রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


প্ল্যানচেট বোর্ড। ছবি: সংগৃহীত।

নিজে ডাক্তার হলেও আমার ফুল কাকা ডাক্তার বিমল কান্তি খুব প্ল্যানচেট করতেন এবং প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করতেন। এমনকি বিলেতেও নিয়মিত প্লানচেট করতেন। নিজের পরিচিত মৃত রোগীদের প্ল্যানচেটে নিয়ে আসতেন। বড় ঠাম্মিকেও আনতেন বলে শুনেছি। বড় ঠাম্মি বসুন্ধরা নয় তাঁর পুত্রবধূ মানে আমার ঠাম্মি স্বর্ণময়ীর কাছে প্রায় জেদ করে ইংরেজি শিখেছিলেন। ফুল কাকার বিলিতি রুগীদের তো ইংরেজিটাই মাতৃভাষা। কিন্তু আমাদের বাড়ির সেই বহু পুরনো নির্মল নাপিত বা কলেজস্ট্রিটের ঠাকুর বলভদ্রকে প্ল্যানচেটে ডাকার সময় বাংলা বা ওড়িয়া লিখতে হবে নাকি তারাও ইংরেজি বুঝতে পারবে? সেটা কখনও ফুলকাকাকে জিগ্যেস করা হয়নি। আর ফুল কাকার সঙ্গে সম্পর্কটা এত খোলামেলা ছিল না, ছোটকা কেকে হলে পট করে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম।

কেকে’র কথায় মনে হল আমার উপন্যাসের এখনকার এই যে চরিত্র। শিবানী সেন। বিয়ের পরে রায়। তিনি তো মৃতা নন। এখনও জীবিত। এখনও মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেন। তিনি তো জানেনই না বসুন্ধরা ভিলার কেউ একজন একটি উপন্যাসে তার কথাও লিখছে। তিনি জানলে ক্ষুব্ধ হবেন। মানহানির মামলা করে কোর্ট-কাছারি করতে পারেন। সেসব হলে মন্দ হয় না। বিতর্ক হলে বিখ্যাত হবে। বিক্রি বাটা বাড়বে। ছক কষে বিতর্ক তৈরি করে ফায়দা তোলা নতুন কিছু নয়। মানব সমাজের পুরনো জোচ্চুরি। আগে ছাপা হোক তারপর এসব ভাবা যাবে।

টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার কাছাকাছি থাকলেও শিবানী সপ্তাহের তিন দিন সূদুর দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছুটতো নাটক করতে। ইন্দ্র দু’ একটা ছবিতে এককভাবে নৃত্য পরিচালনা করেছে। দু’ এক জায়গায় গ্রুপ ডান্সের কাজও করতো। শিবানী চাইলে হয়তো টালিগঞ্জের ছবি করতে পারত। কিন্তু ইন্দ্র এ নিয়ে তাকে কিছু বলেনি। ছবির জগতটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে বলেই ইন্দ্র হয়তো সেটা চায়নি।
দু’ জনের রোজগারে ওরা সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিল। দাম্পত্যে পূর্ণতা দিতে শিবানীর সন্তান এল। ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলোয় জন্ম নিল ফুটফুটে এক মেয়ে। ইন্দ্র আর শিবানী মিলিয়ে নাম রাখল ঈশানী। শিবানীর মত ঈশানীও মা দুর্গারই- নাম। তিনি ঈশ্বর ঘরণী মহেশ্বরী। তবে শিবানী একবার ভুল করে হস্র-ই লিখে ফেলেছিল। মুখে না বলে ইন্দ্র কেটে দিয়ে পাশে লিখেছিল ঈশানী বানান দীর্ঘ ই-কার।

এরপর ইন্দ্র শিবানীর গল্পের শেষ লাইনটা হতে পারত—“এই রূপে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ইন্দ্র শিবানী ও তাহাদের শিশুকন্যা ঈশানীর বাকি জীবন কাটিয়া গেল।” কিন্তু তা হলো না।

