রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


গিজা মালভূমিতে স্ফিংস ও পিরামিড। ছবি: সংগৃহীত।

নীলনদের দেশ। মরুভূমি ও দীর্ঘতম নদীর দেশ। সেই ছেলেবেলার ভূগোল বইতে পড়া মিশর। কায়রো বিমানবন্দরে পৌঁছে যাত্রা শুরু। বিমানবন্দরটি বেশ সাজানো গোছানো। বেরোনোর রাস্তায় কৃত্রিম খেজুর গাছ। বিমানবন্দর থেকেই কারেন্সি বদল করে ওদেশের পাউন্ড নিয়ে নিলাম সবাই। এ দেশের একজন গাইড শুরু থেকে ছিলেন আমাদের সঙ্গে। কায়রো নেমে ওর সঙ্গে ওদেশের এক তরুণী আমাদের গাইড হল। নাম নোহা। ভারী সুন্দর ঝকঝকে চেহারা ও চটপটে কথাবার্তা। বাস বিমানবন্দর ছেড়ে শহরে ঢুকলো।

বেশ আধুনিক শহর। ফ্লাই ওভার, চওড়া রাস্তা, বড় বড় বাড়ি, খাবারের দোকান দু’পাশে। তবে বড় বড় বাড়িগুলো দেখে ভালো লাগলো না। বেশিরভাগ বাড়ি শুধু চার দেওয়াল এর। আর জানালা দরজা। কোনও বারান্দা, খোলা জায়গা, ব্যালকনি, কিছুই নেই। কেমন যেন বন্ধ বন্ধ ভাব বাড়িগুলোর। আমরা মিশর বলছিলাম দেখে আমাদের ওদেশের গাইড খুব অবাক হলেন। মিশর খুব পুরোনো নাম। ওই নাম এখন কেউ বলে না। আমরা জানি দেখে ও খুব খুশি হল। এখন সবাই জানে ইজিপ্ট। পিরামিড দেখলাম। তারপর হোটেল। আমরা মার্চ মাসে গেলাম। তখন আবহাওয়া বেশ ভালো। এরপর ওখানে খুব গরম। তাই পর্যটকদের যাওয়ার উপযুক্ত নয়।
মরুভূমি ও পিরামিডের দেশ। পিরামিডের ভিতরে ঢুকতে দেয় না এখন। অনেক লুঠতরাজ হয়েছে ভিতরে। কারণ মৃতদেহের সঙ্গে দামি জিনিসপত্র দেওয়ার প্রথা ছিল মিশরে। বাইরে থেকে পিরামিড দেখলাম। বিস্ময়ে। পাথরে বানানো এতবড় বড় সৌধ। কোন প্রযুক্তিতে এমন কাঠামো যুগের পর যুগ অবিকৃত অটুট রয়েছে ভাবলে অবাক লাগে। সন্ধেবেলা একটা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড হয়। পিরামিডের সামনে বসে দেখলাম। পিরামিডের দেওয়ালে আলো ফেলে পুরোনো ইতিহাসকে তুলে ধরা। ভালো লাগলো।

একদিন গেলাম ভ্যালি অফ দ্য ডেড দেখতে। মিশরের রাজা, সম্ভ্রান্ত ও গন্যমান্য লোকেদের কবর স্থান। ধু ধু বালির উঁচু নিচু এক মস্ত নৈশব্দের রাজ্য। বাস থামার পর ব্যাটারি চালিত গাড়িতে গেলাম মমি রাখার সব গুহা দেখতে। তুতানখামেনের মমি যেখানে ছিল। (এখন সেটি কায়রো মিউজিয়ামে)। ভাবতে অবাক লাগে যে, কি অপূর্ব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হত। বালির দেওয়াল দিয়ে কীভাবে ভিতর ঠান্ডা রেখে মমি রাখা হত দেখলাম। দেওয়াল এ নানা রকম ছবি খোদাই করা। জীবনযাত্রার ছবি। দেবদেবীর ছবি। ফারাও দের ছবি। তাদের রাজ্যপাট।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

