শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

গভীর অরণ্যে ফুরোয় না পথ। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা চলেছেন দুর্গম পথের বাধা বিপত্তি পার হয়ে সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে। সঙ্গে চলেছেন রামের শরণাগত মুনিরা। রাম তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, রাক্ষসদের পর্যুদস্ত করে মুনিদের প্রাণরক্ষা করার চেষ্টা তিনি অবশ্যই করবেন। আর তাতেই সার্থক হবে তাঁর অরণ্যবাস। চলতে চলতে তাঁরা ক্রমে এসে পড়লেন প্রবল উচ্ছ্বাসে বয়ে চলা মন্দাকিনী নদীর তীরে। নদীর ওপারে পর্বতপ্রদেশ। সেখানে এক গভীর কাননভূমি। দূর থেকে যেন মনে হচ্ছে, গাঢ় নীল তার গায়ের রঙ। কত বিচিত্র গাছপালায়, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ সেই কানন, তার ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রম। সেখানে পৌঁছলেন তাঁরা।
তপোবৃদ্ধ জটাধারী মহাতেজস্বী সুতীক্ষ্ণ মুনি বসে আছেন ধ্যানে। রাম এসে করজোড়ে প্রণাম করলেন। মুনিবর সস্নেহে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে—“রাম, তোমার আগমন শুভ হোক। এ আশ্রম ধন্য হল তোমার উপস্থিতিতে। তুমি রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে চিত্রকূটে এসেছ, সে কথা আমি শুনেছি। তুমি এখানে আসবে এ আমি জানতাম। তোমারই অপেক্ষায় এই জরাজীর্ণ শরীরটাকে ছেড়ে চলে যাইনি। দেবরাজ ইন্দ্র এসেছিলেন স্বর্গলোকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। আমি তপস্যার শক্তিতে অনেক লোক জয় করেছি। এখন তুমি সীতা আর লক্ষ্মণকে নিয়ে আমার তপোবলে অর্জিত সেই সমস্ত লোকে আনন্দে বাস কর। তাহলে আমার ভারি তৃপ্তি হবে।” এ তো শরভঙ্গ মুনির মতো একই অনুরোধ করলেন মুনিবর।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪১: চরৈবেতি—গভীর বনপথে জীবন বহমান

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৯: দ্রৌপদীর জন্য স্বর্গীয় ফুলের খোঁজে ভীমসেন কোনও পথে পাড়ি দিলেন!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

রামও আগের মতোই মুনির অনুরোধের উত্তরে বললেন, “মুনিবর, আমি নিজেই এসব লোক জগত অর্জন করব। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিন।” রামের কথা শুনে তৃপ্ত হলেন মুনি। বললেন, “তুমি আমার আশ্রমেই থাকো। এখানে অজস্র ফলফুলের গাছপালা রয়েছে। সুস্বাদু ফল, সুপেয় জল সবই সহজলভ্য এখানে। খাদ্যের অভাব হবে না কখনও। আশ্রমের মধ্যেই আছে অনেকগুলি পদ্মসরোবর। তাদের জলে তীরবর্তী বনের গাঢ় ছায়া পড়ে। এই ছায়ানিবিড় তপোবনে দল বেঁধে হরিণেরা চরে বেড়ায়। কারও ক্ষতি করে না তারা। অনেক তপস্বীর বাস এই তপোভূমি। তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩০: সত্যজিৎ ও সুচিত্রা জুটির সেই ছবি তৈরি হলে তা মাইলস্টোন হয়ে উঠতে পারতো

কিন্তু এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন না রাম। মুনিকে খুলে বললেন মনের কথা—“যদি ধনুর্বাণে হরিণ শিকার করি, তাহলে তা আশ্রমে হিংসা সৃষ্টি করবে। আপনি দুঃখ পাবেন, মুনিবর। কাজেই এ আশ্রমে বেশিদিন আমরা বাস করতে পারব না।”

তিনজন নির্বিঘ্নে রাত কাটালেন সুতীক্ষ্ণের আশ্রমে। পরদিন ভোরবেলা সরোবরের স্নিগ্ধ শীতল জলে স্নান সেরে নিলেন তাঁরা। জলে পদ্মের গন্ধ ম-ম করছে। তারপর নিয়ম মেনে অগ্নি উপাসনা করে এলেন সুতীক্ষ্ণ মুনির কাছে বিদায় নিতে। রৌদ্রের খরতাপ দগ্ধ করার আগেই পথে বেরিয়ে পড়তে চান তাঁরা। এবার তাঁদের গন্তব্য দণ্ডকারণ্যের অন্য সব আশ্রমে। কত পুণ্যবান মুনিঋষিরা নিভৃত এইসব আশ্রমে একান্তে তপঃসাধনা করছেন। তাঁদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করার বাসনা রামের। সে মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে আবার বনের পথ ধরলেন তাঁরা। মুনি প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করলেন—“অরিষ্টং গচ্ছ পন্থানং-নির্বিঘ্নে যাত্রা করো পথে। এই বিচিত্র শোভাময় গভীর অরণ্য, কত ফলফুলের গাছ, পশুপাখি, তার মধ্যে মুনিদের নিভৃত তপোবন, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা, নদী—এ সব মিলে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। তোমরা সব দেখো, মুনিদের আশ্রমগুলিতে যাও, তারপর আবার ফিরে এসো আমাদের কাছে।”
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: দ্রুত রোগা হতে চান? ভরসা রাখুন সুপারফুড ডালিয়াতে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

পথে চলতে চলতে রামকে মনের কথা খুলে বললেন সীতা। তিনি জনকরাজনন্দিনী, বুদ্ধিমতী, বিদুষী। রাজ্যভ্রষ্ট পতির সঙ্গে একই দুঃখ সমান ভাগ করে নিতে তিনি মুহুর্তমাত্র দ্বিধা করেননি। এক লহমায় নিজেও বিসর্জন দিয়েছেন রাজসুখ। কিন্তু ছায়ার মতো পতির অনুগতা হয়েও নিজের বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দেননি তিনি। শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে রামের শরণাপন্ন মুনিদের রাম আশ্বাস দিয়েছিলেন রাক্ষসদের দমন করে রক্ষা করবেন তাঁদের। সীতার মনে আশঙ্কা জেগেছিল, রামের এই আশ্বাস অকারণ নিষ্ঠুরতার জন্ম দেবে না তো? আজ পথ চলতে চলতে কথায় কথায় সে ভাবনাই ভাগ করে নিতে চাইলেন তিনি। দিনের আলোর মতো মেলে ধরলেন নিজের মনের আড়ালে রাখা কথাটি, বড় দামি সে কথা। —চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content