আমাদের আশেপাশে আমরা এমন অনেককে দেখি যারা দিনের পর দিন অন্যায় করে অসৎপথে অর্থরোজগার ও জীবনযাপন করেও দিব্যি খোশমেজাজে আছে। আসলে আমরা যা দেখি সেই সেটাই সবটুকু নয়। আমাদের চোখের আড়ালে অনেকটা থেকে যায় যেটার খবর আমরা রাখিনা। অর্থ স্বাচ্ছন্দ্য আয়েশ রোজগার করা যায় সুখ শান্তি নীরোগ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ইচ্ছে করলেই রোজগার করা যায় না। সাফল্যকে আস্তিকরা বলেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ নাস্তিকরা বলেন অর্জিত সৌভাগ্য। উল্টোটা দুর্দশা দুঃখভোগ নাস্তিকের কাছে শুধুই দুর্ভাগ্য জীবনের অনিবার্য উত্থানপতন। আস্তিকের কাছে তাই ঈশ্বরের অভিশাপ। জ্ঞাত-অজ্ঞাত অন্যায় বা পাপের শাস্তি।

ঈশানীর যখন ঠিক ২ বছর বয়েস তখন শিবানীর জীবনে অঘটন ঘটে গেল। মেয়ের জন্মের ছ মাস আগে থেকে থিয়েটারে ছুটি নিতে হয়েছিল। বনানীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে ওর স্বামী নৃপেন্দ্র চুঁচুড়াতে বনানীর স্কুলেরই মাস্টারমশাই। দু’ জন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। একই স্কুলের চাকরি নৃপেন্দ্ররা বর্ধমানের লোক। চুঁচুড়ার একটা ঘর নিয়ে ভাড়া থাকতো। নৃপেন্দ্র প্রথমে কিছুতেই রাজি হয়নি, কিন্তু বাবার অনুরোধ রেখে শিবানীদের চুঁচুড়ার বাড়িতেই নৃপেন্দ্র ও বনানী থাকে। শিবানীর বিয়ের খবর পাওয়ার পরেও যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সন্তান-সম্ভাবনা জানবার পর শুভ্রা নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। ছুটে গিয়েছিলেন মেয়ের কাছে। নস্কর পাড়া রোডের ওই ছোট্ট ঘরে তিনজন থাকা খুবই কষ্টকর।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৩: মানুষটার লোভ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

তবু ইন্দ্র, শিবানী শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে কষ্টটাকে মানিয়ে নিয়েছিল। মাঝে একটা আলমারি আর মেশনাইড বোর্ডের পার্টিশন দিয়ে এক চিলতে অংশে ইন্দ্র রাতে শুতো। মেয়ের জন্মের মাস তিনেক পর থেকে আবার শিবানীকে থিয়েটার জয়েন করতে হল। বাচ্চাকে মানুষ করার খরচ রয়েছে। কত দিন বাড়ি বসে থাকবে। শুভ্রা নাতনিকে দেখতেন। মেয়ে জামাই কাজে বেরিয়ে যেত। কখনও শুভ্রাকে চুঁচুড়া যেতে গেলে ইন্দ্র বাড়িতে মেয়ে সামলাত। এ ভাবেই চলছিল।

ইন্দ্র শিবানী দুজনেই চেষ্টা করছিল যাতে একটা দু’ কামরার বাড়ি খুঁজে উঠে যাওয়া যায়। নতুন নাটকে শিবানীর চরিত্রটা সেকেন্ড লিড মানে উপনায়িকা তকমাটা ব্যবহার করা যায়। বিনোদন জগতের বৃত্তটা ছোট তাই সিংহানিয়ার সঙ্গে দেখা যে হয়নি তেমন নয়। কিন্তু শিবানী আর সেই অতীতটাই ফিরতে চায় না তাই দূর থেকেই এড়িয়ে গিয়েছে। যাতে মুখোমুখি হতে না হয়। আজকের এই আধুনিক দিনেও বিনোদন জগতে এরকম অনেক অতীত সম্পর্ক বন্ধ খামে মুড়ে বহু মানুষ পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে সংঘাত বাঁচিয়ে নিজেদের পথে এগিয়ে চলেছে।

শিবানীর মাসের রোজগারটা আরও বাড়ল। ইন্দ্র’র কাজে সেরকম উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। সেদিন সোমবার। সপ্তাহের শুরু। গতরাতে শো শেষ করে শিবানীর ফিরতে দেরি হয়েছিল। বাংলা ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নায়িকা কাশী বিশ্বনাথের অভিনয় করছেন। প্রায় প্রতি শো হাউসফুল। সেদিন ডবল শো। সেদিন নায়িকার জন্মদিন। শো এর আগের সময় পাওয়া যায়নি। তাই শো-য়ের শেষে নায়িকার জন্মদিনের ছোট্ট পার্টি আয়োজন করা হলো। প্রযোজকের আয়োজন। তার ওপর নায়িকার সম্মানের প্রশ্ন। শিবানীর না বলার উপায় ছিল না। এখন রাতে ফেরার সময় বাইরে ট্যাক্সির ওপর ভরসা না করে হলের মালিকই ভাড়া গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

