রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


 

রিভিউ: আদিপুরুষ

পরিচালনা: ওম রাউত

অভিনয়: প্রভাস, কৃতি শ্যানন, সইফ আলি খান, দেবদত্ত নাগে, সানি সিং

ভাষা: হিন্দি, ইংরেজি, তামিল, তেলেগু (থ্রিডি)

রেটিং: ৫/১০

ছবির শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এখানে বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণ কাহিনির পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কারও ভাবাবেগকে আহত করার জন্য নয়। মূল কাহিনি ছিল এক আর্য রাজার (রামচন্দ্র) সঙ্গে অন্য এক অনার্য রাজার (রাবণের) যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণ সেই আর্য রাজার স্ত্রীকে (সীতা) ওই অনার্য রাজার অন্যায় অধিগ্রহণের চেষ্টা এবং ক্রমে সেই স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে অপহরণ এবং বন্দিকরণ। এক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলাটা জরুরি কারণ সীতার সঙ্গে রামের যখন বিবাহ হয় তিনি তখন নিতান্ত বালিকা। তিনি স্বামী ও শাশুড়ি মায়েদের অত্যন্ত পছন্দের ছিলেন। রঘুকুলজ রাঘবের সঙ্গে বিবাহ তাঁর অভিপ্রেত ছিল। তাই রামের সঙ্গে বনবাসও সীতার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল।
সেখানে দিগ্বিজয়ী অনার্য রাজার তাঁকে অপহরণ, হোক তিনি লঙ্কেশ্বর, বেদজ্ঞ, সুশিক্ষিত, শিবভক্ত, বীরপুত্রের পিতা, অন্যায় তো অন্যায়ই। এক প্রত্যাখ্যাতা নারীর (শূর্পণখা) কাতর অনুনয়ে অন্য এক নারীকে সাধুর বেশে অপহরণ। তাই এখানে একজন নারীর অধিকার খর্ব হয়েছিল, যুদ্ধ এখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। শৌর্যে, ছলনায়, দৈবী প্রভাবে লঙ্কেশ্বরের মৃত্যু অনিবার্য ছিল, হয়েছিলও তাই। এই জটিল কাহিনির যুগ যুগ ধরে সরলীকরণ হয়েছে ধর্মকর্ম, দেবতাবাদ, অবতারতত্ত্ব এবং দেশজ সাহিত্যের নিরিখে।
আরও পড়ুন:

শাকুন্তলম্: প্রেমের পরবশ থেকে মাতৃত্বের উত্তরণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২: রথ দেখো কলা বেচো

ছবির ঘটনা শুরু হয়েছে রাম, সীতা, লক্ষণের বনবাস যাত্রা দিয়ে আর শেষ হয়েছে রাবণ বধ করে সীতা-সহ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। এই কাহিনি দেখাতে গিয়ে পরিচালক ওম রাউত আপনি যা করেছেন! আর্য রাজা রামকে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রেখে দিয়েছেন, তাঁকে দিয়ে ধর্ম অধর্মের বাণী শুনিয়েছেন, তাঁর দ্বারা বিপন্ন নারীদের উদ্ধার দেখিয়েছেন, অশুভের উপর শুভর বিজয়ধ্বজা উড়িয়েছেন, মানব সেনার সাহায্যের অপেক্ষা না করে বানর সেনাকে তাঁর সহযোগী দেখিয়েছেন যা মূল রামায়ণ অনুসারী। অনেক রামায়ণজ্ঞ যেমন এসএন ব্যাস মহোদয় তো বলেছেন যে, সেইসময় বানরদের প্রতীক ছিল মর্কট; এরা প্রকৃতপক্ষে বানর জাতীয় ছিল না। তাদের অদ্ভুত চেহারা ও ভাবভঙ্গির কারণে আর্যেরা হয়তো তাদেরকে বানর আখ্যায় অভিহিত করতেন। এই বিশাল বানর সেনা (ছবিতে খানিকটা ‘প্লেনেট অব দ্য এপসে’র মতো দেখায়) নিয়ে লঙ্কা অভিযান, রাক্ষস-খোক্ষস বধ, অদ্ভুত সব অস্ত্রের প্রয়োগ, বড় পর্দা বলে ভিডিও গেমসের থেকে আর একটু বেশি কিছু দেখানো, মধ্যমানের ভিএফএক্সের প্রয়োগ, সঞ্জীবনী বুটির অদ্ভুত প্রয়োগের মতো আরও কিছু অবান্তর দৃশ্য দেখিয়েছেন। তবে স্কন্ধাবার নির্মাণের (সেনা ছাউনি) ক্ষেত্রে নির্মাতারা যথাযথ।
কিন্তু অনার্য রাজা রাবণকে নিয়ে কি করেছেন বলুন তো! তাঁকে তো খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ভারতে আগত গ্রিক রাজারাজরাদের বেশভূষা থেকে পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপ, আমেরিকার বাজার ধরার জন্য যেভাবে দেখিয়েছেন সেগুলো আমরা বুঝেছি, কিন্তু রেঞ্জটা মানতে পারিনি। হোক অনার্য রাজা তবু তো উপমহাদেশের বিদ্বান, মাংসাশী, নারীলোভী রাজপুরুষ ছিলেন; তাঁর এমন আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য প্রকাশ! আমরা এতটাও স্বাবলম্বী হইনি। আজও যে মনে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

