শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আগের প্রতিবেদনে ডায়াবিটিস বা মধুমেহ রোগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রোগীরা কীভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করবেন এবং ডায়াবিটিস রোগ কতটা ভয়ংকর জনস্বাস্থ্য ও গণস্বাস্থ্যের নিরিখে তা বলা হয়েছে, এই প্রতিবেদনে ডায়াবিটিস বা মধুমেহ রোগের লক্ষণ, পূর্বরূপ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হবে।

আয়ুর্বেদ মতে, মধুমেহ প্রমেহ নামক একটা রোগের প্রকারভেদ, যেখানে কফজ ১০ প্রকার প্রমেহ যথা —
● উদক মেহ: যা ডায়াবিটিস ইনসিপিডাস রোগের মতো।
● ইক্ষু মেহ: যা অ্যালিমেন্টারি গ্লাইকোসুরিয়ার সমান।
● সান্দ্র মেহ: মোটামুটি ফসপোচুরিয়ার সমতুল্য।
● সান্দ্র প্রসাদ মেহ: যা ওই ফসপোচুরিয়ার মতো লক্ষণান্বিত।
● শুক্ল মেহ: কাইল ইউরিয়ার লক্ষণ যুক্ত।
● শুক্রমেহ: একদমই স্পারমাচুরিয়ার সমান।
● শীত মেহ: মোটামুটি পলিইউরিয়ার সমতুল্য।
● সিকতা মেহ: যা ক্রিস্টাল ইউরিয়ার লক্ষণযুক্ত।
● শনৈ: মেহ: প্রায় পলি ইউরিয়ার সমান লক্ষণ।
● লালা মেহ: যা অ্যালবুমিন ইউরিয়ার সমান লক্ষণ যুক্ত।

এই মূত্রগত সমস্যাগুলি সাধারণত ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাদ্যের অবিপাক বা মেটাবলিক ডিসফাংশন থেকে দেখা যায়। অর্থাৎ বিপাকীয় ক্রিয়ার খামতির জন্য, বিশেষ করে ফ্যাট মেটাবলিজম ঠিকমতো না হওয়ার কারণে কফজ ১০ প্রকার প্রমেহ দেখা যায়, যা ডায়াবিটিস রোগের পূর্ব অবস্থা। ঠিক তেমনই প্রোটিন মেটাবলিজন বা আমিষ জাতীয় খাদ্য যদি ঠিকমতো বিপাচিত না হয়, তাহলে ৬ রকমের মুত্রগত সমস্যা দেখা যায় বা ৬ প্রকার পিত্তজ প্রমেহকে নিয়ে আসে। যেমন—
● ক্ষার মেহ: বা অ্যালকালাইন ইউরিয়া।
● কালমেহ: ব্ল্যাকিস হিমাচুরিয়া.
● নীল মেহ: যা ব্লুইস বা ইন্ডিকো ইউরিয়া।
● লোহিত মেহ: ফ্রাঙ্ক হিমাচুরিয়া।
● হারিদ্র মেহ: বাইল ইউরিয়া
● মাঞ্জিষ্ঠ্য মেহ: হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া।
আবার চার রকমের বাতজ প্রমেহ, যখন শর্করা জাতীয় খাদ্য ও চর্বি কিংবা আমিষ জাতীয় খাদ্যের মত বিপাচিত হতে পারে না এবং তখন যে মেহ প্রকাশ পায়, যেমন—
● বসা মেহ: লিপিড ইউরিয়া।
মজ্জা মেহ: বাইল ইউরিয়া।
হস্তি মেহ: পলি ইউরিয়া ও শেষে মধুমেহ : ডায়াবিটিস ম্যালাইটাস বা গ্লাইকোসুরিয়া।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পাচকাগ্নি বা ডাইজেস্টিভ ফায়ার এবং ধাত্বাগ্নি বা মেটাবলিক ফায়ারের বিকৃতির কারণে বিপাক বা মেটাবলিজম যদি ঠিক মত না হয়, তাহলে ধাতুক্ষয়গত প্রমেহ রোগ উৎপন্ন হয়। এই প্রেমেহ রোগ গুলি যদি উপেক্ষিত হয় বা ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হয় তাহলে মধুমেহ বা অত্যন্ত জটিলতা যুক্ত বাতজ মেহ উপস্থিত হয়।
 

