সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অর্কপ্রতিম দে।

ছোট থেকেই বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলের ছাত্র আমি। তাই আমার পক্ষে ২০২১ সালে সেই না হওয়া মাধ্যমিকের ফল হাতে পেয়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়, নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব সহজ কাজ ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কি, পড়াশুনা ভালো হয় বলে আমি নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হইনি, হয়েছিলাম মানুষ হওয়ার শিক্ষা পাওয়ার তাগিদে। আর জানি না, সেই শিক্ষা নরেন্দ্রপুরের থেকে আমি কতখানি নিতে পেরেছি। তবে নরেন্দ্রপুর তার শিক্ষকতায় কোনও ত্রুটি রাখেনি।
যখন এখানে ভর্তি হই, যত না আমার ইচ্ছা ছিল একটা কেরিয়ার তৈরি করার, তারও চেয়ে বেশি ইচ্ছা ছিল নতুন ভাবে, নতুন কিছু শেখার। অদ্ভুত ব্যাপার, এহেন বিষম চাহিদা নিয়ে নরেন্দ্রপুরের কাছে এলেও নরেন্দ্রপুর কিন্তু আমায় নিরাশ করেনি, যেমনটা নরেন্দ্রপুর করে না যারা কেবল কেরিয়ারই গড়তে চায়, তাদেরকে।

নরেন্দ্রপুরের শিক্ষকরা আমাদের অতি যত্নে বিজ্ঞান পড়িয়েছেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক ও রাশিবিজ্ঞান ছিল আমার পাঠ্য বিষয়। সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি তো ছিলই। নরেন্দ্রপুরে এসে আমি প্রতিটি বিষয়ের এমন সব শিক্ষক পেয়েছি, যারা কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে পড়াতে গিয়েও আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেন জানার ইচ্ছা—জিগীষা। যে জিগীষা সবসময় মানুষকে ঠেলে দেয় অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে। যার একমেবাদ্বিতীয়ম লক্ষ্য জানা এবং জানা—সেই জিগীষা। আর তাই আজ আমি এ কথা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, নরেন্দ্রপুর আমায় জানতে শিখিয়েছে, আমায় ভাবতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুন:

উচ্চ মাধ্যমিকে দশের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না, তবে মন বলছিল—আমি পারব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

সত্যি কথা বলতে, উচ্চমাধ্যমিক বা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে আমায় ভালো ফল করতে হবে, এই ভেবে আমি কোনওদিনই পড়াশুনা করিনি, পড়িনি নিয়ম বেঁধেও। যখন ইচ্ছা হয়েছে পড়েছি, কিন্তু যেটুকু পড়েছি, প্রকৃতির রহস্যকে জানার জন্য, মন দিয়ে, ভালোবেসে পড়েছি। আর নরেন্দ্রপুর সে কাজে আমাকে কখনও বাধা দেয়নি। আশ্চর্য লাগতে পারে এই ভেবে যে, আমি নরেন্দ্রপুর শব্দটায় ব্যক্তিচেতনা আরোপ কেন করেছি। আসলে নরেন্দ্রপুর আমায় শিখিয়েছে, নরেন্দ্রপুর আসলে কোনও স্থান বা বিদ্যালয় নয়, নরেন্দ্রপুরের সঙ্গে যুক্ত সবাই, হেডমাস্টারমশায় থেকে শুরু করে হোস্টেল ওয়ার্ডেন কিংবা বাগানের মালি পর্যন্ত সবাই নরেন্দ্রপুরের অন্তর্ভুক্ত। নরেন্দ্রপুর তাই এক মহতী চেতনা, অসংখ্য ব্যক্তিচেতনার সমাহার।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: চুপি চুপি ঘুরে আসি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

নরেন্দ্রপুর শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল হোস্টেল জীবন। এখানেই একজন ছাত্রের ভবিষ্যতের ভিত তৈরি হয়। নরেন্দ্রপুরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সাপ্তাহিক সাফাইকাজ বা ভবনজয়ন্তী পালন এবং অবশ্যই নরেন্দ্রপুরের বন্ধুবৃন্দ—এরা সবাই সেই ভিতের অপরিহার্য অঙ্গ।
আমার ক্ষেত্রেই ধরা যাক, যখনই কোনও বিষয় ক্লাসে বুঝতে আমি অক্ষম হয়েছি, তখনই সে বিষয় আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কোনও এক বন্ধু। পরীক্ষার আগের দিনগুলোয় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপস্টাডিগুলো না থাকলে এমন ফলাফল হত কিনা সন্দেহ। আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পিছনে আমার যতটা অবদান, আমার শিক্ষকদের এবং বন্ধুদের অবদানও কম কিছু নয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৮: মেয়ের জন্য হেমন্তবালা কবির পরা জোব্বা নিয়েছিলেন

এখন আসি আসল কথায়, মানুষ হওয়ার শিক্ষায়। আমার যখনই শরীর খারাপ হয়েছে, তখনই কোনও এক বন্ধু রাত জেগে পাশে থেকেছে, তার শরীর খারাপের রাতে জেগেছি আমিও। আরও অনেক অনেক শিক্ষা পেয়েছি নরেন্দ্রপুর থেকে, নরেন্দ্রপুরের নিয়মশৃঙ্খলা, ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি অঢেল ভালোবাসা আমাকে আপ্লুত করেছে।

তাই, আজ আমার এই যে সাফল্য, এর প্রায় সব কৃতিত্বই নরেন্দ্রপুরের প্রাপ্য। আর কিয়দংশ প্রাপ্য আমার বাবা-মায়েরও। তারা যেভাবে আমার পাশে থেকেছেন সর্বদা, আশার আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছেন নৈরাশ্যের অন্ধকার রাতে—তার জন্য আমি তাঁদের কাছে ঋণী। জানি না ভবিষ্যতে কী হব,কিন্তু যা-ই হই না কেন,এটুকু আশা রাখি যে দেশের একজন সৎ,দায়িত্বশীল প্রকৃত নাগরিক হতে পারব,আর আমার এই নাগরিক হয়ে ওঠার কৃতিত্বটার একটা বড় অংশের ভাগীদার নরেন্দ্রপুর আর আমার মা ও বাবা।
* অর্কপ্রতিম দে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭তম স্থান অধিকারী।

Skip to content