বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ক্ষত্রিয়রাজাদের বংশবৃদ্ধির ইতিহাসে কুরুবংশবৃদ্ধির কাহিনিটি এক অনবদ্য সংযোজন। কুরুবংশরক্ষায় মহাভারতস্রষ্টা মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কুরুকুলের পিতামহী সত্যবতীর কন্যা অবস্থায়, মহর্ষি পরাশরের ঔরসজাত পুত্র তিনি। কুরুকুলের সঙ্গে তাঁর সংযোগ মায়ের সূত্রে। কুরুরাজ শান্তনুর বিবাহিতা স্ত্রী সত্যবতী। কুরুরাজ শান্তনুর নিঃসন্তান, দুই পুত্রের অকালমৃত্যুতে কুরুবংশরক্ষার তাগিদ অনুভব করলেন রানি। রাজা শান্তনুর প্রথমা পত্নী দেবী গঙ্গার পুত্র ভীষ্ম পিতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। বিমাতা সত্যবতী মহর্ষি বেদব্যাসকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে জানালেন, অয়ং শান্তনবঃ সত্যং পালয়ন্ সত্যবিক্রমঃ। বুদ্ধিং ন কুরুতেঽপত্যে তথা রাজ্যশাসনে।। এই সত্যপরায়ণ শান্তনুপুত্র। সত্যরক্ষার্থে তাঁর (বিবাহের মাধ্যমে) সন্তানোৎপত্তি ও রাজ্যশাসনে মতি নেই। অতএব শেষ আশ্রয়, শ্রীবেদব্যাস।

সত্যবতী, আজন্ম ব্রহ্মচর্যে নিরত পুত্রকে অনুরোধ জানালেন, স ত্বং ব্যপেক্ষয়া ভ্রাতুঃ সন্তানায় কুলস্য নঃ। ভীষ্মস্য চাস্য বচনান্নিয়োগাচ্চ মমানঘ!।। ভাইয়ের (বিচিত্রবীর্য্যের) কল্যাণে, আমাদের বংশরক্ষার কারণে ভীষ্মের অনুরোধে, আমার নিয়োগহেতু, হে নিষ্পাপ পুত্র, তুমি অনুক্রোশাচ্চ ভূতানাং সর্ব্বেষাং চ। আনৃশংস্যাচ্চ যদ্ব্র্রূয়াং তচ্ছ্রুত্বা কর্ত্তুমর্হসি।। প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে,সকলের (প্রজাদের) রক্ষার জন্যে, দুই (ভ্রাতৃ) বধূর প্রতি মমতাবশত, আমার বক্তব্য শোন।
পুত্র বেদব্যাসের কাছে মায়ের দাবি, বিধানবিহিতঃ স ত্বং যথা মে প্রথমঃ সুতঃ। শাস্ত্রীয় বিধানানুসারে কানীন পুত্র (কন্যাবস্থার পুত্র) তুমিই আমার প্রথমপুত্র অর্থাৎ জ্যেষ্ঠপুত্র। তাই পুত্রের কাছে মায়ের অনুরোধ, তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সমর্থো হ্যসি পুত্রক!। অনুরূপং কুলস্যাস্য সন্তত্যাঃ প্রসবস্য চ।। তুমি বাছা, পুত্রোৎপাদনে সক্ষম পুরুষ। তুমি দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে এই বংশের উপযুক্ত এবং প্রসবস্য অনুরূপম্ আমার পুত্র বিচিত্রবীর্যের তুল্য পুত্রের জন্ম দাও। মায়ের প্রস্তাবে সত্যবতীপুত্র শ্রীবেদব্যাস সম্মত হলেন। তস্মাদহং তন্নিয়োগাদ্ধর্ম্মমুদ্দিশ্য কারণম্। ঈপ্সিতং তে করিষ্যামি দৃষ্টং হ্যেতৎ সনাতনম্।। আপনার নিয়োগহেতু ধর্মসঙ্গত কারণেই (নিজের কামনা পূরণের জন্যে নয়) আপনার ইচ্ছাপূরণ করব। কারণ এটিই চিরকালীন প্রচলিত প্রথাহিসেবে দেখে এসেছি। বিচিত্রবীর্যের বিধবা পত্নী অম্বিকা, শাশুড়িমায়ের অনুরোধে নিয়োগপ্রথা অবলম্বনে, কুরুবংশধর উপহার দিতে সম্মত হলেন। সঙ্গমকালে মহর্ষির বিকট আকৃতি এবং আজন্ম ব্রহ্মচর্যসাধনের ফলে বিকৃত গন্ধ, তাঁর ঘৃণার উদ্রেক করেছিল। অম্বিকার ত্রুটি হল, তিনি আচার্য বেদব্যাসের সঙ্গে মিলনের সময়ে ঘৃণাভরে চোখদুটি মুদ্রিত রেখেছিলেন।মহর্ষি বেদব্যাস ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, কিন্তু মাতুঃ স বৈগুণ্যাদন্ধ এব ভবিষ্যতি। মায়ের দোষেই এর পুত্র অন্ধ হবে। ফলে অন্ধপুত্রের জন্ম দিলেন অম্বিকা। সেই পুত্রই ধৃতরাষ্ট্র।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৪: কাম না বাৎসল্যরস, কার জয়? দূষণ সর্বত্র, রাজগৃহের মনে ও মনান্তরে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

