হঠাৎ করে কান ব্যথা এবং কানে তেল—কান ব্যথা। খুব সাধারণ একটি উপসর্গ। জীবনে অন্তত একবার কান ব্যথায় ভোগেননি, এমন মানুষ কমই আছেন। অনেক কারণ আছে কান ব্যথার নেপথ্যে। কিছু কারণ যেমন কানে, কিছু আবার নাকে গলায় বা অন্য কোথাও। কানে হঠাৎ ঠান্ডা লাগলে, খোল জমে থাকলে, ফোড়া হলে, ছত্রাকের আক্রমণ হলে, কানে চোট লাগলে, কোনও সংক্রমণ হলে, কিংবা কোনও ‘ফরেন বডি’ দীর্ঘদিন কানে থেকে পচে গেলে—তার থেকেও কান ব্যথা হতে পারে। আবার কানের বাইরে যেমন গলা-নাকে কোনও সংক্রমণ হলে সেই ব্যথার প্রভাব এসে পড়তে পারে কানে। বিশেষ করে জিভে ক্যানসারের অনেক সময় প্রাথমিক উপসর্গ কিন্তু কান ব্যথা।
কানের যে কোনও বিপত্তির মহৌষধ যে কানে তৈল প্রদান, এ ধারণা ছোটবেলা থেকেই মা- ঠাকুমারা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে কানে তালা ধরলে, কটকট করলে, কি তীব্র ব্যথা হলে মায়েরা শিশুদের কানে গরম তেল দেন।
সত্যিই কি তেলের ঔষধি গুণ আছে?
● আমাদের বহিঃকর্ণে অসংখ্য গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি থাকে, যাদের ক্ষরণের ফলে কানের সুড়ঙ্গ পথ সব সময় সামান্য ভেজা থাকে। এই ক্ষরণ নিজেই তৈলাক্ত, ফলে এই তৈলাক্ত ক্ষরণের মধ্যে নানা ধরনের ধুলোবালি সহজেই আটকে যায়। নিয়মিত কান পরিষ্কার না করলেই আটকে থাকা ধুলোবালি, ময়লা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে গিয়ে কানের সুড়ঙ্গটাকেই বন্ধ করে দেয়। ফলে কানে শুনতে অসুবিধা হয়, হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়, কানে পুঁজ হতে পারে, এমনকি কানের পর্দা ক্ষতিও হতে পারে। তাহলে উপায়? উপায় হল, নিয়মিত কান পরিষ্কার রাখা।
কী ভাবে কান পরিষ্কার করবেন?
● এই দুশ্চিন্তা প্রত্যেকটি মায়ের। যদি তার শিশুর কানে খোঁচা লাগে! তাই কান পরিষ্কার না করে মায়েরা কানে বেশি করে তেল দেন। তাদের ধারণা এই তেল কানের ময়লাকে গলিয়ে বার করে দেবে।
আগেই বলেছি কানের নিজস্ব ক্ষরণ তৈলাক্ত, তার ওপর সর্ষের তেল যদি পড়ে তবে এই তৈলাক্ততা আরও বাড়ে, ময়লা আটকাতে সুবিধা হয়। এক কথায় কানে তেল দেওয়ার অর্থ, আরও বেশি করে ময়লা জমতে সাহায্য করা অর্থাৎ শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর। ময়লা কমাতে গিয়ে বাড়ানো। যদি মায়েরা তাদের শিশুদের কান দুটো প্রতি সপ্তাহে একবার করে পরিষ্কার করে দেন, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়। ওষুধের দোকান থেকে কটন বাড কিনে পরিষ্কার করতে পারেন। তবে সেগুলো মোটা হওয়াতে বাচ্চার কানের সুড়ঙ্গে ঢুকতে চায় না। তুলো ভালো করে পাকিয়ে পলতের মতো করে মায়েরা ধীরে ধীরে কানের সুড়ঙ্গের সামনেটা বুলিয়ে নিতে পারেন। তবে ছোট শিশুদের কান বেশি খোঁচাখুঁচি না করাই ভালো। জমে থাকা হালকা ময়লা কানের ক্ষরণের সঙ্গে এমনিই বার হয়ে আসে।
যদি ময়লা জমে শক্ত হয়ে যায়, তাহলে নিজেরা বার করার চেষ্টা কখনওই করা উচিত নয়। কানে খোঁচা লাগবে, পর্দাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো, খোল নরম করার বিভিন্ন ড্রপ যা বাজারে পাওয়া যায়, সেটা কয়েক ফোঁটা করে দিনে তিন-চার বার কানে দিতে হবে তিন-চার দিন ধরে। ময়লা নরম হলে ডাক্তারবাবু পিচকিরিতে (অরাল সিরিঞ্জ) পরিষ্কার জল নিয়ে কান ওয়াশ করে দেবেন। ওয়াশ না করলে শুধু ড্রপ দিয়ে ময়লা নরম করা যেতে পারে, কিন্তু ময়লা সাধারণত নিজে নিজে বার যায় না। তাকে বার করতে হয়।
কানে ব্যথার কারণ
● কানে ব্যথা হতে পারে নানা কারণেই, যেগুলো আগেই বলেছি। এদের প্রত্যেকটির চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। সঠিক কারণ নির্ণয় না করে কানে কখনওই কোনও ড্রপ দেওয়া উচিত নয়, যে ভুলটা আমরা প্রায়ই করে থাকি। ঘরে পড়ে থাকা কোনও পুরনো ড্রপ কানে দিয়ে বসি কিংবা ওষুধের দোকানীর পরামর্শে নতুন ড্রপ কিনে আনি। কানে ব্যথার নেপথ্যে সব থেকে বড় কারণ হল আচমকা কানে ঠান্ডা লাগা। সেজন্য নাকের ড্রপ দিতে হয়, নুন জলে গারগেল করতে হয়, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেতে হয়, প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক। এখানে কানের ড্রপের কোনও ভূমিকা নেই।
গরম তেল কানে দিলে ব্যথা যে সাময়িক কমে, তার কারণ হল, যে কোনও গরম জিনিসের সংস্পর্শে একটা সাময়িক আরামবোধ। এজন্য কানে গরম তেল না দিয়ে কাপড় বা রুমাল ভাঁজ করে হ্যারিকেন, চাটু, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি বা হট প্যাডের সেঁক দিন। বেশি গরম তেলে শিশুর কানের সুড়ঙ্গ বা পর্দা পুড়েও যেতে পারে। সঙ্গে দিন বয়স অনুযায়ী প্যারাসিটামল সিরাপ বা ট্যাবলেট। রাস্তাঘাটে-স্টেশনে এর তার কাছ থেকে কোনও সময় কান পরিষ্কার করাবেন না। এর ফলে কানে নানা ইনফেকশন হয়ে কানের পর্দা চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শেষ কথা হল, আর যেখানেই তেল দিন কানে কক্ষনও নয়।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।