শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মলিনবসনে নিরালঙ্কারা রানি কৈকেয়ী মন্থরার বিষমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয়ে, ভূশয্যা নিলেন। একে, সতীন কৌশল্যার দুঃসহ, আকাশছোঁয়া রাজমাতা হওয়ার সৌভাগ্য, তার ওপরে আবার স্ব-পুত্র ভরতের, রামের হাতে নিগ্রহ এবং প্রাণহানির আশঙ্কা —এইসব চিন্তা তাকে নিরন্তর দদ্ধ করতে লাগল। তিনি তাঁর কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। মলিন বসনে, একবেণী ধারণ করে, গোসা ঘরে খিল দিলেন রানি। রামের অভিষেকের আয়োজনের নির্দেশ দিয়ে রাজা দশরথ, প্রিয় রানির সঙ্গে প্রিয় সংবাদের আনন্দ ভাগ করে নিতে চাইলেন। সুসমৃদ্ধ সুসজ্জিত অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন রাজা। সেখানে রানি নেই। রানি কৈকেয়ী কোথায়? প্রতিহারি জানাল, দেবী ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে দ্রুতবেগে গোসা ঘরে প্রবেশ করেছেন। বিষন্ন, ক্ষুব্ধ, দুঃখে ভারাক্রান্ত মনে, রাজা গোসাঘরে খুঁজে পেলেন প্রিয় রানিকে।

এই সেই প্রাণপ্রিয়া, ভূমিতে শায়িতা নারী। রানি যেন বিচ্ছিন্ন লতাটি, স্বর্গ থেকে ভূমিতে অবলুণ্ঠিতা হয়েছেন যেন কোন দেবী, পুণ্যক্ষয়ের ফলে ভ্রষ্টা কোন কিন্নরী, সুরলোক থেকে বিচ্যুতা অপ্সরা কিংবা আবদ্ধা নিষ্পাপ হরিণীটি। মূর্তিমতী মায়ার মত প্রিয় রানি শুয়ে আছেন ভূতলে। হাতি যেমন, শুঁড় দিয়ে বিষে ভরা তীরে বিদ্ধ হস্তিনীর দেহ পরিষ্কার করে মেজে দেয় সেই রকম রাজাও,স্নেহভরে পদ্মনেত্রা কৈকেয়ীকে হাত বুলিয়ে মার্জনা করে দিতে লাগলেন। রাজা দশরথ রানির ক্রোধের কারণ জানতে চাইলেন।

রাজা, রানির ক্রোধোদ্রেকের কারণ এমন কোন কাজতো করেননি।কেন রানির এই অকারণ ক্রোধ? কেউ কী অপবাদ দিয়েছেন তাঁকে? তাহলে কেউ নিশ্চয়ই তাঁর অপমানের কারণ। রানি কি কোনও ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন? তাহলে উপযুক্ত চিকিৎসক রয়েছেন তিনি তার নিরাময়ের ব্যবস্থা করবেন। রাজা স্বয়ং এবং তাঁর পারিপার্শ্বিকের সকলেই রানির আজ্ঞানুবর্তী। রানির অভীষ্টসাধনে, রাজা দশরথ, প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। তাই বৃথা চোখের জলে শরীরকে কষ্ট না দিয়ে রানি জানিয়ে দিন—কে রানির প্রিয় বা অপ্রিয় কাজটি করেছেন, রাজা তার বিহিত করবেন। কোন বধ্য ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে হবে কী? কোন অবধ্যকে কী হত্যা করতে হবে? কোন ধনহীনকে নির্ধনে পরিণত করতে হবে?রাজা রানির সমস্ত ইচ্ছাপূরণেই রাজি আছেন।

