শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সপ্তপর্ণীর ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক গবেষণামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ছাতিম গাছের ব্যবহার বিভিন্ন রকম রোগ নিরাময়ে কার্যকারী ভূমিকা নেয়। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের রচিত ‘চিরঞ্জীবী বনৌষধি’তে বর্ণিত আছে সপ্তপর্ণী অর্থাৎ ছাতিম গাছের উপকারিতার কথা। আধুনিক গবেষণার ক্ষেত্রেও ছাতিম গাছের উপকারিতা অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে। ছাতিম গাছে দুধের মতো তরুক্ষীর বা লাটেক্স উপস্থিত থাকে এবং এই তরুক্ষীরে প্রচুর পরিমাণে নানান ধরনের অ্যালক্যালয়েড থেকে থাকে। এই সকল অ্যালকালয়েড বা উপক্ষার সাধারণত বিষাক্ত হলেও এগুলির নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময় অব্যর্থ ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তাই আদিবাসী লোকোচিকিৎসা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আধুনিক দেশের গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে ছাতিমের বিভিন্ন অংশ স্থান পেয়েছে।

২০১২ সালের একটি জার্নালে [IJRP] প্রকাশিত হয়েছিল যে, ছাতিম গাছের বল্কল নিঃসৃত নির্যাস মানব দেহের পেটের অসুখ, ম্যালেরিয়া, ডিসপেপসিয়া, ত্বকের অসুস্থতা, কার্ডিয়াক সমস্যা, কৃমিরোগ এমনকি দুরারোগ্য ক্যানসার নিরাময়েও কার্যকারী ভূমিকা নেয়। এই গাছের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম উপক্ষার থাকে যা নির্দিষ্ট মাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার করলে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। এই গাছের কাণ্ডে থাকে এচিটামিন ও টিউবোটাইওয়াইন। মূলের ছালে উপস্থিত থাকে অ্যাকুয়ামাইসিন, আর কাণ্ডের বল্কলে থাকে এচিটামিন। ফুলে থাকে পিকরিনিন ও স্ট্রিকটামিন। পাতায় থাকে পিকরালিনাল ইত্যাদি জাতীয় উপক্ষার।
 

এক নজরে

উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস সর্বপ্রথম এই উদ্ভিদের বিজ্ঞানসম্মত নামকরণ করেন। তিনি এর নাম রেখেছিলেন ‘ইহিটিস স্কোলারিস’ (Eehites scholaris)। পরবর্তীকালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী অ্যালাস্টোনের স্মৃতিরক্ষার্থে নামটি পরিবর্তন করে রাখা হয় অ্যালাস্টোনিয়া স্কোলারিস (Alastonia scholaris)।
● বিজ্ঞানসম্মত নাম: অ্যালা স্টোনিয়া স্কোলারিস
● গোত্র: অ্যাপসায়নেসি (Apocynaceae)
● সংস্কৃত নাম: সপ্তপর্ণী
● বাংলা নাম: ছাতিম
● হিন্দি নাম: ছাতিয়ান
● গুজরাটি নাম: সপ্তপর্ণী
● তামিল নাম: পালা
● ইংরেজি নাম: ডেভিল ট্রি (Devil Tree)
● গাছের প্রকৃতি: ছাতিম গাছ বহুবর্ষজীবী, বহু শাখান্বিত, কাষ্ঠল, দ্বিবীজপত্রী, সপুষ্পক উদ্ভিদ। পরিণত গাছ প্রায় ৪০ মিটার (১৩০ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। গাছটির ছাল (Bark) সবুজাভ সাদা রংয়ের খসখসে প্রকৃতির হয়, মাঝে মধ্যে সাদা রংয়ের তিক্ত তরুক্ষীর ক্ষত ছাল থেকে বের হয়। চার থেকে সাতটি করে পাতা একটি পর্বে সাজানো থাকে। শীতের শুরুতে সবুজাভ সাদা রঙের সুন্দর গন্ধযুক্ত ছোট্ট ছোট্ট ফুলগুলি পুষ্পবিন্যাসে সজ্জিত থাকে। পুষ্পবিন্যাস সাইম প্রকৃতির।
● গাছের বিস্তৃতি: ছাতিম গাছের আদি উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ চিন-সহ এশিয়ার দক্ষিণ অংশ। ছাতিম গাছ ভারত-সহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, তাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব দেশই কম বেশি পাওয়া যায়। এটিকে আফ্রিকা উত্তর অস্ট্রেলিয়া এবং এবং চিনের দক্ষিণ অংশে পর্যাপ্ত পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে ছাতিম গাছ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসের বাগানগুলিতেও গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ হিসেবে স্থান দখল করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও এই গাছ খুবই পরিচিত।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রোজের খাদ্যতালিকায় তেঁতুল নেই! এ সব জানলে এমন ভুল আর নয়

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: লিভার ও মস্তিষ্কের অসুস্থতা কি ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়? কীভাবে?

