সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সোনার হরিণের মোহময় রূপ ভুলিয়েছিল সীতার মন। তার ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে রাম একাই চললেন গভীর বনে। সঙ্গী তাঁর স্বর্ণভূষিত বিপুলকায় শরাসন, ধনু, তীক্ষ্ণ বাণ। মায়াবী হরিণ ছুটে চলে রূপের ছটায় চারিদিক আলো করে, আবার নিমেষে হারিয়ে যায় গহন বনের কালো অন্ধকারে। রামের গতি বাড়তে থাকে, ক্লান্তিভারে ভারাক্রান্ত হন তিনি। ক্রমশ হরিণ তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে থাকে আশ্রম থেকে বহু দূরে। ক্ষণিকের জন্য বনের শ্যামল ঘাসের কোলে রাম এলিয়ে দেন নিজেকে ক্লান্তি দূর করার বাসনায়।

হঠাৎ দেখতে পেলেন কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সোনার হরিণটি। রামকে দেখে ভয়ে তারও চলার শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। রাম আর অপেক্ষা করলেন না। মুহূর্তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় ধনুর্বাণ প্রস্তুত করলেন তিনি, নিক্ষেপ করলেন অব্যর্থ লক্ষ্যে। সূর্যকিরণের দীপ্ত তেজে যেন গড়া তাঁর নিশিত বাণ। সে বাণ নির্ভুল ভাবে ভেদ করল মৃগরূপধারী মারীচের বক্ষদেশ। বাণবিদ্ধ মারীচ তালগাছের সমান উচ্চতায় লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ল। আহত রাক্ষস রক্তস্নাত অবস্থায় বিশালকায় নিজ মূর্তি ধারণ করল। আর তারপর মৃত্যুবেদনার প্রান্ত মুহূর্তে আর্তনাদ করে উঠল অবিকল রামের কণ্ঠস্বরে “হা লক্ষ্মণ! আমাকে রক্ষা করো!”
মৃত্যুকালে এমন দুর্বুদ্ধি ভর করল মারীচের মনে, সে কি প্রভু রাবণের প্রতি আনুগত্যবোধে? হয়তো সে চেয়েছিল জীবনের অন্তিম সময়ে অন্তত প্রভু রাবণের প্রিয় কাজটুকু সে করে যাবে। হয়তো ভেবেছিল, রামের আর্তকণ্ঠ শুনে উৎকণ্ঠায় আকুল হয়ে সীতা কি লক্ষ্মণকে রামের সন্ধানে যেতে নির্দেশ দেবেন না? অনুজ লক্ষ্মণ কি ছুটে আসবেন না অগ্রজের রক্ষার্থে? তখন সীতা আশ্রমকুটিরে থাকবেন একাকিনী। সেই উপযুক্ত পরিস্থিতিতে রাবণের অভিলাষ পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

রাম মায়াবী হরিণের মৃত্যুকালে স্বমূর্তি ধারণ দেখে বুঝতে পারলেন সমস্ত ঘটনাপরম্পরা। সীতা এবং লক্ষ্মণ দূর থেকে রামের অনুরূপ কণ্ঠে আর্তস্বর শুনে কী দুর্ভাবনা করবেন, সে চিন্তা পীড়িত করল তাঁকে। রাম স্থির করলেন, অন্য আর একটি হরিণ বধ করে সেটি নিয়ে দ্রুত আশ্রমে ফিরবেন তিনি। এ সিদ্ধান্তও কি রাবণের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করল না? আদিকবি আশ্রমের অভিমুখী পথেই ফিরিয়ে দিলেন রামকে। কিন্তু অন্য হরিণ বধের ছলে বিলম্বকালটুকু তুলে দিলেন ভবিতব্যের হাতে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

পাঠক, রাম চলতে থাকুন আরণ্যক পথে, হরিণের সন্ধানে। আমরা বরং তার আগেই ফিরে আসি আশ্রমকুটিরে। সেখানে রয়েছেন জনকনন্দিনী সীতা, রামানুজ লক্ষ্মণ। তাঁরা শুনতে পেয়েছেন মায়াবী রাক্ষস মারীচের কণ্ঠে অবিকল রামের ত্রস্তধ্বনি। সেই কণ্ঠস্বর অত্যন্ত যন্ত্রণাকাতর। সে ধ্বনি শোনার পর থেকে সীতা উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন।

রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য লক্ষ্মণকে আকুল হয়ে অনুরোধ করছেন। সীতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, “সৌমিত্রি, তোমার অগ্রজ বিপদে পড়ে তোমার নাম ধরে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। তিনি নিশ্চয়ই রাক্ষসের হাতে পড়ে বিপদগ্রস্ত। তাঁকে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য।” কিন্তু লক্ষ্মণ সীতার এ কথায় তাঁকে আশ্রমে একা রেখে যেতে চাইলেন না। তিনি বললেন, “আমি জানি, ত্রিলোকের কোনো সুর বা অসুরই আমার অগ্রজকে পরাস্ত করতে সক্ষম নয়। কাজেই আপনি বিষণ্ণ হবেন না।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৭: মদ না খেলে ফ্যাটি লিভার হয় না?