সত্যবতী এরপরে কনিষ্ঠা বিচিত্রবীর্যবধূ অম্বালিকাকে বেদব্যাসের সঙ্গে সঙ্গমে রাজি করলেন। অম্বালিকাও মহর্ষি বেদব্যাসের সেই ভয়াবহ আকৃতি দেখে ভীত, ত্রস্ত হয়ে সঙ্গমকালে পাণ্ডুবর্ণ হলেন। তাই তাঁর পুত্র হল পাণ্ডুবর্ণ।তাঁর নাম হল পাণ্ডু। মা সত্যবতী আবারও, পুত্র বেদব্যাসের কাছে আরও একটি পুত্র কামনা করলেন। অম্বিকা মহর্ষি বেদব্যাসের সঙ্গে মিলনের ভয়াবহ স্মৃতি বিস্মৃত হননি। তিনি শাশুড়ি সত্যবতীর কথা মানতে পারলেন না। অম্বিকা তাঁর পরমা সুন্দরী সালঙ্কারা দাসীটিকে বেদব্যাসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মহর্ষি বেদব্যাসকে পরম সমাদরে সেবায় তুষ্ট করলেন সেই দাসী। বেদব্যাস তাঁকে প্রণয় জানিয়ে কামসম্ভোগে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং পরিতুষ্ট হলেন। কামোপভোগেন রহস্তস্যাং তুষ্টিমগাদৃষিঃ। মহর্ষি দাসীটিকে আশীর্বাদ করে জানালেন, হে শোভনলক্ষণা, কোন উত্তম পুরুষ তোমার গর্ভে আসছেন। তিনি হবেন ধর্মপরায়ণ এবং বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অয়ঞ্চ তে শুভে!গর্ভঃ শ্রেয়ানুদরমাগতঃ। ধর্ম্মাত্মা ভবিতা লোকে সর্ব্ববুদ্ধিমতাং বরঃ।। ঋষি মাণ্ডব্যের অভিশাপে ধর্মরাজ, শূদ্রযোনী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনিই বেদব্যাসের ঔরসে এই শূদ্রাদাসীর গর্ভে জন্ম নিলেন। জন্মান্তরে সেই পুত্রের নাম হল বিদুর।তিনি ছিলেন কামক্রোধবিহীন, রাজনীতিবিদ।