রানি এত কষ্ট পাচ্ছেন কেন?
যাবদাবর্ত্ততে চক্রং তাবতী মে বসুন্ধরা রাজা আশ্বস্ত করলেন রানিকে, সূর্যের আবর্তনচক্র যে স্থান পর্যন্ত আবর্তিত হয় সেই পর্যন্ত আমার এই পৃথিবীব্যাপী রাজ্য। তাঁর রাজ্যের অধীন, যা কিছু রানির অভিলষিত, সেটিই রাজা তাঁকে প্রদান করতে উদগ্রীব। রাজা কী কারণে রানির ইচ্ছায় বাদ সাধবেন? রানি কী কোন কারণে ভীতা?তাহলে সূর্য কিরণ যেমন শিশিরবিন্দুকে নষ্ট করে তেমনি সেই ভয়ের কারণটিকেই তিনি বিনষ্ট করবেন। রাজা রানীকে ভরসা দিলেন। তত্ত্বং মে ব্রূহি কৈকেয়ি যতস্তে ভয়মাগতম্। তত্তে ব্যসনয়িষ্যামি নীহারমিব রশ্মিবান্।।
কামার্ত রাজা স্ত্রীর আসঙ্গলিপ্সায় কাতর।এইতো সুবর্ণ সুযোগ। রানি কৈকেয়ী রাজাকে প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ করতে চাইলেন। আগে শপথ,তারপরে তাঁর নিজের অভিলাষ প্রকাশ করবেন রানি। প্রতিজ্ঞাং প্রতিজানীথ যদি ত্বং কর্ত্তুমিচ্ছসি। অথচ তে ব্যাহরিষ্যামি যথাভিপ্রেতং ময়া।। রাজা দশরথ স্ত্রীর আবদারে সস্নেহে বললেন, যং মুহূর্ত্তকমপশ্যং ন জীবেয়মহং ধ্রুবম্। তেন রামেণ কৈকেয়ি শপে তে বচনক্রিয়াম্।। যাকে এক মুহূর্তকাল না দেখে আমি বেঁচেই থাকতে পারিনা সেই রামের নামে শপথ নিচ্ছি তোমার কথা রাখবই। রানি কৈকেয়ী বৃদ্ধ রাজার প্রতি কোনও করুণা অনুভব করলেন না। তিনি পরম সন্তোষ অনুভব করলেন এবং তার অতি ভয়ংকর অভিপ্রায় জানালেন। সাক্ষী মানলেন তেত্রিশ কোটি দেবতাকে। সত্যপরায়ণ, মহাতেজস্বী, ধর্মজ্ঞ, সত্যবাদী, পবিত্র, রাজা দশরথ,বর দিচ্ছেন আমাকে। হে দেবগন, শ্রবণ করুন। সত্যসন্ধো মহাতেজা ধর্মজ্ঞঃ সত্যবাক্ শুচিঃ। বরং মম দদাত্যেষ সর্ব্বে শৃণ্বন্তু দৈবতাঃ।। কিন্তু এত সব সদ্গুনের আধার রাজা তখন কামোমোহিত। কামেচ্ছা তাঁকে যেন সম্মোহিত করে রেখেছে।

রানি, রাজার আবেগকে আলোড়িত করলেন। স্মৃতিচারণ করলেন, সেই দেবাসুরের যুদ্ধের। যে যুদ্ধে আহত রাজাকে সেবা করে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন রানি। সেই ঘটনা কি স্মরণে নেই রাজা দশরথের? স্মর রাজন্ পুরাবৃত্তং তস্মিন্ দেবাসুরে রণে। তত্র ত্বাং চ্যাবয়চ্ছত্রুস্তব জীবিতমন্তরা।। শুধু প্রাণটুকুই অবশিষ্ট ছিল আপনার। আমার সেবায় আপ্লুত আপনি, আমায়, দুটি বরদানের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। রানি জানালেন, সেই গচ্ছিত বরদুটি আদায় করবার প্রশস্ত সময় সমাগত। ভীষণ জেদে, রানি ঘোষণা করলেন, রাজা বরদুটি যদি না প্রদান করেন তবে আজই আমি অপমানে প্রাণ ত্যাগ করব। তৎ প্রতিশ্রুত্য ধর্ম্মেণ ন চেদ্দাস্যতি মে বরম্।অদ্যৈব হি প্রদাস্যামি জীবিতং তদ্বিমানিতা।। আত্মহননের হুমকি দিলেন রানি। সম্মোহিত হরিণ যেমন পাশে ধরা দেয়, তেমনিই নিজের বিনাশে যেন উন্মুখ হয়ে কৈকেয়ীর কথার জালে ধরা দিলেন রাজা দশরথ। বাঙ্মাত্রেণ তদা রাজা কৈকেয্যা স্ববশে কৃতঃ। প্রচস্কন্দ বিনাশায় পাশং মৃগ ইবাত্মনঃ।। রাজা কামার্ত। এখনই তাঁকে বশীভূত করা সহজ। সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন রানি। সেই প্রতিশ্রুত বরদুটির প্রার্থনা করলেন রানি। অভিষেকসমারম্ভো রাঘবস্যোপকল্পিতঃ। অনেনৈবাভিষেকেণ ভরতো মে অভিষিচ্যতাম্।।