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে ছাতিম গাছে দুধের মতো তরুক্ষীর বর্তমান এবং এই তরক্ষীরে বিভিন্ন প্রকারের উপক্ষার থেকে থাকে যার চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার বহুল। সেই সকল উপক্ষার ছাড়াও ছাতিম গাছে থাকে কুমারিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস, লিউকোঅ্যানথ্রোসায়ানি, ফেনলিক অ্যাসিড, স্টেরয়েড, ট্যানিন, স্যাপোনিনস, শর্করা, অ্যামাইনো অ্যাসিড, কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইডস, তারপিনয়েডস ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১২: ক’দিন ধরে আমি কেমন যেন মাংস পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে

কুষ্ঠরোগীরা ছাতিম গাছের ছাল চূর্ণ এবং গুণঙ্গের রস মিশিয়ে সিদ্ধ করে নিয়মিত খেলে এই রোগ অনেকাংশে নির্মূল হয়।
 

মানসিক অবসাদ দূরীকরণে

সম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, ছাতিম পাতার ইথানলিক নির্যাস মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করে এবং মানসিক অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে ।
 

দাঁতের সমস্যা দূরীকরণে

দাঁতের পোকার যন্ত্রণায় ছাতিম গাছের আঠা ওই পোকা লাগা দাঁতের ফাঁকে লাগালে যন্ত্রণার উপশম হয়। গবেষণায় এও জানা গিয়েছে, ছাতিম পাতার মধ্যস্থ যৌগে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে।
 

ডায়াবেটিস নিরাময়ে

আয়ুর্বেদ মতে, ছাতিম গাছের ছাল সারারাত ভিজিয়ে রাখার পর পরদিন সকালে খালি পেটে তার হাফ কাপ মতো খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেকটাই কমে যায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
 

পেটের অসুখ নিরাময়ে

অত্যাধুনিক গবেষণা বলছে, ছাতিম গাছের মধ্যে থাকা তরুক্ষীরে নানান ধরনের উপক্ষার উপস্থিত থাকে। এই সকল উপক্ষার এবং ফেনলিক পদার্থ, ট্যানিন, স্টেরয়েড জাতীয় পদার্থ আমাশয় সারাতে, ডায়রিয়া দূর করতে, পেটের ব্যথা সারাতে এবং যকৃতকে রক্ষা করতে পারে।
 

আলসার ও ক্যানসার নিরাময়ে

ছাতিম গাছের বিভিন্ন অংশের নির্যাসে অ্যান্টিআলসার (Antialcer), অ্যানালজেসিক (Analagesic) এবং অ্যান্টি ক্যানসারাস (Anticancerous) প্রপার্টি উপস্থিত থাকে। তাই বর্তমান বিশ্বে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের ওষুধ তৈরিতে এই গাছের বিপুল ব্যবহার হচ্ছে।
 

ফ্রি রেডিক্যাল মুক্ত করতে

ছাতিম গাছে ফ্রি রেডিক্যালস স্ক্যাভেনজিং আন্টিঅক্সিডেন্ট (Free radicals scavanging antioxidant) উপস্থিত থাকে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি রেডিক্যাল শরীর থেকে বার করে শরীরের ভেতরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কে রক্ষা করে এবং নানান রোগ ব্যাধি নিরাময় করে।
 

হাঁপানি রোগ সারাতে

হাঁপানি রসুনের ছাতিম গাছের ফুলের চূর্ণ উপকার দেয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় পিপুল চূর্ণ ও দইয়ের সঙ্গে ছাতিম ফুল চূর্ণ মিশিয়ে খেলে হাঁপানিতে উপকার পাওয়া যায়। অ্যাজমা এবং ব্রঙ্কাইটিস নিরাময়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৪: বাড়ির চৌবাচ্চায় মাছ চাষ করে পরিবারের নিত্যদিনের মাছের চাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব

 

পাইথোরিয়া দূর করতে

ছাতিমের আঠা অর্থাৎ তরুক্ষীর ৫ থেকে ১০ ফোঁটা গরম জলে মিশিয়ে একদিন অন্তর অন্তর গার্গেল করলে পাইথোরিয়া রোগ সেরে যায়।
 

ইমিউনোস্টিমুলেন্ট হিসাবে

ছাতিম গাছে উপস্থিত নানান বায়ো-কেমিক্যাল পদার্থ ইমিউনোস্টিমুলেন্ট হিসাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
 

সর্পদংশনের ওষুধ হিসাবে

ছাতিম গাছের ছাল, কাণ্ড ও পাতা সর্পদংশনের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুবিধার্থে এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছাতিম গাছের চাষ শুরু হয়েছে। ছাতিম গাছের বিভিন্ন অংশের নির্যাস অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-অ্যামিবিক, আন্টি-ডায়রিয়াল, অ্যান্টি-প্লাসমোডিয়াল, হেপাটো প্রটেকটিভ, অ্যান্টি-ক্যানসারাস, অ্যান্টি-অ্যাজমাটিক, অ্যান্টি-আলসার, অ্যান্টি-ফার্টিলিটি হিসেবে কাজ করে। তাই মানবজাতির কল্যাণে আমাদের ছাতিম গাছ রোপন করতে হবে এবং এই গাছকে রক্ষা করতে হবে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content