ধর্মরাজ তাঁর দুষ্কর্মের কারণে বিদুররূপে জন্মগ্রহণ করেন। কারণ হল, ঋষি মাণ্ডব্যের অভিশাপ। কে এই মাণ্ডব্যমুনি? কেন এই অভিশাপ?মাণ্ডব্য মুনি, একজন, ধৈর্যশীল, ধর্মজ্ঞ, সত্যনিষ্ঠ, বিখ্যাত, মহাযোগী, মহাতপস্বী ছিলেন। তিনি, আশ্রমদ্বারে গাছেরতলায় মৌনী অবস্থায়, ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যারত ছিলেন যখন, সেইসমযে, কয়েকজন চোর চোরাইধনসহ আশ্রমে উপস্থিত হল।তাদের ধাওয়া করে সেখানে উপস্থিত হল রক্ষীপুরুষেরা। আশ্রমের লুকিয়ে পরল চোরেরা,তাদের সঙ্গে রইল অপহৃত চোরাই ধন। রক্ষীরা, মৌনী তপস্বী মাণ্ডব্যমুনিকে চোরদের বিষয়ে প্রশ্ন করল, কতমেব পথা যাতা দস্যবো দ্বিজসত্তম!। হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, কোন পথে গিয়েছে দস্যুরা? মৌনব্রতাবলম্বী মহর্ষি মাণ্ডব্য সঠিক বা বেঠিক কোনও উত্তরই দিলেন না।। রক্ষীপুরুষেরা আশ্রম তছনছ করে, খুঁজতে খুঁজতে, পেয়ে গেল, সেই চোরাই অপহৃত ধনসহ চোরেদের। রক্ষীদের সন্দেহভাজন হলেন মাণ্ডব্যমুনি। সন্দেহবশে তারা মুনিকেও বেঁধে নিয়ে হাজির হল রাজার কাছে। রাজা,বিচার করে চোরেদের সঙ্গে মাণ্ডব্যমুনিকেও শূলে আরোপ করে হত্যা করবার নির্দেশ দিলেন। রক্ষীরা আদেশ কার্যকর করল এবং অপহৃত ধনগুলি নিয়ে প্রস্থান করল।
শূলে বদ্ধ অবস্থায়, সেই ধর্মাত্মা ঋষি,অনাহারে থেকেও, তপস্যার বলে জীবনধারণে সক্ষম হলেন। তপোবলে ঋষি মাণ্ডব্য অন্যান্য মুনিদের আহ্বান জানালেন। সমবেত মুনিগণ, শূলে বদ্ধ, তপস্যারত, ঋষিমাণ্ডব্যকে দেখে ব্যথিত হলেন।রাত্রিতে মুনিরা পাখিদের রূপ ধারণ করে এসে স্বমূর্তিতে মাণ্ডব্যের কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁরা জানতে ইচ্ছুক, কোন পাপে মাণ্ডব্যমুনির এই কষ্ট? এই মৃত্যুদণ্ডভয়ের দুর্ভোগ?