রামের যে অভিষেকের আয়োজন হয়েছে তা দিয়েই ভরতের যৌবরাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হোক। দ্বিতীয় বরটি বাকি রয়েছে। চীরাজিনধরো ধীরো রামো ভবতু তাপসঃ। ভরতো ভজতামদ্য যৌবরাজ্যমকণ্টকম্।। ওই ধৈর্যের আকর রাম,বল্কল আর পশুচর্ম ধারণ করে, যাক বনে। ভরতের যৌবরাজ্যাভিষেক নিষ্কণ্টক হোক।এটিই রানির পরম কামনা। এষ মে পরমঃ কামো দত্তমেব বরং বৃণে সেই প্রতিশ্রুত বরই আমি প্রার্থনা করি। হ্যাঁ, আজই যেন রাম বনে যায়। এটি আমি দেখতে চাই। অদ্য চৈব্য হি পশ্যেয়ং প্রয়ান্তং রাঘবং বনে রানি কৈকেয়ী পরকালের ভয় দেখালেন রাজাকে। সত্যপ্রতিজ্ঞ রাজা সত্য রক্ষা করে নিজ বংশ, চরিত্র ও জন্ম রক্ষা করুন। সত্যকথন মানবের পরকালের পক্ষে হিতকর হয়ে থাকে, এমনটাই তপোধন ঋষিরা বলে থাকেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৩: ঋষি দীর্ঘতমার কাহিনিতে প্রতিফলিত যুগচিত্র কি চিরন্তন? অন্য রঙে, অন্যরূপে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

বিমূঢ় রাজা ঘটনার অভিঘাতে, প্রথমে ক্রোধে আত্মহারা হলেন। তারপরে মনে করলেন এ নিশ্চয়ই দিবাস্বপ্নের ঘোর বা চিত্তবিভ্রম। পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি এই কারণদুটির একটিও খুঁজে না পেয়ে সংজ্ঞা হারালেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে, তিনি সম্মুখে রানি কৈকেয়ীকে দেখে শঙ্কিত হলেন। নগ্ন, আস্তরণহীন, মাটিতে বসে রাজা দশরথ। তাঁর মানসিক অবস্থা, ঠিক বাঘিনীর সম্মুখীন কর্তব্যবিমূঢ়, অসহায়, হরিণীর মতো কিংবা রাজা যেন মন্ত্রদ্বারা মোহাবিষ্ট তর্জনগর্জনসার সাপটি। চরম ক্রোধে রানিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন রাজা। রামের জননীতুল্যা কৈকেয়ী কেন এই সর্বনাশা খেলায় মেতেছেন? রামের কৈকেয়ীর প্রতি ব্যবহার যে নিজের মায়ের সমতুল্য। তবে কেন রানির এই অনিষ্টচিন্তা? রাজা এই বিষবতী কালসাপিনীকে ঘরে এনে নিজের বিনাশ ডেকে এনেছেন। কোন দোষে সকলের প্রশংসার পাত্র প্রিয় রামকে তিনি পরিত্যাগ করবেন? রাজা, রানি কৌশল্যা, সুমিত্রাকে, এমনকি রাজ্য এবং নিজের জীবনপর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন কিন্তু রামকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন না।
রামদর্শনে তাঁর আনন্দ, রামের অদর্শনে চেতনাহীন হয়ে পড়েন তিনি। সূর্যালোক বিনা মানুষ বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকে জল বিনা শস্যও। কিন্তু রাম বিনা রাজা দশরথ এক পলকের জন্যেও জীবনধারণে অক্ষম। রানি কৈকেয়ীর পা দুটিতে মাথা ঠেকিয়ে অনুনয় করলেন রাজা, হে পাপমতী নারী,প্রসন্ন হও।কেন এই নিদারুণ চিন্তা তোমার? তার কারণটা কি? অপি তে চরণৌ মূর্দ্ধা স্পৃশাম্যেষ প্রসীদ মে।কিমর্থং চিন্তিতং পাপে ত্বয়া পরমদারুণম্।। কৈকেয়ীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন রাজা, সেই যে “ধর্মজ্ঞ রাম আমার অতি প্রিয়” বলতে তুমি, সেই প্রিয়বাক্য বুঝি শুধু আমার থেকে সেবা অর্থাৎ সুবিধাগ্রহণের ফন্দীমাত্র? স মে জ্যেষ্ঠসুতঃ শ্রীমান্ ধর্ম্মজ্যেষ্ঠ ইতীব মে। তত্ত্বয়া প্রিয়বাদিন্যা সেবার্থং কথিতং ভবেৎ।।
কৈকেয়ী নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞা অথচ তাঁর ইক্ষ্বাকুকুলের প্রতি এই অনৈতিক প্রস্তাব—এ যে চিত্ত বিকারের লক্ষণ। রাজার ধারণা, রানির বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কারণ অতীতে কখনও রাজার অনভিপ্রেত কোন কাজ বা অকাজ রানি করেননি। রাজা রানির নিরপেক্ষ বাৎসল্যের প্রশংসা করলেন। ননু তে রাঘবস্তুল্যো ভরতেন মহাত্মনা। বহুশো হি স্ম বালে ত্বং কথাঃ কথয়সে মম।। তুমি আমার কাছে বহুবার বলেছ, রাম তোমার কাছে ভরততুল্য। এই রামের চতুর্দশ বৎসর বনবাস চাইছেন রানি। রানির প্রতি, রামের সেবাপরায়ণ মনোভাব, রানির স্বপুত্র ভরতের থেকেও বেশি। সেই সেবাপরায়ণ রামের বনবাসকামনা? কোন নারী, কোন দাস, ভুলেও রামের গুণের মধ্যে দোষ খুঁজে পেয়ে নিন্দামুখর হয়ে ওঠে না। নিরপেক্ষ, শুদ্ধচরিত্র, রাম, জনপদবাসীর অভিপ্রেত কাজ করে তাঁদের প্রিয় হয়েছেন। রাম দানধর্মের মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের, সেবার দ্বারা গুরুগণকে, ধনুর্যুদ্ধে শত্রুদের এবং সত্ত্বগুনদ্বারা সকলের মন জয় করেছেন। সত্ত্বেন লোকান্ জয়তি দ্বিজান্ দানেন রাঘবঃ। গুরূন্ শুশ্রূষয়া বীরো ধনুষা রুধির শাত্রবান্।। সমস্ত গুনের আধার, মহর্ষির মতো তেজস্বী, সরল, দেবতুল্য রামের প্রতি এই পাপাচরণ কেন? যে, সকল প্রাণীর প্রতি প্রিয়বাক্য বলে, তাকে কি করে এই অপ্রিয় বাক্য বলি আমি? ন স্মরাম্যপ্রিয়ং বাক্যং লোকস্য প্রিয়বাদিনঃ। স কথং ত্বৎকৃতে রামং বক্ষ্যামি প্রিয়মপ্রিয়ম্।।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৪: আরডি-র গানে সারা পৃথিবীর মিউজিক উঠে এসেছিল

