বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আজকাল প্রায়শই শোনা যায় ডায়াবিটিসের কথা। এই ডায়াবেটিস ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে। ভারতকে ডায়াবিটিক ক্যাপিটাল বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এই ডায়াবিটিস আয়ুর্বেদের ‘মধুমেহ’ রোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই যখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ডায়াবিটিসের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছে, তখন এই প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদের মাধ্যমে এই ভয়ংকর রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছে।

২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, সারা পৃথিবীতে ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ মানুষ টাইপ-টু ডায়াবিটিসে ভুগেছেন। সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪৫ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৭৮ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হবেন। অর্থাৎ এই বয়সের মানুষের মধ্যে প্রতি ৮ জনে একজন মানুষ ডায়াবিটিক বা মধুমেহী বলে চিহ্নিত হবেন। ভরতের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে প্রায় ৮ কোটি মানুষের ডায়াবিটিস ছিল। মনে করা হচ্ছে, ২০৪৫ সালে সেই সংখ্যাটি দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটিতে। সুতরাং এই ক্রমবর্ধমান আক্রান্তের সংখ্যা দেখে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীকুল আতঙ্কিত। আরও আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় এই যে, ২০১৯ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গিয়েছে বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এই ডায়াবিটিস (মধুমেহ) এবং তার কম্প্লিকেশান বা উপদ্রব থেকে হয়েছে। এও বলা হয়েছে, যুবা থেকে ৭০ বছর বয়স্ক যত মানুষের মানুষের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগের মৃত্যু ডায়াবিটিস বা তার জটিলতার কারণ থেকেই হয় ।

এহেন মারাত্মক রোগকে পৃথিবী তথা ভারত থেকে দূর করবার উপায় খোঁজা অবসম্ভাবী। এই ডায়াবিটিস সাধারণত দু’ প্রকার। যেমন টাইপ-১ ডাইবেটিস, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় ভীষণই অল্প অথবা একেবারেই ইনসুলিন নামক উৎসেচক তৈরি করে না। একে জুভেনাইল ডায়াবিটিসও বলে। এই সমস্যা সাধারণত শারীরবৃত্তীয় প্রকৃতির আজন্মজাত একটি ‘ইমিউন সিস্টেম’ এর অকার্যকারিতা।
এই প্রতিবেদনে টাইপ-১ ডায়াবিটিস নিয়ে আলোচনায় না গিয়ে বর্তমানে সমস্যা বহুল টাইপ-২ ডায়াবিটিস নিয়ে আলোচনা করব। এই টাইপ-২ ডায়াবিটিস মেলাইটাস রোগের ক্ষেত্রে, হয় রোগীর শরীরে অবস্থিত অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াস যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন নামক উৎসেচক তৈরি করতে পারে না, অথবা যতটা পরিমাণ ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, তাকে শরীর কাজে লাগাতে পারে না। অর্থাৎ ‘ইনসুলিন রেজিস্ট’ করে যায়। ফলে শরীরের গৃহীত খাদ্য থেকে উৎপাদিত সুগার কোষের মধ্যে না গিয়ে রক্তের মধ্যেই থেকে যায়। একে বলা হয় ‘হাইপারগ্লাইসেমিয়া’। অর্থাৎ শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অথচ ওই গ্লুকোজ ভেঙে যদি শরীরের মধ্যে শক্তিতে রূপান্তরিত হতো তাহলে শরীরপুষ্ট ও বলশালী হতো। কিন্তু রক্তের শর্করা বাড়ার কারণে তা প্রবাহিত হয়ে সারা শরীরে ঘুরে বেড়ায়। সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম রক্তবাহী নালী, স্নায়ুতন্ত্র, মূত্রবাহীনালি, বৃক্কের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কোষ (নেফ্রন) ইত্যাদির ক্ষতিসাধন করে।

পরিণতি হিসেবে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বৃক্কগত রোগ, স্নায়ু রোগ, যকৃত রোগ, অস্থি সন্ধিগত রোগ, চোখের রেটিনার রোগ ইত্যাদি নানান ভয়ংকর রোগের সূচনা করে। পরবর্তীকালে মৃত্যু পর্যন্ত ও ঘটিয়ে থাকে। নিউরাইটিস, আর্থারাইটিস, কার্ডিওপ্যাথি, রেটিনোপ্যাথি, হেপাটিক ডিজিস ইত্যাদি অনেক ধরনের রোগকে নিয়ে আসে। যার পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। ডায়াবিটিক ফুড আলসারের মতো উপদ্রবে অঙ্গহানিও ঘটে থাকে।
আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: কৃমির সমস্যায় জেরবার? সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন কী ভাবে? আয়ুর্বেদে রয়েছে প্রতিকার