মধুমেহ বা ডায়াবিটিস রোগের নিদান ও সম্প্রাপ্তি

সহজ প্রমেহ বা হেরিডিটারি কারণ, কুলজ বা বংশগত কারণ, অপথ্যনিমিত্তজ কারণ অর্থাৎ বিধি সম্মত আহার বা কাজকর্ম না করা, বেশি বেশি করে খাবার খাওয়া, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য খাওয়া, দই, মাখন, পনির, আইসক্রিম, কোলড্রিংক্স, চর্বিযুক্ত মাংস, শর্করা জাতীয় খাদ্য যেমন—আখের রস, গুড়, পায়েস ইত্যাদি গুরুপাক খাবার, পুকুর বা খাল বিলের জলপান, রসাল জাতীয় খাবার যেমন—শাঁকালু, আলু, ওল, কচু ইত্যাদি খাওয়া, জলজ প্রাণীর মাংস খাওয়া, তেমনি পরিশ্রম না করা, শুয়ে-বসে দিন কাটানো, দুপুরে ঘুম, রাতজাগা, মদ্যপান, পূর্বাহার জীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও খাওয়া ইত্যাদি কারণে প্রধানত কফ দোষ প্রকুপিত হয় এবং পরে ঐ দোষ ছাড়া ও বায়ু তথা পিত্ত কুপিত হয়ে মেদ, মাংস, ক্লেদ, শুক্র, রক্ত, বসা, মজ্জা, লসিকা, রস ও শরীরস্থ ওজঃ বা সপ্তধাতুর সার পদার্থকে দূষিত করে মূত্রবহ ও মেদবহ স্রোতকে আশ্রয় করে বিভিন্নভাবে অবরুদ্ধ বা অতিচালিত করে এবং ধাত্বাগ্নিকে বিশেষভাবে বিকৃত করে, ফলে সম্যক বিপাক ব্যাহত হয় এবং ধাতুক্ষয় কারক মধুমেহ রোগ উৎপন্ন করে। মধুর এক প্রকারভেদের নাম ক্ষৌদ্র তাই, একে ক্ষৌদ্র মেহ-ও বলে। এই রোগে রোগীর রক্ত মধুর মত মিষ্টি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: ডায়াবিটিসের দোরগোড়ায় রয়েছেন? চিন্তা নেই, আয়ুর্বেদে জব্দ হবে এই রোগ

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

 

মধুমেহ বা ডায়াবিটিস রোগের লক্ষণ

বারবার মূত্রত্যাগ বা পলি ইউরিয়া, বারবার খিদে পাওয়া বা পলিফেজিয়া, বেশি বেশি জল পিপাসা পাওয়া বা পলি ডিপসিয়া, আবিল বা ঘোলাটে প্রস্রাব, শরীরের শুষ্কতাবোধ, কোষ্ঠকাঠিন্যতা, শরীরের আড়ষ্টতা, প্রস্রাবে পিঁপড়ে ধরা, মুখে মধুর আস্বাদ, দৌর্বল্য। আলস্য, কাজে অনীহা, কোনও স্থানে ঘা বা ক্ষত শুকোতে না চাওয়া, বারবার নানা ধরনের জীবাণু সংক্রমণ, ওজন কমে যাওয়া, বেশি ঘাম হওয়া, গায়ে চুলকানি , মাথা ঘোরা, পায়ের শিরায় টান বা চিনচিনে বোধ, স্নায়ুর পীড়া, হঠাৎ হঠাৎ রাগ, ক্ষোভ, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি লক্ষণ প্রায়শই দেখা যায়।

রক্ত পরীক্ষায় যদি খালি পেটে রক্তে ১২৫ মিলিগ্রামের বেশি সুগার ধরা পড়ে বা ভরা পেটে রক্তে যদি ১৬০ মিলিগ্রামের বেশি সুগার থাকে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা শুরু করা বাঞ্ছনীয়। তবে সুগার ভরা পেটে ১৮০ মিলিগ্রামের বেশি না পৌঁছনো পর্যন্ত বা খালি পেটে ১৪০ মিলিগ্রামের বেশি না পৌঁছনো পর্যন্ত শুধুমাত্র জীবনশৈলীর পরিবর্তন করা, খাদ্য খাবারের বাছ বিচার করা, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা ইত্যাদির মাধ্যমে সুগারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত। যা এর পূর্বের প্রতিবেদনে যেখানে ডায়াবিটিস রোগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের যে সমস্ত পথ্য ও অপথ্যের কথা বলা হয়েছে, সেগুলি মেনে চললে রক্তে শর্করার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা যাবে।

আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

 

রোগীর চিকিৎসা

সাধারণত দু’ রকমের মধুমেহী দেখা যায়, যেমন স্থূল মধুমেহী অর্থাৎ যারা মোটা এবং মেদবহুল। দুই, কৃশমেহি যারা অত্যন্ত কৃশ বা পাতলা ও দুর্বল। তাই স্থূলকায় মধুমেহীদের ক্ষেত্রে সংশোধন ক্রিয়া অর্থাৎ বায়ো পিউরিফিকেশন করা যায়, যেমন লঙ্ঘন, বমন, বিরেচন ইত্যাদি। আর কৃশ মধুমেহীদের ক্ষেত্রে সন্তর্পণ বা বৃংহনীয় চিকিৎসা করা যায়।

