রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: দেবাশীষ দেব।

সারাবছর নাক বন্ধ, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ, নাক দিয়ে জল ঝরা, মাথা ভার, খিটমিটে মেজাজ—এ সব নিয়ে দিব্যি আছেন বিগত যৌবনা সুললিতা দেবী। কেউ এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে লাজুক হেসে ভুরু যুগল নাচিয়ে বলেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আমার আবার একটু সাইনাসের ধাত। আর জানেন তো, সাইনাস কখনও সারে না!’ কিন্তু সত্যিই কি তাই!

কাকে বলে সাইনাস? সাইনাস হল আমাদের করোটি বা খুলির মধ্যে ছোট ছোট গহ্বর বা খুপরি। থাকে নাকের চারপাশে, যে জন্য এদের বলা হয় প্যারানাস্যাল সাইনাস। এরা যেন অনেকটা পাতলা হাড়ের তৈরি বেলুনের মতো। জন্মের সময় প্রায় থাকে না বললেই চলে, কিন্তু শিশু যত বড় হয় এরাও বাড়তে থাকে। যেন কেউ তাদের ফুঁ দিয়ে ফোলাচ্ছে। সাইনাস বাড়ে বলেই শৈশব থেকে কৈশোর অবস্থার মধ্যে বারে বারে পাল্টাতে থাকে মুখের চেহারা। সাইনাসের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেলে ১২-১৪ বছরের মধ্যেই মুখ একটা স্থায়ী চেহারা পেয়ে যায়।

দু’ জন মানুষের সাইনাসের আকার-আয়তন কখনওই একরকম হয় না। যে জন্য ব্যক্তি বিশেষকে সনাক্তকরণ করার জন্য আঙুলের ছাপের মতো করোটির ছাপ বা স্কাল প্রিন্টও কিন্তু ব্যবহার করে থাকেন অনেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।

চারজোড়া সাইনাস আছে আমাদের করোটিতে। চারটি স্তর বা লেভেলে থাকে এরা। একেবারে উপরের তলে আমাদের কপালের মধ্যে থাকে ফ্রন্টাল সাইনাস, দোতলায় এথময়ডাল সাইনাস। একতলায় সফেনয়ড সাইনাস, যা থাকে সফেনয়ড হাড়ের মধ্যে। আর বেসমেন্টে থাকে ম্যাক্সিলারি সাইনাস, যা থাকে গালের হাড়ের বা ম্যাক্সিলার মধ্যে।
সাইনাসগুলোর ভিতরে থাকে মিউকাস মেমব্রেন বা শ্লেষমা পর্দা এবং এই পর্দায় থাকে নানা মিউকাস গ্ল্যান্ড। এদের নিঃসরণ নাক দিয়ে বার হয়ে যায়। ফ্রন্টাল এবং এথময়ডাল সাইনাসের নিঃসরণ হয় নাকের উপরের দিকে নালিকার সাহায্যে। সফেনয়ডাল সাইনাসও নাকের উপরের দিকে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু ম্যাক্সিলারি সাইনাস ন্যাসোল্যাক্রিমাল নালিকার সাহায্যে নিচের দিকে সংযুক্ত থাকে।
 

অনেক কাজে লাগে এই সাইনাস

করোটিকে হালকা করে রাখে, যাতে দেহ সহজেই মোটা মাথা বইতে পারে।
কণ্ঠস্বরে রেজোন্যান্স বা অনুরণন যুক্ত করে স্বরকে মিষ্টি করে।
বাইরের ছোটখাট আঘাত থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করে।
শ্বাসপথের বায়ুকে উষ্ণ এবং আদ্র রাখে অর্থাৎ এয়ার কন্ডিশনিং চেম্বার হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু সাইনাস সব থেকে বড় যে কাজ করে সেটা হল, শ্বাসপথের রোগ জীবাণুকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা।

সাইনাসের ভেতরের নরম আবরণ মিউকাস মেমব্রেনে যেমন অসংখ্য গ্ল্যান্ড আছে, তেমনি আছে অসংখ্য সিলিয়া বা শুঙ্গ। এই শুঙ্গগুলো সব সময় সাইনাসের নিঃসরণ নারীর দিকে আন্দোলিত হয়। ফলে সাইনাসের সমস্ত তরল পদার্থ সেই দিকেই তাড়িত হয়ে নাকে চলে আসে এবং বার হয়ে যায়।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৭: মদ না খেলে ফ্যাটি লিভার হয় না?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

 

সাইনাসে সংক্রমণ কীভাবে হয়?

