শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন! উনিশ শতকের অবরুদ্ধ এক মুসলিম রমণী। বোরখার আড়াল থেকে জীবনকে দেখেছিলেন নিজের মতো করে। সেই আমলে কাজটা সহজ তো ছিলই না, বরং বেশ কঠিন ছিল। হিন্দু সমাজের চেয়েও মুসলমান সমাজে মেয়েদের মুক্তির অবকাশ ছিল আরও কম। সেই সব প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে রোকেয়া নারীমুক্তির কথা বলেন এবং তা কাজে করে দেখান।

রোকেয়া ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মী এবং উনিশ-বিশ শতকের মেয়েদের কাছে প্রেরণাস্বরূপ। রোকেয়ার পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সেই সময় সমাজে মেয়েদের অবস্থান ছিল অনেকটা ক্রীতদাসদের মতো। ক্রীতদাসরা তাও মুক্তির স্বপ্ন দেখতে পারত, কিন্তু ভারতীয় রমণীদের সেই স্বপ্ন দেখারও স্পর্ধা ছিল না। রোকেয়া লক্ষ করেছিলেন ভারতীয় রমণীদের জীবনসঙ্গীকে বলা হয় ‘প্রভু’ বা ‘স্বামী‘! এই শব্দগুলির মধ্যেই মেয়েদের পরাধীন মনস্তত্ত্ব লুকিয়ে আছে। ভারতীয় মেয়েরাও ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পদ বা বস্তু ভাবতে শুরু করেছিল। রোকেয়া ঠিক এই জায়গা থেকে গভীরভাবে ভাবনা শুরু করেন।
সেকালের তুলনায় রোকেয়ার ধ্যানধারণা অনেকটাই আধুনিক ছিল। এখন এই আধুনিকতা বিবাহ পরবর্তী প্রভাব, নাকি শুরু থেকেই এই আধুনিকতা তাঁর সঙ্গী ছিল। মুসলিমদের মধ্যে পর্দাপ্রথা অত্যন্ত কঠোর ও কট্টোর ছিল। রোকেয়া ১৯০৪ সালে, ২৬ বছর বয়সে লিখেছিলেন, মেয়েদের বঞ্চিত করার জন্য পুরুষেরা ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশ বলে প্রচার করেছিলেন। রোকেয়া খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘…মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনও স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।’ রোকেয়ার কাছে যে ধর্ম দাসত্বশৃঙ্খল তৈরি করে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। ধর্মকে কেন্দ্র করে নারীপুরুষের ভেদ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এবং জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন সেই পক্ষপাতদুষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৬: কে জানে ক’ঘণ্টা?

অথচ রোকেয়ার পরিবার প্রাচীনপন্থী গোঁড়া মুসলিম পরিবার ছিল। রোকেয়ার বাবার চারজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ইরানী। বিদেশিনীর সঙ্গে রোকেয়ার বাবার সম্পর্ক না টিঁকলেও তাঁদের পরিবার বিদেশি আদবকায়দায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। রোকেয়ার বাবা মেয়েদের কোরান ছাড়া আর কোনও শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবেননি। রোকেয়ার দিদি করিমুন্নেসা উর্দু আর ফারসি শিখেছিলেন। বাংলা পড়া তাঁদের পরিবারে নিষিদ্ধ ছিল। এই দিদি রোকেয়ার মানসিক বিকাশে সাহায্য করেছেন। রোকেয়ার জন্মতারিখ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। ১৮৮০ সাল নাগাদ তাঁর জন্ম হতে পারে। দিদি করিমুন্নেসার অকালবৈধব্যের কারণে, বাপের বাড়িতেই থাকতেন এবং তাঁর নিজের দুই সন্তানের সঙ্গে রোকেয়াকেও মানুষ করেন।

উর্দু, ফারসি, আরবি ছাড়াও রোকেয়া বাংলাও শিখে যান। ইংরেজিটাও তিনি বেশ ভালো শিখেছিলেন। এই শেখা নিঃসন্দেহে গৌরবের। কারণ, তাঁর পারিবারিক কাঠামো স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে ছিল না। কোনও বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। রোকেয়ার বিবাহ হয় সেই সময়ের অনুপাতে একটুপরিণত বয়সে— আঠারো উনিশ বছর বয়সে। রোকেয়া বেশ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী ছিলেন বছর চল্লিশের এবং দোজবরে। আগের পক্ষের একটি বড় মেয়েও ছিল তাঁর। কিন্তু ঈশ্বর কখন কার জন্য কী নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা কেউ জানে না। এই অসম বিবাহই রোকেয়ার জীবনে আলোর ডানা নিয়ে এল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

