শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সুরকার নচিকেতা ঘোষ ও মহানায়ক উত্তমকুমার।

 

মুক্তির তারিখ: ২৮/১২/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলা

পরিচালনা: দেবকী কুমার বসু

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: গৌরাঙ্গ

ছবির নাম ‘নবজন্ম’ আর এই ছবিতে উত্তমকুমারের ব্যক্তিগতভাবে নবজন্মই হয়েছিল। আগেই বলেছি যে, ১৯৫৬ সাল এমন একটি বছর উত্তমকুমারের কেরিয়ারে যে একই পরিচালক পরপর দুটি ছবি ওঁকে নিয়ে রূপায়ন করেছেন এবং রিলিজ করেছেন। সেই পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম দেবকী বসু।

সারা ভারতবর্ষের সেই সময়ে উনি চলচ্চিত্র-স্রষ্টাদের মধ্যে প্রণম্য ছিলেন। ওঁর ছবিতে উত্তমকুমারের মতো নায়ক অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটা যতটা উত্তমকুমারের গৌরব ততটাই দেবকীবাবুরও ইতিহাস তৈরির পথে একটি ধাপ। আদতে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করার যতটা নিষ্ঠা উত্তমকুমারের মধ্যে ছিল, তার সবকিছুই প্রথম পর্বেই পূর্ণ হয়েছিল নীতিন বসু, দেবকী বসুদের মতো পরিচালকদের তত্ত্বাবধানে।
সিনেমার অঙ্গনে যখন সত্যজিৎবাবু, মৃণালবাবু, ঋত্বিকবাবুদের মতো রেনেসাঁ বা নবজাগরণের পথিকৃৎদের আবির্ভাব হয়নি ততদিন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অগ্রণী এই নীতিন বসু দেবকি বসু প্রভৃতিদের মতো পরিচালকরা তাদের ছবিতে সুযোগ পাওয়া কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়।

‘নবজন্ম’ নির্মাণ সময় থেকেই দেবকীবাবুর মুখে একটা কথাই বেশি ফুটে উঠত, ‘ছেলেটার নিষ্ঠা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। প্রতিটা ফ্রেম নিয়ে চিন্তা করে’। অর্থাৎ উত্তমকুমার যখন মহানায়ক হবার দিকে এগিয়ে চলেছেন তার অনেক পূর্বে ব্যতিক্রমী প্রস্তুতি তার ভিতর শুরু হয়ে গিয়েছিল। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার বা সমসাময়িক অভিনয়ের রীতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া—এই দুটো রীতির কোনওটাতেই উত্তমকুমারের কার্পণ্য ছিল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

তিনি মহানায়ক হবেন বলে অভিনয় শুরু করেছিলেন তা কিন্তু নয়। যেটা করেছেন সেটাকে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় নিয়ে গেছেন এ ধরনের একটা আত্ম প্রস্তুতি প্রত্যেক বছর নিয়ে নামতেন বলেই তাঁর ছবিগুলো মানুষের মনে দাগ কাটতো।

কিছুদিন আগে বর্ষিয়সী অভিনেত্রী অপর্ণা সেন জানাচ্ছিলেন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে গড়ে তোলা বা সারা পৃথিবীর অভিনয় রীতির বদলের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো একজন কুশীলবের কতখানি থাকলে তৈরি হয় বা নির্মাণ হয় তা উত্তমকুমারকে দেখে শেখা উচিত তার আগে বা পরে কারোর মধ্যে এই জিনিস আর দেখা যায়নি।

উত্তমকুমার।

আসলে তিনি নিজেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন একটা গোটা প্রতিষ্ঠানের‌ কোড অফ কন্ডাক্ট। তাঁকে কেউ বলে দেননি যে, তুমি উত্তমকুমার। তোমাকে ভালো করেই কাজ করতে হবে তিনি তাঁর কাজের দ্বারাই নিজেকে উত্তম প্রমাণ করেছিলেন।

আমরা যে ‘নবজন্ম’ ছবিটার কথা আলোচনা করব তার প্রেক্ষিত গতানুগতিক সুচিত্রা সেনোচিত নয় বরং ভারতবর্ষীয় আদর্শ-ন্যায়-নীতি এ সব কিছুর পরাকাষ্ঠার উপর নির্মিত একটি শালীন ছবি। সেখানে চলচ্চিত্র বোদ্ধা অভিনেতাদের সুযোগ অনেক বেশি এবং যে সময় ‘নবজন্ম’ নির্মিত হচ্ছে সে-সময় এ চরিত্রটি করার জন্য অনেক বেশি যোগ্য অভিনেতা ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। কিন্তু পরিচালকের সন্ধানী চোখে আগামীর কল্পনায় ভেসে উঠেছিল শুধুই উত্তমকুমারের মুখ যিনি, চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একের পর এক সাফল্য দিয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