সাইনাসের মধ্যকার মিউকাস মেমব্রেনের বিভিন্ন গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসরিত কিছুটা তরল সব সময়ই সাইনাসের মধ্যে কিছুটা করে থাকে। রোগ জীবাণু একবার নাক দিয়ে ঢুকে সংযোগনালি বেয়ে সাইনাসে পৌঁছতে পারলে তাদের আর পায় কে! নিশ্চিন্তে, নিরাপদে বংশবৃদ্ধি করার উপযোগী আবহাওয়ায় জামাই আদরে থাকে তারা। সাইনাসে জমে থাকা তরল থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে নেয়, সাইনাসের সিলিয়াগুলোকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে এই জীবাণুগুলো।

এরা নানাভাবেই সাইনাসে ঢুকতে পারে। প্রথমত হয় ঠান্ডা লেগে অর্থাৎ হঠাৎ করে তাপমাত্রার পরিবর্তনে। শীতকালে সাইনাসের সমস্যা বাড়ে। আমরা জানি আমাদের নাক এয়ারকন্ডিশনিং চেম্বার হিসেবে কাজ করে। শীতকালে বাইরের ঠান্ডা বাতাসকে গরম করে শ্বাসপথের ভিতরে পাঠানোর জন্য নাকের বিভিন্ন রক্তনালীতে ধেয়ে আসে উষ্ণ রক্ত, ফুলে যায় নাকের মিউকাস মেমব্রেন, সাইনাসগুলোর সঙ্গে নাকের যেসব সংযোগনালি থাকে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সাইনাসে রোগ জীবাণু আটকে পড়ে দাপাদাপি শুরু করে।

এমনটা কিন্তু ঘটতে পারে অ্যালার্জিতেও। আবার নাকের পার্টিশনের হাড় বাঁকা থাকলেও এটা হতে পারে। হঠাৎ নাক ঝাড়লেও এমন বিপত্তি হয়। কারণ নাকে ঠান্ডা লেগেছে, নাক ভরে আছে জীবাণু ভরা সর্দিতে। জোরে নাক ঝাড়লে নাকের প্রকোষ্ঠে হঠাৎ করে উচ্চ চাপের সৃষ্টি হয় এবং কিছুটা সর্দি যেমন বাইরে বার হয়ে যায়, কিছুটা আবার নেগেটিভ প্রেসারে নালি বেয়ে সাইনাসগুলোতেও ঢুকে পড়ে। এ ভাবেই শুরু হয় সংক্রমণ। সব সাইনাসগুলো যখন একসঙ্গে সংক্রমিত হয় তখন তাকে বলে প্যানসাইনাসাইটিস।

আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৬: হিচককের সাইকো—ম্যারিয়নের স্নান ও নর্মা-র মৃতদেহ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

 

সাইনাসেই মাথাব্যথা বুঝবো কী করে?

মাথাব্যথা তো অনেক কারণেই হতে পারে, কিন্তু কী করে আমরা বুঝবো যে এটা সাইনাসের জন্যই মাথাব্যথা। সাইনাসের মাথা ব্যথার একটা ধরন আছে। অ্যাকিউট বা তীব্র স্টেজে সকাল বেলা সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যথা শুরু হয়, বেলা বাড়ে, মাথার টনটনানিও বাড়ে। কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যথা হঠাৎ করে যেন কমে যায়। আবার ক্রনিক বা মেয়াদি স্টেজে রোগী বিছানা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ব্যথা শুরু হয়, বেলা একটু বাড়লেই ধীরে ধীরে তার কমে আসে। তবে সবার ব্যথাই যে ঠিক এভাবেই শুরু হয় বা শেষ হয় তা কিন্তু নয়। বরং যাদের সারা বছরই নাক বন্ধ থাকে, যখন তখন হাঁচি হয়, দুর্গন্ধযুক্ত সর্দি ঝরে, শরীর জুড়ে ম্যাজম্যাজানি, চোখ জ্বালা- ব্যথা, গলা ভার—এইসব উপসর্গ থাকে, চোখ বুজে আপনি বলে দিতে পারেন, তিনি সাইনাসের সংক্রমণে ভুগছেন।

আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

 

প্রশ্ন হল আপনি তাহলে করবেনটা কী?

দু-চার দিন মাথা ভার বা সর্দি-কাশি হলে কেই বা ডাক্তারের কাছে যায়! বাজার চলতি কোনও নাকের ড্রপ দু’ফোঁটা করে দু’নাকে দিনে দু’বার করে পাঁচ দিন দিতেই পারেন। সঙ্গে দু’বেলা ফুটন্ত জলের ভাপ, ব্যথা কমানোর বড়ি এবং অ্যালার্জির বড়ি খেয়ে দেখতে পারেন। এতে ম্যানেজ হলে ভালো, তা না হলে নিজেরা আর ম্যানেজারি না করে ডাক্তারের কাছে যাবেন। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে এক্স-রে, ন্যাসাল এনডোসকপি, স্ক্যান-সহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মাথা ব্যথার সঠিক কারণ যে সাইনাস সেটা নির্ণয় করবেন, চিকিৎসাও সেভাবেই হবে।

অ্যালার্জির কারণে সাইনাস হলে তার চিকিৎসা পদ্ধতি এবং জটিল সংক্রমণে সাইনাস হলে, তার চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাইনাসে পচা সর্দি থাকলে আজকাল ফাংশনাল এন্ডোসকপিক সাইনাস (FESS) সার্জারি করে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যায়।

সঠিক চিকিৎসায় সাইনাস অবশ্যই সারে। টোটকা টাটকিতে সাময়িক উপশম মিলতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটে না। আর দীর্ঘদিন সাইনাস পুষে রাখলে তার থেকে মস্তিষ্কের অসুখ, চোখের সমস্যা, হাড়ের অসুখ, কানের অসুখ, শ্বাসপথের অসুখ—কি না হতে পারে!

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content