রিভিউ: ‘ঘুমর’ আসলে জীবনকে ফিরে পাওয়ার গল্প

তবে ভাড়ার টাকাটা হিসেব করে প্রত্যেকের থেকে কেটে নেওয়া হয়। নায়িকার জন্মদিন বা পার্টির কোন বিষয়ে শিবানী সত্যিই কিছু জানতো না। তখনো মোবাইল আসেনি, ল্যান্ড ফোনের যুগ। পাড়ার এসটিডি বুথে খবর দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় বলেই আর খবরটা দেয়নি। ইন্দ্র খুব দুশ্চিন্তা করছিল। শিবানী দেরি করে ফেরায় সম্ভবত দুশ্চিন্তার কারণেই এই প্রথম ইন্দ্র একটু উষ্মা প্রকাশ করল। ডাবল শোতে শারীরিক ধকল ফেরামাত্রই মায়ের প্রশ্ন, “দেরি হল কেন?” তারপর সমস্ত সময় মুখ বুজে থাকা শান্ত ধীরস্থির ইন্দ্রকে সেদিন হঠাৎ উত্তেজিত দেখে শিবানী রাগ সামলাতে পারল না, যা কখনও হয় না তাই ঘটে গেল। বাড়ির বাইরে ভাড়ার গাড়িটা চলে যাবার পরেই শিবানী বলে উঠল—

—এ ভাবে তাকিয়ে আছো কেন তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো? বলছি তো আজকের কারণটা আমি জানতাম না। জন্মদিনের পার্টি এটেন্ড করতে হয়েছিল। উপায় ছিল না। সাউথের সকলে একসঙ্গে ফিরবে একই গাড়িতে।

— একটা ফোন তো করবে?

—তোমার বাড়ির ল্যান্ডলাইনে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৫: একটাই ডেনজার জুজু যদি ধরে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

কথাটা যেন চাবুকের মতো আঘাত করল ইন্দ্রকে। শাশুড়ি মা আসার পরে ঘরের মধ্যে একটা চিলতে জায়গা বার করে ইন্দ্র তার নিজের শোবার ব্যবস্থা করেছে তাকে ল্যান্ডলাইনের কথাটা তুলে যেন ইন্দ্রর আত্মমর্যাদাকেই ভয়ংকরভাবে ভেঙে দিল শিবানী।

—তুমি তো আর পাঁচটা চাকরি করার লোকের মত নয়। এই প্রফেশনের লোক। তুমি তো বোঝো যে সময়ের লাগামটা আমাদের হাতে থাকে না। অন্যদের কন্ট্রোল করার মতো অন্যদের আমার সময় অনুযায়ী এখনও চালানোর মতো জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। না তুমি না আমি।

—সরি।

সে রাতে সেটাই ইন্দ্রর শেষ কথা।শিবানীর সঙ্গে বসে মুখ বুজে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। পরদিন ইন্দ্রকে বারাসাতের এক জায়গায় যেতে হবে। একটা নাচের গ্রুপের ব্যাপারে কথা বলতে তাদের প্রোগ্রামের রিহার্সাল করাতে। অনেকটা ভোরে উঠে সেদিনের বাজার করে ইন্দ্র প্রায় তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেল। অনেক রাতে ফিরেছে ক্লান্ত ছিল তাই শিবানী ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছিল। শাশুড়ি শুভ্রার কাছে এক কাপ চা খেয়েই বাড়ি ছেড়ে গেল ইন্দ্র।

—কি মুশকিল একবার ডাকবে তো আমাকে? —চলবে।

জীবনের ঘুলঘুলি: ছবি: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩৫

সারাটা দিন শিবানীর অস্বস্তিতে কেটেছে। আজকের এই মুহূর্তের যোগাযোগের দিনে এসে সে সময়ের অনুভূতিটা ঠিক ভাবা যায় না। শিবানী ঠিক করে নেয় ইন্দ্র বাড়ি ফিরলেই আজ পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কথা দেবে যে এমন ভুল আর কোনও দিন হবে না।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content