শ্রোতুমিচ্ছামহে ব্রহ্মন্! কিং পাপং কৃতবানসি। যেনেহ সমনুপ্রাপ্তং শূলে দুঃখভয়ং মহৎ।। মুনি মাণ্ডব্য কাউকেই দোষারোপ করলেন না। তিনি জানালেন, কেউই তাঁর প্রতি কোন অপরাধ করেননি। কাকে দোষ দেবেন তিনি? দোষতঃ কং গমিষ্যামি ন হি মেঽন্যোঽপরাধ্যতি। নগররক্ষীরা দীর্ঘকাল পরেও মাণ্ডব্যমুনিকে শূলবিদ্ধ, একই অবস্থায় দেখে, রাজাকে এই তথ্য জানাল। রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। রাজা মাণ্ডব্যমুনির কাছে, না জেনে যে অপরাধ করেছেন, সেই কারণে, নিজের ত্রুটি ও দুর্ব্যবহারবিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি মহর্ষিকে ক্রোধ সংবরণের অনুরোধ জানালেন। যন্ময়াপরাধং মোহাদজ্ঞানাদৃষিসত্তম!। প্রসাদয়ে ত্বাং তত্রাহং ন মে ত্বং ক্রোদ্ধুমর্হসি।। মুনি প্রসন্ন হলেন।শূলবিদ্ধ মুনি মাণ্ডব্য মুক্ত হলেন। কিন্তু শূলের অগ্রভাগ বিদ্ধ অবস্থায় খণ্ডাকারে শরীরে রয়েই গেল। শূলের বাকি অংশ কেটে মুক্ত করা হল মুনিকে। অণী অর্থাৎ শূলের অগ্রভাগ।অণীযুক্ত মান্ডব্য। অণীমাণ্ডব্য ইতি চ ততো লোকেষু গীয়তে। তাই তাঁর নাম হলো অণীমাণ্ডব্য। শূলখণ্ড নিয়েই মাণ্ডব্যমুনি নানা দেশ পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। তপস্যায় বিশেষ পুণ্য অর্জন করলেন মুনি।পরিশেষে অণীমানণ্ডব মুনি, ধর্মরাজের কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, হে ধর্মরাজ, কিন্নু তদ্দুষ্কৃতং কর্ম্ম ময়া কৃতমজানতা। অজান্তে কী এমন দুষ্কর্ম করেছি আমি? যস্যেয়ং ফলনির্বৃত্তিরীদৃশ্যাসাদিতা ময়া। যার ফলে আমার এই কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে? শীঘ্রমাচক্ষ্বঃ মে আপনি শিগগির বলুন। তারপরে আমি, আমার তপস্যার শক্তি দেখাচ্ছি, আপনাকে। তত্ত্বং পশ্য মে বলম্

ধর্মরাজ জানালেন, ছেলেবেলায় বালক মাণ্ডব্য পতঙ্গের পুচ্ছে নলখাগড়া প্রবেশ করিয়েছিলেন। তার ফলেই এই কষ্ট ভোগ করছেন মাণ্ডব্যমুনি। অল্প দান করলেও যেমন তার বহুগুণ ফল হয় তেমনই,হে ব্রহ্মর্ষি, অল্প পাপও বহুদুঃখের মূলকারণ। অধর্ম্ম এবং বিপ্রর্ষে!বহুদুঃখফলপ্রদঃ মুনি জানতে চাইলেন,কোন বয়সে তিনি এই পাপ করেছিলেন? যথাযথ উত্তর দিন। কস্মিন্ কালে ময়া তত্তু কৃতং ব্রূহি যথাতথম্। ধর্মরাজ জানালেন, বালভাবে ত্বয়া কৃতম্ অর্থাৎ বালক অবস্থাতেই তাঁর এই অপরাধ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১২: তেত্রিশের ঐতিহ্য

মুনি অণীমাণ্ডব বিধান দিলেন, বালো হি দ্বাদশবর্ষাজ্জন্মতো যৎ করিষ্যতি। ন ভবিষ্যত্যধর্ম্মোঽত্র ন প্রজ্ঞাস্যন্তি বৈ দিশঃ।। জন্ম হতে বার বছর পর্যন্ত কোন শিশুর কোন কাজ অধর্মাচরণ বা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। দেবতারাও এই কাজকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করবেন না।

ব্রহ্মর্ষি অণীমাণ্ডব মনে করেন, ধর্মরাজ তাঁকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়েছেন। কারণ সকল প্রাণীবধ অপেক্ষা, ব্রাহ্মণবধের গুরুত্ব অধিক। তাই ঋষি, ধর্মরাজকে অভিশাপ দিলেন। ধর্মরাজকে মানুষরূপে জন্ম নিতে হবে এবং তার জন্ম হবে শূদ্রযোনীতে। মাণ্ডব্য ঋষি অপরাধবিষয়ে বয়সের সীমা নির্দিষ্ট করে দিলেন। মানুষের জীবনের প্রথম চোদ্দ বছরে কৃত দুষ্কর্ম, পাপাচাররূপে স্বীকৃত হবে না। চোদ্দবছর অতিক্রান্ত হলে তবেই দুষ্কার্য পাপরূপে পরিগণিত হবে। মাণ্ডব্যমুনির অভিশাপের ফলে, ধর্মরাজ, মনুষ্যজন্মে, বিদুররূপে শূদ্রামাতার গর্ভজাত পুত্ররূপে জন্ম নিলেন।

