিটের পাশে রাখা আসনের নকশা বদল করা হল যাতে দুর্ঘটনা কবলে পড়া বিমান থেকে দ্রুত যাত্রীদের নামানো সম্ভব হয়। অগ্নিনিরোধক সিট কভার অগ্নিনিরোধক দেওয়াল ও সিলিং এর ব্যবহার শুরু হল। এরপর থেকেই বিমানে ফ্লোর লাইটিং ব্যবস্থা শুরু হয়। বিমানের মধ্যে আরও বেশি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার এবং দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যাত্রীদের প্লেন থেকে খালি করার নতুন নিয়মাবলী চালু হয়।—চলবে।