লক্ষ্মণ একথা বলে আশ্রম ছেড়ে গেলেন না। এ অবস্থায় সীতার উদ্বিগ্ন মনে জন্ম নিল বহু প্রশ্ন। লক্ষ্মণের সিদ্ধান্তে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। ভয় আর ক্ষোভের মিশ্র বহিঃপ্রকাশ হল তীব্র দুর্বাক্যে। লক্ষ্মণকে বললেন, “তুমি তো মিত্রবেশী শত্রু তোমার অগ্রজের। এই বিপদকালেও তুমি তাঁকে রক্ষার জন্য ছুটে গেলে না। বরং নিশ্চিন্তে আশ্রমে বসে থাকলে। তাহলে তো তাঁর বিপদই তোমার আকাঙ্ক্ষিত, লক্ষ্মণ! তুমি কি আমাকে পাওয়ার লোভে তাঁর বিনাশ কামনা করছ? আমি কিন্তু রামের অবর্তমানে এক মুহূর্তও জীবন ধারণ করব না, লক্ষ্মণ।” এই জনহীন অরণ্যভূমিতে বিপদের চূড়ান্ত সময়ে লক্ষ্মণের প্রতি সীতার সুদৃঢ় বিশ্বাসের স্তম্ভটি যেন খানখান হয়ে গেল।

লক্ষ্মণ শুনলেন বৈদেহীর কটুবাক্য। তারপর আবার স্থির বিশ্বাসে বললেন, ”দেবী, এমন কথা বলবেন না। আমার অগ্রজ যুদ্ধে অবধ্য। অগ্রজের বাক্য পালন করেই আমি এই জনহীন অরণ্যের মাঝে আশ্রমে আপনাকে রক্ষার জন্য রয়েছি। জনস্থানের রাক্ষসদের সঙ্গে শত্রুতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তারা যে কোনও সময় অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে। এ অবস্থায় আমি আপনাকে বিপদে ফেলে চলে যেতে পারব না। এই মহারণ্যে রাক্ষসরা মোহ সৃষ্টি করার জন্য নানারকম বাক্য উচ্চারণ করে। এ নিয়ে আপনি দুর্ভাবনা করবেন না। আপনার মঙ্গল হোক। আপনার অন্তর দুঃখহীন হোক। যে বিকৃত স্বর শুনে আপনি রামের কণ্ঠস্বর বলে নিশ্চিত হয়েছেন, সেটি রামের কণ্ঠ নয়। তিনি অতি কষ্টকর মুহূর্তেও কখনও এমন ভাবে অন্যের উদ্বেগ সৃষ্টি করে সাহায্য চাইবেন না।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৬: আমার হৃদয় কাঁপে পরিস্থিতির চাপে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২১: আবার কালাদেও?

সীতা লক্ষ্মণের এসব কথায় আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আরক্ত হয়ে উঠল তাঁর দুচোখ। কর্কশ গলায় বললেন, “লক্ষ্মণ, তুমি অনার্য্য, নৃশংস, কুলদূষণকারী, কপট। তুমি আসলে জ্ঞাতিশত্রু। তুমি আমাকে লাভ করার জন্য এরূপ নির্দয় আচরণ করছ। অথবা ভরতের নির্দেশে তুমি রামের সঙ্গে এসেছ। লক্ষ্মণ, আমি বরং আগুনে প্রবেশ করব, তাও রামকে ছাড়া অন্য পুরুষের স্পর্শ কামনা করব না।”

লক্ষ্মণ করজোড়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন সীতাকে। বললেন, “আপনি আমার কাছে দেবতার তুল্য। তাই আপনার এসব কথার উত্তর দিতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন স্বভাব বিচিত্র নয়। তাঁরা ধর্মহীন, চপলস্বভাব। তাঁরা আত্মীয়দের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে। আমি যেভাবে আপনার অন্যায় বাক্য শুনলাম, সমস্ত বনচারীরা তার সাক্ষী। আমি আপনার বাক্য আর সহ্য করতে পারছি না। রাম আমার গুরুজন। আমি তাঁর আজ্ঞা পালনের জন্যই আপনার কাছে ছিলাম। আপনার এই কটুবাক্য শোনার পর আমি রামের সন্ধানেই যাচ্ছি। আপনার মঙ্গল হোক, এই প্রার্থনাই করি। বনদেবতারা আপনাকে রক্ষা করুন। রামের সঙ্গে ফিরে এসে আপনাকে যেন এ ভাবেই দেখতে পাই।”

একথা শুনে সীতা আবার বললেন, “রামকে না পেলে আমি এ শরীর রাখব না লক্ষ্মণ। গোদাবরীর জলে প্রাণ বিসর্জন দেব না হলে তীব্র বিষ পান করব বা দীপ্তশিখা অগ্নিতে প্রবেশ করব।”

লক্ষ্মণ সীতাকে মনে মনে অভিবাদন করে,করজোড়ে প্রণাম জানিয়ে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন রামের উদ্দেশ্যে। ভয়াল অরণ্যের মাঝে, নির্জন আশ্রমকুটিরে একাকিনী সীতা আকুল হৃদয়ে বসে রইলেন রামের প্রতীক্ষায়।
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

আপনার রায়

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?

Skip to content