ধর্মরাজ তাঁর অভিশাপলব্ধ মানবজীবনেও নৈতিক চরিত্র ধরে রাখলেন। তিনি হলেন ধর্ম ও অর্থনীতিতে কুশল।লোভ ও ক্রোধবিহীন বিদুরের সবকাজই বিবেচনা এবং দীর্ঘ চিন্তাপ্রসূত। শান্তিপরায়ণ বিদুর, কুরুবংশের সর্বদাই মঙ্গলসাধনে নিরত ছিলেন।

মহর্ষি বেদব্যাসের অনুগ্রহে বংশরক্ষা হল কুরুকুলের।তিনি বিচিত্রবীর্য্যের দুই পত্নী এবং এক শূদ্রা দাসীর গর্ভে, তিনজন পুত্রের জন্ম দিলেন। পিতামহ ভীষ্মের তত্ত্বাবধানে তাঁদের শিক্ষাজীবন অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যাশ্রম অতিবাহিত হল।যৌবনে উপনীত তিনকুমারের মধ্যে, জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র, দৈহিকবলে শ্রেষ্ঠ। পাণ্ডু ধনুর্বিদ্যায় কুশলতম।ধর্মে ও ন্যায়পরায়ণাতায় বিদুরের খ্যাতি,ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ হল।
তিনপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র, দৃষ্টিহীনতার কারণে,রাজ্যাধিকার পেলেননা। গুণবান বিদুর ছিলেন পারশব। ব্রাহ্মণপিতা এবং শূদ্রা মাতার মিলনে জাত পুত্র পারশব পুত্র।তাঁরও রাজ্যাধিকার নেই। তাই রাজা হলেন পাণ্ডু।

অকৃতদার পিতামহ, মহান ভীষ্ম,নিশ্চিন্ত হয়ে বিদুরকে বললেন, ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা। সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুষ্মাসু কুলতন্তুষু।। আমার, সত্যবতীর, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস এবং তোমাদের ওপরে বংশরসূত্রটি অব্যাহত রাখবার দায়িত্বভার। তস্যৈতদ্বর্দ্ধতে ভূযঃ কুলং সাগরবদ্ যথা এই বংশ যাতে সাগরের মতো বিস্তৃত হয় তার উদ্যোগ নিলেন তিনি। বিবাহযোগ্য তিন কুরুকুমারের জন্যে, বিবাহযোগ্যা উপযুক্ত তিনকন্যার সন্ধানই,তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য এখন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

ক্ষত্রিয়দের বংশগতি অক্ষুণ্ণ রাখবার অনন্য দৃষ্টান্ত নিয়োগমাধ্যমে মহর্ষি বেদব্যাসের কুরুকুলরক্ষায় সক্রিয় যোগদান। আজন্ম ব্রহ্মচর্যে রত বেদব্যাস তাঁর মায়ের অনুরোধে সনাতন নিয়োগপ্রথায় অংশ নিয়েছেন। তিনি এটিকে ধর্মসঙ্গত কাজ বলেই মনে করেছেন। শান্তনুপত্নী কুরুরাজমহিষীর জ্যেষ্ঠপুত্রের কর্তব্য, দায়িত্বসহকারে পালন করেছেন। ঋষি ব্রহ্মচারী মিলনে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন কিনা জানা নেই। মিলনের সহচরী দুজনের প্রতিক্রিয়া তাঁর নিজের বর্ণনায় জানা যায়। মহর্ষি হয়তো অনুভূতিশীল ছিলেন নিশ্চয়ই। তাই তিনি অম্বিকার মিলনেচ্ছু শূদ্রাদাসীর সাগ্রহ অনুরাগে সাড়া দিয়েছেন। সহবাসশেষে তিনি শূদ্রাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন। হয়তো ধার্মিক বিদুরের মতো বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ বুদ্ধিমান পুত্রলাভ বেদব্যাসেরই সন্তুষ্টির ফল।নিয়োগপ্রথা যান্ত্রিকমিলন নয়, অনুভূতিরও স্থান ছিল সেখানে।