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

সাধারণত সুস্থ মানুষের ফাস্টিং ব্লাড সুগার অর্থাৎ খালি পেটে রক্তে শর্করার পরিমাণ যদি ৭০ মিলিগ্রাম থেকে ১০০ মিলিগ্রাম প্রতি একশো মিলিলিটার রক্তে থাকে তাহলে সেটাই স্বাভাবিক। সেই রক্তে শর্করার পরিমাণ যদি ১০০ মিলিগ্রাম থেকে ১২৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত দেখা যায়, তবে তারা প্রি-ডায়াবিটিক , যার মানে হল তারা ডায়াবিটিস বা মধুমেহে আক্রান্ত হওয়ার দোরগোড়ায় রয়েছেন। সেই শর্করার পরিমাণ যদি ভরা পেটে মাপা হয় এবং তা ১৪০ মিলিগ্রাম মিলিগ্রামের মধ্যে থাকে তবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু আবার যদি ১৪০ মিলিগ্রাম থেকে ১৮০ মিলিগ্রামের মধ্যে থাকে, তবে বুঝতে হবে রোগী প্রাক ডায়াবিটিস বা মধুমেহ রোগের দোরগোড়ায় অবস্থান করছেন। সুতরাং এই সমস্ত প্রাক ডায়াবিটিক বা প্রাক মধুমেহীদের ক্ষেত্রে জীবনশৈলীর পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা অবশ্যম্ভাবি, নাহলে তারা ভয়াবহ ডায়াবিটিস বা তার জটিলতার শিকার হবেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

 

প্রাক মধুমেহী রোগীদের সম্বন্ধে আয়ুর্বেদ কী বলছে?

প্রমেহ বলে এক রোগের কথা আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে। যেখানে ঘোলাটে প্রস্রাব বারবার ত্যাগ হয়। এই প্রমেহ সাধারণত কুড়ি প্রকার। তার মধ্যে কফজ প্রমেহ ১০ প্রকার। পিত্তজ প্রমেহ ৬ প্রকার। বতজ প্রমেহ ৪ প্রকার। এই ২০ প্রকার প্রমেহর মধ্যে ১৯ প্রকার প্রমেহ রোগীর যদি সঠিক সময় চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে বিংশতিতম যে প্রমেহ সেটাই মধুমেহ। একে ক্ষৌদ্রমেহ ও বলা হয়। সুতরাং কফজ ১০ রকম, পিত্তজ ৬ রকম এবং বাতজ-এর ৪ রকমের ৩টি পর্যন্ত প্রমেহ হল প্রাক মধুমেহ বা প্রাক ডায়াবিটিস, এবং মধুমেহ হল জটিলতায় ভরপুর এক ধরনের বাতজ টাইপের প্রমেহ রোগ, যার কারণ ও লক্ষন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ডায়াবিটিসের সমতুল।

আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

 

কী কী করবেন, কী কী করবেন না?

প্রি-ডায়াবিটিক বা প্রাক মধুমেহি রোগী কী কী করবেন এবং কী কী করবেন না সেটাই এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
 

অপথ্য

দিবানিদ্রা, আলসেমি বা শুয়ে বসে দিন কাটানো, দই বা দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়া (ছানা বাদে), ইক্ষু, বা চিনি বা শর্করা জাতীয় খাদ্য খাওয়া, একসঙ্গে বেশি খাওয়া বা অত্যন্ত পেট পুরে খাওয়া, পুকুর বা খাল বিলের জল পান করা, ওল-কচু বা কন্দ জাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া, গুরুপাক খাবার যেমন পায়েস পিঠে পুলি বেশি খাওয়া, জলেজাত পশু পাখির মাংস খাওয়া, মিষ্টি জাতীয় খাবার, বাসি বা পচা খাবার খাওয়া।মদ্যপান, চর্বী জাতীয় খাদ্য, ভোজন রসিক হয়ে তৃপ্তি করে খাওয়া
 

পথ্য

অল্প অল্প করে খিদে রেখে তিন-চার ঘণ্টা অন্তর খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা, তেতো যেমন করলা বা উচ্ছে, নিম , কষা জিনিস যেমন আমলকি, হলুদ, গুলঞ্চের চূর্ণ, জাম বীজ চূর্ণ, মেথি চূর্ণ, চিরতা ভেজানো জল, কালমেঘ পাতার রস ইত্যাদি খেলে প্রাক ডায়াবিটিস বা প্রাক মধুমেহ রোগীরা জটিলতা যুক্ত মধুমেহ থেকে পরিত্রাণ পাবে।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content