একটা মজার জিনিস হল যেদিন পিরামিড দেখতে গেলাম সে-দিন দুপুরে কাছেই এক হোটেল এ খেলাম। সেখানে প্লেটে দেখি ছোট এক ভাতের পিরামিড। আমাদের এখানে যেমন বাটিচাপা ভাত দেয় হোটেলে। ওই অঞ্চলের সব হোটেলে ওভাবে ভাত দেয়। কায়রো মিউজিয়ামে দেখলাম এক অপূর্ব কালেকশন। বিশেষত সব মমি। জানলাম মমি একমাত্র খুব সম্পন্ন ঘরের লোকেরই করা যেত, কারণ অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। আবার বড়লোকদের বাড়ির পোষ্যকেও মমি করা রয়েছে দেখলাম। মৃত্যুর পর শবদেহর পেটের নাড়িভুঁড়ি বার করে চল্লিশ দিন ধরে তাতে ভেষজ নানা তেল ও প্রলেপ দিয়ে মালিশ করা হতো। একটি মমির দেখলাম দাঁত ও অবিকৃত। গাইড বললেন, ওরা মধু খেত। চিনি ছিল না তখন। তাই দাঁত অবিকৃত রয়েছে।

মমির মুখের দিকে চেয়ে মনে হল একটু টোকা মারলে ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে যাবে চামড়া। আমরা ছেলেবেলায় ফুলের পাপড়ি বইয়ের মধ্যে রেখে দিতাম। বহুদিন বাদে শুকিয়ে ফিনফিনে হয়ে থাকতো। যেন ফড়িংয়ের ডানা। তেমনি মমির চামড়া। কালো ফিনফিনে। তুতেন খামেনের মমি দেখলাম। আর সোনার গহনা। যেন এক খনি গহনা। ভারী ভারী বিশাল আবক্ষ হার আরও কত কী। মৃতদেহের সঙ্গে, জল, খাবার তাদের প্রিয় জিনিস সব কবরে রাখা হত। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে মৃত্যু কোনও শেষ নয়। জীবনের বহমানতার একটি স্তর। তাই বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সব জিনিসই মৃত মানুষের সঙ্গে থাকতো।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

কায়রো থেকে লাক্সর। ট্রেনে যাওয়া। কি সুন্দর সে ট্রেন। ছোট্ট ছোট্ট কুপ। রেলকর্মী এসে তার মাঝে ম্যাজিশিয়ানের মতো এদিক টানেন তো একটা তাক, ওদিক টানেন তো একটা আলনা এ সব বেরিয়ে আসে। ঘরের আসবাবপত্র তৈরি হয়ে গেল। এমনকি ছোট একটা বেসিন, কল ও বেরোলো। খাবার দাবার যথা সময়ে দিয়ে গেল। সকালে লাক্সর। দর্শনীয় কিছু মূর্তি, ভাঙাচোরা বিরাট বিরাট প্রাসাদ ঘুরলাম। তাদের বিশালত্বে বিস্মিত আমরা।

এরপর নীলনদের ধারে। যাবার পথে লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যেতে সবাই হাত নেড়ে অভিবাদন জানালো। চিৎকার করতে লাগলো ইন্ডিয়ান, ইন্ডিয়ান, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান। মজা লাগলো আমাদের দেশের এদের জনপ্রিয়তা এত সুদূরপ্রসারী দেখে। নীলনদের পথে আমাদের সাথে আরেকজন গাইড যোগ দিলেন। ওদেশের মানুষ। এক মোটাসোটা কালো বলিষ্ঠ আফ্রিকান। ভারী হাসিখুশি। নাম ইসমাইল। পরনে ওখানকার এক পোশাক। আলখাল্লার মতো। জানলাম তাকে বলে জালাবিয়া। খুব মজার মানুষ ইসমাইল ভাই। বাংলা শেখার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন আমাদের সঙ্গে থেকে। মাঝে মাঝে ডাক ছাড়তেন ”মাহিলাও কাচে আসুন। এখ সঙ্গে।”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা

আমাদের গঙ্গার মতোই চওড়া নীলনদ। মস্ত এক তিনতলা জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল। নাম এমভি বাদামিস। পুরো জাহাজটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। জাহাজের ছাতে সুইমিং পুল, ডেক চেয়ার এসব নানা আয়োজন। আমরা এ জাহাজে তিনদিন থাকব। মাঝে মাঝে থেমে পাড়ের দর্শনীয় জায়গা ঘুরে আসব। দু’ পাশের বেশির ভাগ অঞ্চলই ফাঁকা। প্রচুর খেজুর গাছ। মাঝে মাঝে আছে শহর। ঘন বসতি খুব কম। কিছুক্ষণ চলার পর দেখলাম পাশ দিয়ে ছোট নৌকা, খানিকটা শালতির মতো। দু’জন তাতে। একটা মস্ত রশি ছুঁড়ে নৌকোটা আমাদের জাহাজের কোনও একটা খুঁটে বেঁধে নিল। এ বার তারা তাদের জিনিসপত্র দেখাতে লাগলো খুলে।

মজার ব্যাপার হল যে, ক্রেতা দাঁড়িয়ে জাহাজের তিন তলার ছাতে। আর বিক্রেতা টলায়মান নৌকোতে দাঁড়িয়ে পসরা খুলে খুলে টুকরো টুকরো ইংরেজি শব্দে তার গুণমান বলছে। মোটামুটি পছন্দ হয়ে গেলে সেখান থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে জিনিস। অব্যর্থ নিশানা। ছাতে চলে যাচ্ছে জিনিস। আবার টাকাটাও ঠিক ওপর থেকে ছুঁড়ে দেয়া হল। নৌকোতে পরলো। ক্ষুদ্র মানুষ। কত শক্তিমান। কারও কোনও নিশানা ব্যর্থ হল না। এমন বিকিকিনির সাক্ষী হতে পেরে গর্বিত হলাম।

মিশরের নিল নদ আকাশে মিলায়। ছবি: সংগৃহীত।

আরেকটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার ও চোখে দেখলাম। না দেখলে বিশ্বাস হত না। নীলনদে চলার সময় জাহাজ এক স্লুস গেটের কাছে এলো। আমরা ছাতে বসে ছিলাম। দেখি গেটের ওপাশে জাহাজের মাথা সমান জল। কিন্তু এপাশে সে জলের স্তর কত নীচে। ওপারে যাবে কি করে? প্রযুক্তির অপূর্ব এক জাদু দেখলাম। ওপার থেকে আস্তে আস্তে জল ছেড়ে এদিকে জাহাজকে উঁচুতে তোলা হল–যতক্ষণ দু’দিকের জলের লেভেল সমান না হয়। আশ্চর্যের কথা সেই বিকিকিনির ছোট্ট শালতি গুলোর মাঝে অকুতো ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জল সমান হলে গেট খুলে দেয়া হল। জাহাজ আবার তার চলা শুরু করল।

নীলনদের ওপর তিনদিন থাকা যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে অপূর্ব লাগতো রাতে। জাহাজের ছাতে চেয়ারে বসে দেখতাম নদীর নিকষ অন্ধকারে মাঝে মাঝে দু’ পাশের বসতির আলো। জাহাজের আলো জলে ঝিকিয়ে উঠতো। কখনও দূর থেকে দেখতাম কোনও একটা ব্রিজ আসছে। ব্রিজের ওপরের আলোর সারি। অন্ধকারে মনে হচ্ছে আকাশ আর নীচে জলের মাঝে এক খানি আলোর মালা। অপেক্ষা করে আছি তার নিচ দিয়ে জাহাজটা যাবে। অন্ধকারে সে এক অপূর্ব ছবি। নিচে অন্ধকারে জল কালো। আবার মাথার ওপর খোলা আকাশে তারার ঝিকিমিকি। মন গেয়ে উঠতো “মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে”।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content