এখানে রাবণ রাজার ধপধপ করে হাঁটাচলা, দশমুখ দেখিয়ে দেখিয়ে বিকট মনস্তত্ত্বের প্রয়োগ, কেউ ওপর থেকে কথা বলছে তো কেউ পাশ থেকে, মাঝে মাঝে এসে জানকীকে থ্রেট করা, সোনার লঙ্কার বদলে লোহার লঙ্কা! কালো প্রাসাদ, কালো পোশাক-আশাক আর শুধু লোহালক্করের ঠোকাঠুকি, সন্দেহাতীতভাবে রামায়ণের যুগে লোহার ব্যবহার ছিল তাই বলে এত ঠোকাঠুকি! প্রায় মহিলাবর্জিত প্রাসাদে যে কয়জন মহিলাকে দেখা যায় তাঁদের চালচলন নেটফ্লিক্স খ্যাত ‘রোমান এম্পায়ারে’র মহিলাদের মতো। তবে পিশাচমুখ স্বর্ণরথের বদলে উড়ন্ত পিশাচমুখ পাখির ওপর চেপে এসে জানকী অপহরণের দৃশ্য আকর্ষণীয়। বেশ একটা ক্রাইসিস তৈরি হয় কিন্তু রাবণ বধের দৃশ্যে সেই ক্রাইসিস থেকে ক্লাইম্যাক্স কোনও আনন্দই দর্শক লাভ করবে না। পরপর কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ এরং রাবণের মৃত্যু হয়।
অভিনয়ের দিক থেকে রামরূপী প্রভাস যথাযথ। তাঁর অভিনয়ের সততা দর্শকদের ভালো লাগার কথা, কিন্তু তাঁর অনার্য (বাহুবলী ধরনের) চেহারা, অরুণ গোভিলের সঙ্গে তাঁর তুলনা সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়েছে। সীতার চরিত্রে কৃতি শ্যানন সুন্দর, অশোক বনে একা মুক্তির অপেক্ষা করা, রাবণের থ্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে কথা বলা, ভীষণ যুদ্ধের সময় চোখে মুখে আশঙ্কার ভাব যথাযথ। লক্ষ্মণরূপী সানি সিং এর এখানে বিশেষ কিছু নেই।

বজরঙ্গের (হনুমান) চরিত্রে দেবদত্ত নাগে ভালো, কিন্তু তাঁর সর্বনাশ করে দিয়েছেন ছবির সংলাপ রচয়িতা মনোজ মুন্তাশির। আর রাবণের চরিত্রে সইফ আলি খান পরিচালকমুখী কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

ছবির চিত্রনাট্য দুর্বল। আবহসঙ্গীতে সঞ্চিত এবং অঙ্কিত বলহারা দুর্দান্ত, দর্শকদের মাঝপথে হল থেকে বেরিয়ে না যাওয়ার অন্যতম কারণ তাঁরা। সুরকার অজয়-অতুল এবং সাচেত-পরম্পরা দেশাচার, লোকাচার বুঝে ভালো গান বেঁধেছেন ঠিক কিন্তু অযোধ্যায়, কিষ্কিন্ধায়, লঙ্কায় সঙ্গীতের অনুশীলন ছিল অপ্রতিহত। সকল আয়োজনেই থাকত নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমাবেশ, সেসব আর খেয়াল করেননি কেউ। শুধু রুদ্রবীণা দেখানো হয়েছে রাবণের ক্ষেত্রে।
তাই যে আদিকবির শোক শ্লোকে পরিণত হয়েছিল, যে রামগান স্বয়ং লব-কুশ শুদ্ধ উচ্চারণ সহকারে বীণার সঙ্গে দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত লয়ে গেয়ে স্বয়ং রামচন্দ্রকে আবিষ্ট করেছিলেন, যে কাব্যগান, গাথা বিগত দু’হাজার বছর ধরে বহু মানুষের কীর্তি, মনের আরাম, রুজি রোজগারের মাধ্যম সেই সুললিত সাহিত্যের অবাঞ্ছিত রূপান্তর যে ছবির প্রযোজক, পরিচালককে অন্ধকারে নিয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য।
* চলচ্চিত্র সমালোচনা (Film Review) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content