রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


একজন সস্ত্রীক বিরাগী হয়ে নানা তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করে বেড়ান। পথিমধ্যে যেতে যেতে স্বামী এক স্থানে কয়েকটা হীরা পড়ে আছে দেখতে পান। হীরা দেখে তাঁর মনে হল, এগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে রাখি, না হলে আমার স্ত্রী যদি দেখতে পায় তবে তার লোভ হতে পারে। তাই মনে করে তিনি সেগুলোর উপর মাটি চাপা দিচ্ছেন, এমন সময় তার স্ত্রী তা দেখতে পেয়ে যান। তখন স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কী করছে? স্বামী প্রথমত থতমত খেলেন। স্ত্রী পা দিয়ে ধুলাগুলি সরিয়ে হীরা খণ্ড দেখে বললেন, এখনো হীরা মাটি তফাত বোধ রয়েছে? তবে তুমি কেন বনে এসেছ?

জগতের সর্ব বস্তুতে সমান ভাবে আদরনীয়। ভক্ত মাত্র সর্বপ্রকার ভিন্নতা পরিত্যাগ করেন। সবকিছুই মধ্যেই ভগবানের প্রকাশ দেখে কাউকে ঘৃণা করে না। সকল বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ আমাদের ঈশ্বরের উপর অনুরাগ জন্মাতে দেয় না। একটি নেউল যত বার গর্তে ঢুকতে চেষ্টা করে ততবারই বেরিয়ে পড়ে, কারণ তার লেজে পাথর বাঁধা ছিল। সেই রকম বিষয় বাসনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “জপটপ করে বটে। কিন্তু বাসনা প্রবৃত্তি সব রয়েছে সেই বাসনা ঘোগ (গর্ত) দিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে। ওদেশে মাঠে জল আনে মাঠের চারিদিকে আল দেওয়া থাকে পাছে জল বেরিয়ে যায় বলে। কাদার আল তার মাঝে মাঝে ঘোগ আছে প্রাণপণে তো জল আনছে, কিন্তু ঘোগ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।” ভক্ত ও তার ভক্তির সাধন তাকে ভগবানের স্বরূপ চিনিয়ে দেয়। ভক্তির হিমে ভগবান সাকার রূপ ধারণ করেন। তিন বলেছেন “জল জমলে যেমন বরফ হয় সেই রূপ সাকার মূর্তিতে সচ্চিদানন্দঘন বলে জানবে।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২৩: দ্বেষ ভাব সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করাই প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

ভক্ত দেখেন চিন্ময় নাম চিন্ময় ধাম চিন্ময় শ্যাম। তিনি সমস্ত নাম রূপ ধারণ করে সর্বত্র প্রকাশিত। পরমহংসদেব গল্পের মধ্য দিয়ে বলছেন, “সকলকে ভালোবাসতে হয়। কেউ পর নয়। সর্বভূতে সেই হরিই আছেন। তিনি ছাড়া কিছুই নাই।” প্রহ্লাদকে ঠাকুরের কথায়, তুমি কিছু বর লও। প্রহ্লাদ বললেন, আপনার দর্শন পেয়েছি আমার আর কিছু দরকার নাই। ঠাকুর ছাড়লেন না। তখন প্রহ্লাদ বললেন, যদি বর দেবে তবে এই বর দাও আমায় যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের যেন অপরাধ না হয়।”

ভক্ত শ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ সব প্রকাশের মধ্যে হরিকেই দেখেন। তার মানে এই যে হরি এক রূপে কষ্ট দিলেন, আর সেই হরিই এখন তার সামনে উপস্থিত হয়ে বর দান দিচ্ছেন। আর সেই লোকদের কষ্ট দিলে হরিকেই কষ্ট দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

শ্রীশ্রী মায়ের একটি ঘটনা বলি। একবার তিনি বাগবাজার থেকে জয়রামবাটির উদ্দেশ্য বেরোবেন। এমন সময় এক ছোট্ট মেয়ে বায়না করছে সেও যাবে। কিন্তু তাকে তো নিয়ে যাওয়া যায় না। সে মাকে খুব ভালবাসে। তাই ছেড়ে থাকবে না। শ্রীমা বললেন, আমাকে যে ভালোবাস তার প্রমাণ কী? সে বলল কী প্রমাণ দিতে হবে? সকলকে সমান ভালোবাসলে তাকেই ভালোবাসা হবে।

সকলের উপর সমান ভালোবাসা হয় কী করে জানো? যাকে ভালোবাসবে তার কাছে প্রতিদানে কিছু চাইবে না। তবেই সকলের উপর সমান ভালোবাসা হয়। শ্রীশ্রী মায়ের নিকট সকলে আপন, নিজের ছিলেন। এই সমত্যের চাবিকাঠি হল, প্রত্যাশা না করা। অভিন্ন আসে যখন জগতের সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের প্রকাশ দেখে। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রী মা জগতকে ঈশ্বরের প্রকাশ রূপে সত্য সত্যই দেখতে পেতেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১: রস নাই?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

শ্রীমার সেই উক্তি, “যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখ না। দোষ দেখবে নিজের। জগতকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা জগৎ তোমার।” এই সমত্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ। ঈশ্বরের প্রকাশ দেখে আপনার বোধ। তিনি যে আপন হতেও আপনার।

স্বামীজীর এক জায়গায় বলেছেন, “প্রত্যেক ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে ঈশ্বর বলে চিন্তা করা দরকার এবং তার সঙ্গে তেমন ভাবে ব্যবহারও করা উচিত। কাউকে ঘৃণা করা বা কোনওভাবে কারও নিন্দা বা অনিষ্ট করা উচিত নয়। আর এ যে শুধু সন্ন্যাসীর কর্তব্য তা নয়, সব নর-নারীরই কর্তব্য।”

ভক্ত বা জ্ঞানী, যিনি ঈশ্বরের উপর অনুরাগ প্রকাশ করে থাকেন, তিনি অন্য কিছু দেখেন না। সর্ব বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সমান ভাবে আপন বোধে গ্রহণ বা বর্জন কিছুই করেন না।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content