রোকেয়ার স্বামী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিলেতেও গিয়েছিলেন। সাখাওয়াতের বিলেতবাস রোকেয়ার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে। রোকেয়া যেন তাঁর স্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রোকেয়ার ভাবনাচিন্তা যেন নতুন আলোর দিশা পায়। একের পর এক লেখা লিখতে থাকেন। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ — সব ধরণের লেখাতেই আশ্চর্য দখল দেখা যায় তাঁর। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা করতেন রোকেয়া। জীবনে অনেক দৃষ্টান্তমূলক কাজ তো তিনি করেই ছিলেন, সেইসঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ভারত ভ্রমণও সেকেলে মেয়েদের কাছে উদাহরণস্বরূপ।

শিক্ষাই যে মেয়েদের জীবনকে বদলে দিতে পারে, এই উপলব্ধি করেছিলেন রোকেয়া। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া দশহাজার টাকায় তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে যুগে তা দুঃসাহসই বটে। স্বামীর সাহচর্য দিব্যি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল রোকেয়াকে। কিন্তু বিধাতা রোকেয়ার পথ আরও জটিল করবেন বলেই বুঝি স্বামীকে কেড়ে নিলেন। তারপর আত্মীয়দের দ্বারা স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু কলম হাতে নিয়ে মেয়েটি থেমে থাকেননি। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচমাস পর ভাগলপুরে পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন। কিন্তু আত্মীয়রা ব্যক্তিগত কারণে এই বিদ্যালয় খুলতে দেয়নি। রোকেয়া হার মানার মেয়েই ছিলেন না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

কলকাতায় ফিরে ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলেন। ছাত্রী সংখ্যা আট। স্বামীর স্মৃতিতে নাম দিলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল!’ ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ল। উর্দু আর বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানদের জন্য আলাদা শাখা তৈরি হল। আপাতভাবে মুসলিম মেয়েদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হলেও ধীরে ধীরে হিন্দু মেয়েরাও এখানে পড়ার সুযোগ পায়।

তাঁর পাঠক সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া তাঁর লেখাকে পুরুষের লেখাও মনে করতেন অনেকে। যাই হোক, জীবনে কম দুঃখ তো ছিল না। স্বামী সন্তান হারিয়ে একলা মেয়েটি আরও অনেক মেয়ের কথা ভেবেছেন। তিনি বুঝেছিলেন কেবল কলকাতা মানেই ভারত নয়, আর ধনী ব্যক্তি মানেই ভারতবাসী নন। রোকেয়া নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। নারীমুক্তি তাঁর কাছে পুরুষের সমক্ষতা অর্জন। রোকেয়া মেয়েদের জীবিকা অর্জনের কথা বলেছেন। আত্মার বিকাশের কথা বলেছেন।

রোকেয়া স্ত্রীকে স্বামীর বোঝা নয়, অর্ধাঙ্গ বলতে চেয়েছেন। তাঁর লেখা মতিচূর, পদ্মরাগ, সুলতানস ড্রিম ইত্যাদি লেখায় তিনি বারবার নারী জাগরণের কথাই বলেছেন। নিজেও উদাহরণস্বরূপ হয়েছেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত জীবনচর্যা ও লেখাআজ অনেকে ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুল সে যুগের এক সাহসিনীর দৃপ্ত স্পর্ধার মতো আজও বর্তমান। রোকেয়া বাঙালি মেয়েদের আলোর ডানা দিতে চেয়েছিলেন। আচ্ছা বলুন তো, আমরা রোকেয়ার মতামত মেনে চলতে পেরেছি কতজন? আজও, এই আধুনিক সময়ে?
সহায়ক বই
নারীপ্রগতির একশো বছর রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, গোলাম মুরশিদ
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা চিঠি
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাবলী
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content