মুনি অণীমাণ্ডব্যের মৌনতার পরিণাম তাঁর শূলদণ্ডপ্রাপ্তি। এই মৃত্যুদণ্ড তাঁর মতো উদারমনা ঋষির প্রাপ্য ছিল না। মৌনতা সবসময়ে কাম্য নয়। পরিবেশ, পরিস্থিতিবিশেষে নিজের মত ও পথ, হয়তো জীবনরক্ষার স্বার্থে বিসর্জন দিতে হয়। তপস্বী তাঁর তপোবলে এই বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি কিন্তু তাঁর দণ্ডদাতা রাজার অনুরোধে ক্ষমাশীল হয়েছেন। রাজার প্রতি কোন বিদ্বেষভাব পোষণ করেননি। সেই একই ঋষি, তাঁর নিজের বালক অবস্থায়, ধর্মরাজপ্রদত্ত শাস্তি, পরিণতবুদ্ধিতে মেনে নিতে পারেননি। অপরিণতবুদ্ধির শৈশব, পাপপুণ্যের ভেদাভেদ বোঝেনা। শিশুর ন্যায় অন্যায়বোধ নেই। তাই অণীমাণ্ডব্য মুনির সিদ্ধান্ত যে কোন বিবেকবান মানুষের মানবিক স্বীকৃতি আদায় করে নেবে। ঋষি মাণ্ডব্যের অনুসরণে, আধুনিক ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় শিশু অপরাধীর বিচারের নির্দিষ্ট বয়সের শেষ সীমা ষোল বছর বয়স।ঋষি মাণ্ডব্য অপরিণত বুদ্ধির শিশুকে বিচারের ঊর্দ্ধে রেখেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত বিচারব্যবস্থার দিক্ দর্শন বলা যেতে পারে। যুক্তিনিষ্ঠতা মানুষকে সাহসী করে তোলে,মাণ্ডব্য নিজে মুনি।তাঁরতো কথাই নেই। তিনি ধর্মরাজকে অভিশাপ দিয়েছেন। ধর্মরাজের, নব মানবজনমে হয়তো বিদুররূপে নতুন অনেক বিবেচনা,অনেক বিচারবুদ্ধির উদয় হবে। নাবালক পাণ্ডবদের অনেক বিপন্ন অবস্থায় পরামর্শদাতার ভূমিকায় তাঁকে দেখা যাবে। এ হয়তো তারই সূচনা।

একটি প্রতিবাদ অনেক সম্ভাবনার জন্মদেয়।হস্তিনাপুরের কুরুবংশরক্ষার কাহিনিতে ঋষি অণীমাণ্ডব, একজন উদারমনা, পথপ্রদর্শক ব্রহ্মর্ষি, তাঁর সাহসিকতার জন্যে তাঁকে যুগান্তরের দিশারী বলা যেতে পারে। অনমনীয় মনোবল, পিঠে উদ্যত শাণিত শূলবিদ্ধ অবস্থাতেও সোচ্চার হয়।প্রতিবাদী সত্তা, ঊর্দ্ধতন দণ্ডনির্ধারকের ভ্রান্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এমন কি দণ্ডদান করতেও সক্ষম হয়। ঋষি মাণ্ডব্যের দৃষ্টান্ত কী আজও অনুসরণযোগ্য নয়?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content