শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের একটি বাণী দিয়ে আজ শুরু করব—‘‘যে কোনও রকম মায়া ব্যতীত যদি কেউ কর্ম করে যায়, তার ফল যদি ভগবানের পায়ে সমর্পিত হয় তবে কোনও পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না; যেমন পদ্ম পাতায় জল তাকে স্পর্শ করতে পারে না”। পদ্মকে এই পার্থিব জগতের সমস্ত পঙ্কিলতা কাটিয়ে আত্মার উত্তরণ এবং মুক্তির পথিক হিসেবে গণ্য করা হয়। হিন্দু এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে তাই পদ্ম ফুল অতি পবিত্র। সকলের জানা যে, পদ্ম হল সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আসন অর্থাৎ পদ্মবৃন্তকে এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে নাভিরজ্জু হিসাবে ভাবা হয়। কারণটা একটু বিস্তারিত বলতেই হয়। পদ্ম বা পুন্ডরিকা হল জীবনী শক্তির উৎস। আর সেই জন্যই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বেই সহস্র দল স্বর্ণপদ্ম প্রস্ফুটিত হয়েছিল স্বর্গ সরবরে। পদ্ম প্রস্ফুটনের সঙ্গেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জন্ম হয় যিনি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির অধিষ্ঠাতা। এক্ষেত্রে জল হল নারী এবং স্বর্গীয় পদ্ম হল মাতৃজঠর, যেই জঠরই ব্রহ্মার উৎপত্তিস্থল।

নারায়ণের বক্ষ বিলাসিনী দেবী লক্ষীর আসন যেমন এই পদ্মফুল তেমনই পদ্মেরই বিভিন্ন প্রতিশব্দে ভেসে ওঠে বিষ্ণুপত্নীর বর্ণনা। ঋকবেদে পদ্মদেবী শ্রী বা লক্ষ্মীকে ‘পদ্মসম্ভব’, পদস্থিতা, পদ্মবর্ণা, পদ্মাক্ষী, পুষ্করিণী, পদ্ম মালিনী, মাধবী, হিরন্ময়ী, কমলা, কমলাসনা ইত্যাদি নামে পরিচিত।

বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষে দেবী পদ্মাকে মাতৃরূপে পুজো করা হতো। কিন্তু এদেশে আর্যদের অনুপ্রবেশের পর থেকে দেবতার আধিপত্যে দেবী পদ্মাকে দেখা যায় সেবিকা হিসাবে যিনি ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর পদসেবা করছেন। তবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আজও দেবী পদ্মা ভগবান বিষ্ণুর মতোই দৈবশক্তি সম্পন্ন।
ভাগবত পুরাণে পদ্মফুলকে নিয়ে একটি খুবই আকর্ষণীয় কাহিনি বর্ণনা রয়েছে। আজ এই কাহিনির সংক্ষিপ্ত রূপ পাঠকদের শোনাব। দুর্বাশা মুনির শাপে একবার দেব লোকের সমস্ত দেবতা দরিদ্র অর্থাৎ হতশ্রী, হৃত যৌবন হয়ে পড়লেন। দেবরাজ ইন্দ্র তার সিংহাসন হারিয়ে স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হলেন এবং দেবী লক্ষ্মী স্বর্গ ত্যাগ করে বৈকণ্ঠে এসে বিষ্ণুপত্নী মহালক্ষীর আঁধারে বিলীন হয়ে গেলেন। কিন্তু এমন দুর্দশায়, দেবলোকের সব দেবতারা সত্যলোকে গমন করলেন এবং যৌবন, ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্য ফিরে পাওয়ার অনুরোধ রাখলেন। এই সত্যলোক হল ব্রহ্মার রাজধানী।

কিন্তু নিরুপায় ব্রহ্মা জানালেন, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে তার আর কিছুই করার নেই। অগত্যা সকল দেবতা বৈকুণ্ঠধাম গমন করলেন। পালনকর্তা বৃষ্ণুর নির্দেশে তখন দেবী লক্ষ্মী ক্ষীরসাগরে লিন হয়ে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। ভগবান বিষ্ণুর কথা মতো দেবতারা ক্ষীরসাগর মন্থন করতে শুরু করলেন। তখন হঠাৎই দেবী মহালক্ষ্মী পদ্ম আসনে বসে এক হাতে পদ্ম নিয়ে মন্থনরত ক্ষীরসাগর থেকে উঠে দেবতাদের আশীর্বাদ করলেন। দেবীর আশীর্বাদে দেবতারা আবার হৃত যৌবন এবং ধন-সম্পত্তি ফিরে পেলেন। তারপর দেবী কমলা পদ্মমালা পরিয়ে ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে আবার একাত্ম হলেন।

শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন পুজোতে পদ্মের ব্যবহার অনেকেরই জানা কিন্তু জানেন কি পদ্মকে পবিত্র রূপে ভেবে ভগবান বিষ্ণু প্রতিদিন সহস্র পত্র দিয়ে শিব সাধনা অর্থাৎ শিব পুজো করতেন। একদিন তিনি যখন দেখলেন সহস্র পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম কম তখন ভগবান বিষ্ণু নিজের চোখকে পদ্মসম তুলনা করে নিজ চক্ষু দেবাদিদেবকে সম্প্রদান করলেন। তাই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে পদ্ম ফুলের গাছকে পবিত্র উদ্ভিদ তথা ধর্মীয় উদ্ভিদ হিসাবে স্থান দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় তুলসী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: নিলামবিয়াম নীলাম্বো
● বাংলা নাম: পদ্ম
● ইংরেজি নাম: লোটাস
● সংস্কৃত নাম: পুন্ডরিকা
● গোত্র: নিমফ্রিয়েসি (Nymphaeaceae).
● গাছের প্রকৃতি: পদ্ম গাছ হল জলজ, গুপ্তবীজী এবং দ্বিবীজপত্রী জাতীয় উদ্ভিদ। পাতা গোলাকার বড় ভাসমান লম্বা এবং পত্রবৃন্ত উপস্থিত। পদ্ম ফুল সাধারণত সাদা বা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। প্রকৃতিগতভাবে এই গা জলজ উদ্ভিদ কিন্তু সূর্যের তেজে ফুল প্রস্ফুটিত হয় এবং ফুলের উজ্জ্বলতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
● গাছের বিস্তৃতি: পদ্ম গাছ পৃথিবীর সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চলে অর্থাৎ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তর এবং মধ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই গাছ উপস্থিত। গোলাপি ফুলের পদ্ম গাছের চারটি জেনেরার অন্তর্গত সাতটি প্রজাতি ভারতে চাষ করা হয়।

আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

পদ্ম পাতা, পদ্মমৃণাল এবং পদ্ম ফুলে উপস্থিত বিভিন্ন অ্যালকালয়েডগুলো হল নিলামবাইন, নিউফরাইন, নুসিফেরিন, নুসিফেরিন, অ্যানোনাইন, নেরাটিন, হাইফেরোসাইড, কোয়ারসেটিন, আইসোস্কোয়ারসেটিন, গ্লুকোনিউটিওলিন, নিউটিওলিন। আবার পদ্ম বীজের মধ্যে উপস্থিত থাকে বিটা সিটস্টেরল, পামেটিক অ্যাসিড, গ্লুকোজ ইত্যাদি। আবার পদ্মের রাইজোমের মধ্যে উপস্থিত থাকে গ্লুকোজ, ট্যানিন, রেসিন, ফ্যাট, আলকালয়েড, রেফিনোস, নীলাম্বি ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে পদ্মের ব্যবহার

 

চর্মরোগ নিরাময়ে

পদ্ম মূলের গুঁড়ো অথবা পেস্ট দাঁত ভাজা চুলকানি বা অন্যান্য চর্ম রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়। কচি পাতা বাটা রস গায়ে লাগালে গা জ্বালা জ্বালা ভাব দূর করে। কুষ্ঠ রোগের ক্ষেত্রেও জ্বালা ভাব খানিকটা দূর করে।
 

অর্শ নিরাময়ে

কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অর্শে রক্ত পড়ার সমস্যা থাকলে পদ্মকে সব চূর্ণ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে এই রোগের অনেকটা উপশম হয়।
 

গর্ভপাত রোধে

নারীদের অনেক সময় অকালে গর্ভপাত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তারা তিন থেকে চারটি পদ্মবীজের শাঁস বেটে শরবত করে দুই থেকে তিন দিন অন্তর খেলে এটি অনেকটা নিরাময় হয়। মেয়েদের নাড়ি সরে যাওয়া রোগের ক্ষেত্রেও এটি উপকারী।
 

গলার সমস্যায়

যাদের মাঝে মধ্যে গলা শুরশুর করে, কাশি হয় এবং হঠাৎ করে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে তাদের ক্ষেত্রে পদ্মকেশর চূর্ণের সঙ্গে মধু মেশালে যে পাচন তৈরি হয় তা খুবই উপকারী। অনেকে এই পাঁচনের সঙ্গে বাসক পাতার রস মিশিয়েও সেবন করেন।
 

বহুমূত্র নিরাময়

চরক শাস্ত্রমতে পদ্ম ফুলের ক্বাথ খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। পদ্মের গন্ধমূল তিল তেলে ভেজে খেলে মুত্ররোধ নিবৃত্তি হয়।
 

বমিভাব দূরীকরণে

অনেকের ক্ষুধা মান্দো বা বমি বমি ভাব থাকলে পদ্ম ফুলের বীজ হালকা রোস্ট করে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
 

টনিক তৈরিতে

বর্তমানে পদ্ম ফুলের বিভিন্ন অংশ থেকে কার্ডিয়াক টনিক প্রস্তুত করা হয়।
 

পেটের অসুখ নিরাময়ে

কলেরা, ডায়ারিয়া এবং অন্যান্য পেটের সমস্যার ওষুধ তৈরিতে পদ্মের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়। যকৃত অর্থাৎ লিভারজনিত সমস্যার ক্ষেত্রেও পদ্মফুল কার্যকারী ভূমিকা নেয়।
 

স্ত্রীরোগ নিরাময়ে

চরকের শাস্ত্রমতে পদ্ম ফুলের বিভিন্ন অংশ জরায়ু ঘটিত রোগ, মেনোরাজিয়া, অনিয়মিত রক্তস্রাব, শ্বেতস্রাব রোধে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। কোনও কারণবশত অথবা প্রসবের পরে জরায়ু সরে গেলে পদ্মের কচি পাতা চিনি দিয়ে খেতে দেওয়ার রীতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content