এ ছবির বিশেষত্ব হল উত্তম কুমার নিজের কণ্ঠে ছয় ছয় খানা গান রেকর্ড করেছিলেন এবং নচিকেতা ঘোষের তত্ত্বাবধানে তা ফিল্মে রাখাও হয়েছে। সমস্ত ইতিহাসের সালতামামিতে জ্বলজ্বল করে একটা কথা ‘উত্তম কুমারের স্বকণ্ঠে গান’, যা তিনি সারা কেরিয়ারে আর কোনওদিন করেননি।

মনে রাখতে হবে বিজ্ঞাপনে এই কয়েকটি লাইনই শুধু হলে মানুষকে টেনে আনেনি। উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলায় টানা হাউসফুল হয়েছিল টোটাল টিম ওয়ার্কের একটা বলিষ্ঠ আউটপুটের দ্বারা। ছবিটির আঙ্গিক নির্মাণ শুধু উত্তম প্রকাশের জন্য নয়, মা আর এক বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পাবো। আসলে একটা ছবি র সমগ্র আত্মপ্রকাশ শুধু একজন নায়কের দ্বারা হয় না, বিপরীতে নায়িকার সহযোগিতা এবং শিল্পীদের পারস্পরিক আদান-প্রদান সবকিছুর উপর নির্ভর করে একটা ছবির সাফল্য।
আমরা ‘নবজন্ম’ ছবিটির যদি কাহিনি আলোচনা করি, সেখানে দেখতে পাবো ভারতীয় গার্হস্থ্য জীবনে প্রকৃত নারী পুরুষের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার একটা রোল মডেল হল এই ছবি। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের অন্তরের দ্বান্দ্বিক উপস্থিতি কোন জাদু বলে কল্যাণ ও সত্যকে লাভ করতে পারে তার দিগদর্শন যেন এ ছবির প্রতিটি ফ্রেম। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ভেতর জটিলতার যে ঐশ্বরিক নিদান তার সমস্ত কিছু পরিশীলতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ছবিতে।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৫: অনন্যসাধারণ হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

সেক্ষেত্রে পরিচালকের মুন্সিয়ানাও কম নয় প্রতিটা অভিনেতা অভিনেত্রীকে কীভাবে কাজে লাগালে প্রত্যেকের ভেতর থেকে সেরাটা বেরিয়ে আসে সেটা পরিচালক দেখিয়ে দিয়েছেন। সংগীত পরিচালক হিসেবে নচিকেতা ঘোষ পরবর্তীকালে যেসব কালজয়ী সংগীত সৃষ্টি করেছেন তার সূচনা লগ্ন ‘নবজন্ম’ ছবি। সেসময়ের ব্লকবাস্টার রবীন চট্টোপাধ্যায় পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এঁদেরকে বাদ দিয়ে নবাগত নচিকেতা ঘোষ ছবির প্রতিটি অংশকে সুচিন্তিত মেধায় সাজিয়ে তুলেছেন যা এক কথায় ছিল অনবদ্য।
সবচেয়ে বড় কথা জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা গান জানতেন আর যখনই শুনেছেন উত্তমকুমার গানকে পছন্দ করেন অন্তরের অন্তস্থল থেকে সে সুযোগটি কাজে লাগাতে বেশি পিছপা হননি পরিচালক সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ তিনি হারমোনিয়াম ধরে উত্তমবাবুকে বসিয়ে দিয়েছেন মাইক্রোফোনের সামনে। যেসময় তাঁর এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দী মানুষকে মোহিত করছে সে সময়ে তাঁর এই উপস্থাপন অনেক বেশি সচেতন শিল্পী হিসাবে তাঁকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে।

সর্বোপরি ঘুরেফিরে একটা কথাই আসে যে বছর ‘সাহেব বিবি গোলাম’, যে বছর ‘চিরকুমার সভা’, যে বছর ‘শিল্পী’-র মতো ছবি মুক্তি পায় সে বছরই সমান দক্ষতায় ‘নবজন্ম’-র মতো ছবিতে নিজেকে প্রকাশ করা ভেতরের এলেম না থাকলে সম্ভব নয়, যা একমাত্র উত্তমকুমারেরই ছিল।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content