সেই রাম বিনা রাজার কেমন দশা হবে?হাহাকার করে উঠলেন রাজা। তমৃতে কা গতির্মম বেদনাতুর রাজা দশরথ, রানির কৃপাপ্রার্থী আজ। মম বৃদ্ধস্য কৈকেয়ি গতান্তস্য তপস্বিনঃ। দীনং লালপ্যমানস্য কারুণ্যং কর্ত্তুমর্হসি।। আমি বৃদ্ধ, আমার দিন শেষের পথে, আমি কাঁদছি, আমার এই করুন দীনদশাতেও কী তুমি কারুণ্যে অক্ষম? রাজা দশরথ, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর। তিনি তাঁর নিজের অধিকৃত বসুধার যে কোন দ্রব্য রানিকে প্রদানে ইচ্ছুক। শুধু একটাই অনুরোধ, রাজার মৃত্যুর মতো এই অনুরোধ যেন রানি ফিরিয়ে নেন। তৎ সর্ব্বং দাস্যামি মা চ ত্বং মৃত্যুমাবিশ। রামের প্রতি অপরিসীম আস্থায়, রাজা দশরথ করজোড়ে, কৈকেয়ীর পদমূলে মিনতি করলেন, শরণং ভব রামস্য মাধর্ম্মো মামিহ স্পৃশেৎ। তুমি শুধু রামের শরণ নাও, তাহলেই অধর্ম আমায় স্পর্শ করবে না।
দুঃখে ভেঙ্গে পরেছেন বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর রাজা দশরথ। তাঁর শেষ আশ্রয় সেই পরম প্রিয় রাম।একজন রানির পদতলে কম্পমান,চেতনাহীন রাজার গরিমা নিঃশেষিত প্রায়।জীবনের উপান্তে তিনি গভীর দ্বন্দ্বের সম্মুখীন।আজ, মহাসঙ্কটে রাজা দশরথ তথা রঘুবংশের উত্তরাধিকার।