স্থূল মধুমেহী ও কৃশ মধুমেহী উভয়ের ক্ষেত্রেই সংশমন চিকিৎসা বা ওষুধ প্রয়োগ করে সুগারকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হবে। মধুমেহ সাধারণত অসাধ্য রোগা ও বহুল জটিলতাকে নিয়ে আসে, তাই চিকিৎসার প্রথম ধাপই হল, নিদান বর্জন বা যে যে কারণের কথা আগে বলা হয়েছে, সেগুলিকে জীবনশৈলীর পরিবর্তনের মাধ্যমে বাদ দিতে হবে। যেমন: ভোজন রসিকতা, শুয়ে-বসে দিন কাটানো, মিষ্টি খাবার, দুগ্ধ বিকার বা ইক্ষু বিকার সমন্বিত খাদ্য ইত্যাদি বাদ দিতে হবে। অতঃপর ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৯: ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড কোনও ভাবেই শরীরে ঢুকছে না? অজান্তেই এই সব অসুখ ডেকে আনছেন কিন্তু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

 

একক দ্রব্য

যেমন মেথি চূর্ণ, করলা বা উচ্ছের রস, আমলকি চূর্ণ, গুলঞ্চচূর্ণ, হরিদ্রা রস, জামবীজ চূর্ণ, পিপুল চূর্ণ ইত্যাদি বৈদ্যের পরামর্শ অনুযায়ী মাত্রা স্থির করে খেলে সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাধারণত বেশি উপদ্রব না থাকলে এই সমস্ত চূর্ণ বা ঔষধিকে ৩ থেকে ৬ গ্রাম মাত্রায় গরম জল-সহ খাওয়া যায়।
 

পাচন হিসাবে

ফলত্রিকাদি ক্বাথ বা ত্রিফলাদি ক্বাথ ২০ মিলিলিটার করে সকালে সমপরিমাণ হালকা গরম জল- সহ খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

বটি হিসাবে

চন্দ্রপ্রভা বটি, ইন্দু বটি, ত্রিকটু বটি ইত্যাদি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার খাওয়া যায়।
 

রসৌষধি

বসন্ত কুসুমাকর রস, তারকেশ্বর রস, মেহ কেশরী রস ১২৫ থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম হলুদের রস-সহ খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

ঘৃত ঔষধি

যেমন দাড়িম্বাদ্য ঘৃত, ত্রিফলাদি ঘৃত ইত্যাদি ১০ থেকে ২০ গ্রাম আবশ্যকতা অনুযায়ী খাওয়া যেতে পারে।
 

আসব বা আরিষ্ট

যেমন মধ্যাসব, দন্ত্যাসব ২০ থেকে ৪০ মিলি লিটার দিনে একবার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়া যায়।
 

সতর্কতা

যাদের ক্ষেত্রে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধেও ঠিকমতো সুগার নিয়ন্ত্রণে নেই বা ইনসুলিন নিতে যারা অভ্যস্ত, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই বৈদ্যের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যবেক্ষণের মধ্যে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।

হঠাৎ রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার জন্য রোগীর মূর্ছা-সহ নানান উপদ্রব আসে, আবার হঠাৎ সুগার বাড়লেও নানান জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও বৈদ্যের পর্যবেক্ষণে থাকা উচিত।

কোনও রকম শরীরে ক্ষত বা সংক্রমণ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। খালি পায়ে না হাঁটা উচিত। ডায়াবিটিক ফুড আলসার ও পরবর্তীকালে ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিন থেকে বাঁচতে সমস্ত রকম ক্ষতের প্রতি যত্ন নিতে হবে।

রেটিনোপ্যাথি, নেপ্রোপ্যাথি, নিউরোপ্যাথি, কার্ডিয়াক ডিজিজ বা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, লিভারের রোগ ইত্যাদি থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ আবশ্যক।
 

পথ্য

যব, মুগ ডাল, ছোলা, মৌরি, গম, পুরনো মধু, সৈন্ধব লবণ, ছাগলের মাংস রস, করলা, গাজর, শালগম, আমলকি, গুলঞ্চ, হলুদ, গোলমরিচ, ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি ইত্যাদি।
 

অপথ্য

দই, পনির, মাখন, চর্বি জাতীয় খাদ্য, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য, আখের রস ও তার দ্বারা তৈরি খাদ্যদ্রব্য, জলজ পশু-পাখির মাংস, ধূমপান, মদ্যপান, অজীর্ণকর খাদ্য খাবার, পায়েস, গুরুপাক খাবার, দিনে ঘুম, অতি মৈথুন, মল-মূত্রের স্বাভাবিক বেগ চেপে রাখা ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content