রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


সেদিন ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মহাকাশ অভিযান সেরে পৃথিবীতে ফিরছিল কলম্বিয়া স্পেশ শাটলটি। পৃথিবীতে ফেরার জন্য নাসার এন্ট্রি ফ্লাইট ডিরেক্টর লেরন কেউন চূড়ান্ত সবুজ সংকেত দেন। পৃথিবী ছুঁতে তখন আর ষোলো মিনিট বাকি, চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় মহাকাশযান কলম্বিয়া। সেই যাত্রায় ভারতের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা ছিলেন প্রধান অফিসার। সর্বমোট সাতজন মহাকাশচারী সেদিন কলম্বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। কারও আর ঘরে ফেরা হয়নি।
ছোট থেকেই কল্পনা এরোপ্লেন ও তার উড়ান সংক্রান্ত খুঁটিনাটি নিয়ে খুব কৌতুহলী ছিলেন। এই সব বিষয় তাঁর এত প্রিয় ছিল যে, তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে নিকটবর্তী উড়ান ক্লাবে যেতেন পর্যবেক্ষণের জন্য। ১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ হরিয়ানার কারনাল শহরে তাঁর জন্ম হয়। টেগোর বালনিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে স্কুলশিক্ষা শেষ করেন। ১৯৮২ সালে চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারং কলেজ থেকে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন।
এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন ১৯৮৪ সালে। ঠিক দুবছরের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো অ্যাট বোল্ডের থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন।
আরও পড়ুন:

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

শুধু মহাকাশ বিজ্ঞান নয়, বিভিন্ন রকমের বই পড়তে ভালোবাসতেন কল্পনা। বিমান প্রশিক্ষক ছাড়াও বাণিজ্যিক বিমান চালানোর লাইসেন্সও তাঁর ছিল। তিনি এক বা একাধিক ইঞ্জিন চালিত বিমান, জলে অবতরণ করতে পারে এমন বিমান এবং গ্লাইডার চালাতে পারতেন। ১৯৮৮ সালে নাসাতে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। সেখানে প্রথমে কম্পিউটেশনাল ফ্লুয়েড ডাইনামিক্সের (CFD) ওপর গবেষণা শুরু করেন। তিনি ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে নাসা মহাকাশচারী কর্পস দলে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে ১৯৯৭ সালে প্রথম মহাকাশ ফ্লাইটের জন্য নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি মহাকাশে ৩৭২ ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন।
২০০০ সালে তাঁকে আবার মহাকাশে যাওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়। যদিও অভিযানটি বেশ কিছু বছর পর ২০০৩ সালে শুরু হয়। প্রথমবার মহাকাশে পৌঁছনোর পর ‘কলম্বিয়া’র প্রত্যেক সদস্য এবং কল্পনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল। তিনি বলেছিলেন, “কল্পনা আমরা আপনার জন্য গর্বিত। আমরা প্রত্যেকে আপনার মতো মানুষের জন্য, আপনার কাজের জন্য গর্বিত। বিশেষত ভারতের যুবসমাজ ও মহিলারা আপনার মহাকাশসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের জন্য অত্যন্ত গর্বিত। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা সকলের জন্য।” পৃথিবীতে পৌঁছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ভারতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কল্পনা।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

ইংলিশ টিংলিশ : APOSTROPHE-এর সঠিক ব্যবহার, Happy Teacher’s Day, নাকি Happy Teachers’ Day?

পরে নাসা সূত্রে জানা গিয়েছিল, মহাকাশযানটি পৃথিবীতে প্রবেশের সময় কোনও ত্রুটিই ধরা পড়েনি। শুধু হাইড্রোলিক তরল তাপমাত্রা অফ-স্কেল কম ছিল। বাকি সব হাইড্রোলিক সিস্টেম ভালোই ছিল। হঠাৎ মহাকাশযানের বাম দিকের টায়ারের চাপ কমে যায়। সেই সঙ্গে বিকল হতে শুরু করে প্রতিটি সেন্সর। এরপরেই মহাকাশযানটির সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। হিউস্টন রাডার ব্যবহার করেও আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।

টেগোর বালনিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে কল্পনা (মাঝখানে)।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল নাসার ওপর। ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জারের পর এটি ছিল আমেরিকার দ্বিতীয় স্পেস শাটল দুর্ঘটনা। এই ঘটনার পর প্রায় দু’ বছর বন্ধ রাখতে হয়েছিল মহাকাশ অভিযান। তদন্তে উঠে আসে মহাকাশযানটির একটি ডানা ভেঙে গিয়েছিল। শব্দের ১৮ গুণ বেশি গতিতে চলছিল কলম্বিয়া। মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ ও যাত্রীদের দেহাবশেষ আমেরিকার টেক্সাসে পাওয়া গিয়েছিল। কল্পনার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন মহাকাশযান তৈরি করে নাসা। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওরিয়ন’।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?

তাঁর মৃত্যুর পর বহু মানুষ কল্পনা চাওলাকে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছিল যে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। ভারত, আমেরিকা-সহ বিশ্বের মহিলাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৪ সালে তরুণ মহিলা বিজ্ঞানীদের উৎসাহ দিতে কর্ণাটক সরকার ‘কল্পনা চাওলা পুরস্কার’ চালু করে। তাঁর জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে নাসা তাদের একটি সুপার কম্পিউটারের নামকরণ করেছে কল্পনা চাওলা। বহু রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্কলারশিপ তাঁর নামে প্রচলিত।
কলম্বিয়ার সাতটি শৃঙ্গের মধ্যে একটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত। কল্পনার ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর দেহাবশেষ জিওন ন্যাশেনাল পার্কে দাহ করা হয়। ২০০৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী মিটিওরোলজিক্যাল সিরিজের স্যাটেলাইট ‘মেটস্যাট-১’ এর নাম বদলে ‘কল্পনা-১’ রেখেছেন। তাই মৃত্যুর কুড়ি বছর পরেও তিনি বিজ্ঞান জগতের ও সাধারণ মানুষের মনে রয়ে গিয়েছেন শ্রদ্ধায়, স্মরণে।
* দশভুজা (women – Special Article) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content