রানি কৈকেয়ী যেমন অকপটে রামের প্রতি তাঁর স্নেহ ব্যক্ত করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে তাঁর সারল্যের পরিচয়। কিন্তু একজন রাজমহিষীর ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করেছে একজন দাসী। মন্থরা তার কথার জালে জড়িয়ে ফেলেছেন কৈকেয়ীকে। প্রথমে উদারমনা এক মায়ের পদস্খলন ঘটেছে পরবর্তীপর্যায়ে। মন্থরার মন্ত্রণার বিষের প্রভাবে ক্ষণভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব রানি, স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।রাজার,রাজ্যের,সাধারণের ইচ্ছা কী? সেই চিন্তা একবারের জন্যেও তাঁর মনে স্থান পায়নি। একজন জটিলা, কুটিলা অন্তঃপুরচারিণীর ভূমিকায়,মন্থরার সমপর্যায়ে প্রায় অধঃপতন হয়েছে রাজা দশরথের প্রিয় রাজমহিষীর। তিনি বয়সে নবীনা, বৃদ্ধরাজার তরুণী ভার্যা। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। সপত্নীদের প্রতি প্রবল ঈর্ষায়, নিজের পুত্রের মন্থরাকথিত ভাবি দুর্গতির চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। এটি হয়তো তাঁর বয়সের ধর্ম। কিন্তু তাঁর অপরিণামদর্শিতার ফলে সাহিত্যের ইতিহাসে খলনায়িকার ভূমিকায় চিরকালের জন্যে চিহ্নিত হলেন দশরথপত্নী ভরতমাতা কৈকেয়ী।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা

রাজা দশরথ কামার্ত, ভোগী পুরুষ।অন্তঃপুরে নবীনা কৈকেয়ীর প্রতি বৃদ্ধরাজার বিশেষ প্রীতি। বাৎসল্যে, তিনি পুত্রদের ক্ষেত্রে সমদর্শী। সেক্ষেত্রে নিজগুণেই রামচন্দ্র পিতার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। কৈকেয়ীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ, রাজার যুবরাজনির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি কৈকেয়ীর এমন অকল্পনীয় দাবি আশা করেননি। তাঁর এমন কোন মানসিক প্রস্তুতিই ছিলনা। নিজের দেওয়া বরদানের প্রতিশ্রুতি যে বুমেরাং হয়ে তাঁকেই শূলবিদ্ধ করবে, এটি তিনি ধারণাই করতে পারেননি। রানি কৈকেয়ী, রাজার কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়ে নিপুণা, রাজনীতিতে অভিজ্ঞা, নারীর মতোই বর চেয়ে নিয়েছেন। কামনার বশবর্তী হয়ে আবেগতাড়িত রাজা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সসাগরা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর রাজা প্রথমে, আদুরে স্ত্রীকে এতটাই প্রশ্রয় দিয়েছেন যে রানি জনবিরোধী অসম্ভব প্রস্তাবেও সাহসিনী হয়েছেন।

রানি গোসাঘরে খিল দিয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য নিজস্বার্থে এক বিখ্যাত বংশের ভাবি সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রের ভবিষ্যতকে তিনি এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন করে তুলেছেন। কামার্ত রাজার ভোগেচ্ছা বাৎসল্যরসে ভেসে গিয়েছে। রাজা দশরথ, অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েও নিজের তথা সামগ্রিক সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। রাজোচিত গুণে, যোগ্যতার মানোত্তীর্ণ রামকে, পরিত্যাগে অসম্মতি—রাজা দশরথের মতো সুশাসকের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত।
অনেকসময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি, সাধারণকেও, অনেক অবাস্তব, অসম্ভব, প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করে।পরবর্তীকালে তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে জীবনে। রাজারা বহুবল্লভ, প্রেয়সীকে প্রদত্ত অনেক প্রতিশ্রুতি তাঁদের অপরিণামদর্শিতার ফল।

রাজা দশরথ হয়তো স্ত্রীর সেবায় আপ্লুত হয়ে সকৃতজ্ঞচিত্তে বরদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রানি সেই বরদুটিই, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে কামনা করেছেন। এমনটাই হয় বোধ হয় জীবনে। প্ররোচনা, মানুষের মনে যে দূষণ ছড়িয়ে দেয়,তার প্রতিরোধে ঋজু, কঠিন, টানটান শিরদাঁড়া কজনের হয়? আমরা প্রভাবিত হই, কলুষিত হয়ে বিষোদ্গার করি, দূষিত করি পরিবেশ, পরিস্থিতি।

পরে শুধু থেকে যায় পরিতাপ আর অনুশোচনা। পরিণাম? হয় মৃত্যু, না হয়,পশ্চাত্তাপের আঁচে দগ্ধ হতে হতে আধমরা অবস্থায় বেঁচে থাকার জীবনযাতনা, রামায়ণের রাজা দশরথের মতো।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content